জাপানে নববর্ষ উদযাপন : বিদেশে বাঙালিয়ানা
অভয় দিলে নরমভাবেই বলি, আমাদের স্বভাবের একটা বিশেষ দিক আমার কিছুটা কৌতুক আর কিছুটা বিরক্তির জন্ম দেয়। আমাদের না- মুখিতা। যে কোন কিছুতেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া । যেকোন কিছু প্রবর্তনেই ত্রুটি আর লোকসানটাই প্রথম বিবেচ্য হওয়া। আর পাল্লা দিয়ে `মানি না মানবো না`।
আমাদের প্রশাসনও যেন বিষয়টা বুঝতে পেরেই প্রথমে মানি না মানব না`র থোড়াই কেয়ার করে। পরে পানি বেশি চড়ে গেলে কিছু একটা ঘোষণা দিয়ে আগুনে সেই পানি ঢালে। মানিনা বলার মানুষগুলিও যেন অনশন আন্দোলনে ক্লান্ত হয়ে এই `বুঝ দেয়া` ঘোষণাতেই আশ্বস্ত হতে পেরে বেঁচে যান। প্রসঙ্গ চাকরিতে কোটা নয়, পহেলা বৈশাখ।
আজন্ম ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে থেকেও প্রথম ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার পর কাজিন আর মামা খালাদের দ্বারা এসকর্টেড হয়ে নববর্ষ উদযাপনে রমনা বটমূল যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। ভোর সকালে শাড়ি চুড়ি বেলী ফুল পরে বের হয়ে সারাদিন বেড়িয়ে ঘেমে নেয়ে, পায়ে ফোস্কা পড়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত। তবুও সে আনন্দের তুলনা নাই! ধীরে ধীরে এতে যোগ হয়েছে বেইলি রোডে নাটক দেখা, পাবলিক লাইব্রেরিতে শর্টফিল্ম।
দিন এগিয়েছে, পহেলা বৈশাখে রাস্তায় মানুষের সমুদ্র ডিঙ্গিয়ে রমনায় বা বেইলি রোডে যাওয়া দুরতিক্রম্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মানুষের ভেতর এর উদযাপনের আগ্রহ বেড়ে ওঠাটা আমাকে আশান্বিত করেছে। কারণ এসবই সক্ষমতা সচ্ছলতা বাড়ার দিক নির্দেশনা। আরো পরে পরবাসে বসে খুব বিস্ময় নিয়ে জানলাম দেশে ঈদ বা সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি আমাদের বাংলা নববর্ষ এক নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। যেখানে সকল ধর্ম নির্বিশেষের জন্য বৈশাখী বোনাসের প্রবর্তন হয়েছে। ধর্মীয় উৎসবের মত নববর্ষতেও সপরিবারে নতুন জামা কাপড় কেনা হচ্ছে। এবং সবচেয়ে আনন্দের বিষয় যে এই উদযাপনের আবেশ সকল শ্রেণিতেই ছড়িয়ে গেছে।
শ্রমজীবী নিন্মআয়ের মানুষও দলবেঁধে বেড়াচ্ছে, রমনায় যাচ্ছে। আমাদের মত নিম্ন আয়ের দেশে এটা বিরাট অর্জন। কিন্তু ছোট এক দেশের ২ কোটি লোকের রাজধানী শহর, সমস্ত কিছু রাজধানীমুখি। এই নিয়ন্ত্রণ-অসাধ্য জনসমুদ্র অব্যবস্থাপূর্ণ এই দেশে আবশ্যম্ভাবী চরম নেতিবাচক ঘটনার আশংকা থাকেই। এর ভয়াবহ প্রমাণও পেয়েছি। বাঙালিয়ানার সবচেয়ে বড় এই উৎসবে রক্ষণশীল শুদ্ধতাবাদ আর কু-রাজনীতির আগ্রাসনের খড়গে রমনায় বোমাবাজি, নারী লাঞ্ছনার কলঙ্কময় অধ্যায়।
রাষ্ট্রযন্ত্র`র এর প্রতিরোধক পদক্ষেপের সক্ষমতা হয়নি বলে নানারকম বিধিনিষেধ বেড়াজাল দেয়া হয়েছে, তাতে উষ্মার আগুনে ঘি পড়েছে। অপরদিকে এন্টিভাইরাস ছাড়া নতুন সফটওয়ার ডাউনলোডের মত অনুন্নত দেশে বিশ্বায়নের নেতিবাচক আগ্রাসন আছেই। কে বা কারা কত নতুন নতুন টপিক্স তুলে হুজুগে মাতাল জাতিকে উস্কাতে পারে। উদযাপনে উত্তরোত্তর যেখানে “অপসংস্কৃতি” “ হিন্দুয়ানী রীতি”র মত আলটপকা লাইম লাইটে আসা টপিক্সের প্রচলিত শব্দকামান, অন্যদিকে জাতীয় মাছের দাম কখনো আকাশচুম্বীতা, দুষ্প্রাপ্যতার সাথে পাল্লা দিয়ে ইলিশ পান্তার যথার্থতা নিয়ে তর্কে চা খানায় আর মাঠে ময়দানে, জাতীয় দৈনিকে লেখা আর মোর্চা, ট্রলে ছেয়ে যাচ্ছে সব।
বহু প্রাচীন এক প্রবাদ, “ হুজ্জতে বাংগাল, হিকমতে আফগান ”! তাই আশঙ্কা করি এই হুজুগ বেড়েই যাবে, নিউটনের বল-গতিবিদ্যার ১ম সূত্রমতে “..যদি না কোন বহির্বল তাকে রোধ করে”। অপসংস্কৃতির ভাইরাসকে দমিত করতে বাঙালিয়ানার নিরবছিন্ন চর্চা অবশ্যই চাই, বিশেষত যখন ১৭ কোটি লোকের দেশে সকল শ্রেণির আনন্দ উদযাপনের প্রচণ্ড হাহাকার। কিন্তু দাবানল সামলানোর সামর্থ্য যখন নাই, ভাবা উচিত সেক্ষেত্রে কি আগুনের উৎস সামলে রাখাই কি বাঞ্ছনীয় নয়?
প্রবাসে বসে আঙ্গুর ফল টক বলা হচ্ছে কি? নাহ, পরবাসেও সব বাঙালিরা বাংলা নববর্ষ শান্তিপুর্ণভাবে বাঙালিয়ানায় ঠিকই পালন করে। বিদেশী স্বল্পতার দেশ, আমার বাসস্থান, জাপানে বর্ষবরণ উদযাপন নিয়েই অভিজ্ঞতাটা ভাগাভাগি করি। পরবাসে সবচাইতে হাহাকার ভরা দিনগুলি অবশ্যই ঈদ পার্বণগুলি। তবে যেই দিনটায় সকল সামাজিক মাধ্যম থেকে পালিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে সেই হাহাকার ভরা দিনটি হলো পহেলা বৈশাখ।
ফেসবুকে মাছের রাজা ইলিশ যত কভারেজ পায় হালের কোন ক্রেইজ স্টারও তত মাইলেজ পায় না। আর এদিকে আমি এমনই এক দেশে বাস করি যেই দেশে দেশি খাবার দেশি জিনিস সবই দুষ্প্রাপ্য। তাই সেদিনের পান্তা ইলিশ, ভর্তা, মিষ্টির ছবিগুলি আমাদের কাছে খুবই হৃদয়বিদারক। তবে, প্রথমেই বলে নেই, পহেলা বৈশাখ যে কেবল বাঙালি বা বাংলাভাষীদের নববর্ষ নয়। একইভাবে তা নেপালীদের, শ্রীলঙ্কান, কম্বোডিয়ান এবং থাই নববর্ষ। জাপানে বাঙালি বলতে মূলত বাংলাদেশীই । পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি এখানে সংখ্যায় দুই তিনটি পরিবার। তবে বিশাল এক কমিউনিটি হলো বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র নেপালী কমিউনিটি। এবং অতি ক্রমবর্ধমান এই সংখ্যা। বেশির ভাগই জাপানি ভাষা শেখার কোর্সের ভিসায় এসে খন্ডকালীন প্রচুর কাজ করে এবং ২ বছরের ভাষা শেখার কোর্স শেষে এখানেই ছোট খাট দোকান, রেস্তোরাঁ খুলে দীর্ঘকালীন আবাসিক হয়ে যায়।
অপরদিকে বাংলাদেশী এখানে বেশির ভাগই পিএইচডি বা উচ্চ শিক্ষার্থে আসে। ডিগ্রি অর্জনের পর বেশির ভাগই দেশে প্রত্যাবর্তন করে, কারণ প্রায় সবাই চাকরি থেকে শিক্ষা ছুটিতেই আসেন। আমরা যে শহরটায় থাকি তা জাপানের নবম শহর। কিন্তু আনন্দের বিষয়, জাপানের ২য় বৃহত্তম “পহেলা বৈশাখ” উদযাপনের স্বীকৃতি পেয়েছে আমাদের এই আয়োজন।
১৪ই এপ্রিলের সাথে আগে পরের সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে উদযাপনের দিন ধার্য্য করা হয়। প্রশাসনিক পদে বাংলাদেশীদের এক্সেস আছে বলে মূলত বাংলাদেশীদের উদ্যোগেই ২০১০ সনে দেশীয় কমিউনিটির গন্ডি পেরিয়ে বড় পরিসরে এই আয়োজনের নেপাল- বাংলাদেশ বৈশাখী মেলা কমিটি গঠন করে। মেলার যাবতীয় খরচের সিংহভাগ ফান্ড বাঙালিরাই যোগাড় করেন, প্রশাসনিক উচ্চ পদ থাকার সুবাদে।
নেপালীদের সেই সুবিধা নেই, কিন্তু বিশাল কমিউনিটি এই ঘাটতি গায়ে খেটে পুষিয়ে দেয়। প্রায় ছয় মাস আগে থেকে সিটি অফিস থেকে শহরের প্রাণকেন্দ্রে মেলার জন্য পার্ক, স্টেইজ আর বৈশাখী প্যারেডের অনুমতি নিতে হয়, বহু কাগজপত্র করে। ৬ মাস ধরে নেপালী ও বাঙালি কমিউনিটি প্রধানদের মিটিং চলে। স্টেইজে সেদিন সারাদিন ব্যাপি কি কি পারফর্ম করা হবে, কারা কোনটা করবে , টাইম স্লট থেকে শুরু করে পার্কের স্টেইজের চারিপাশ ঘিরে খাবার আর দেশীয় সামগ্রীর স্টল বরাদ্দ , স্টেইজ সজ্জা , প্যারেড, ফান্ড , আমন্ত্রিত অতিথি, দেশ থেকে সবার এক রকম শাড়ি, পাঞ্জাবী আনা - ইত্যাকার জিনিস এর অন্তর্ভুক্ত।
আমাদের শহরের বাইর থেকেও বাঙালি শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক দল আমন্ত্রিত হয়ে আসে। এমনকি জাপানি শিল্পীরাও আমাদের গান, বাদ্য পরিবেশন করেন। অভিনব হলো প্যারেডটি। সকাল ১০টায় সেটি দেখতে দেখতে পিন পতন নিস্তব্ধ জাপানে সবাই ভিড় জমিয়ে ফেলে। মোবাইলে ছবি ভিডিও রেকর্ডিং চলতেই থাকে। মজার বিষয় প্যারেড আমরা একই ব্যানার নিয়ে হাঁটি, তবে যার যার হাতে থাকে নিজের দেশের পতাকা।
আরো অভিনব হলো নেপালীরা তাদের নিজস্ব মনোমুগ্ধকর সব বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান নাচ ঢোল বাজনা বাদ্য পরিবেশন করতে করতে প্যারেড করেন। ওরা একটু দম নিতে ব্রেক নিলে আমরা বা শ্রীলঙ্কানরাও নিজেদের গান গাইতে গাইতে প্যারেড শেষ করি। যে যার নিজস্ব সংস্কৃতিকে সসন্মানে তুলে ধরি বৈশ্বিক পরিমন্ডলে। প্রতি মাসে অফিস শেষে এই নিয়ে মিটিং করতে যেতে আর এত আয়োজনে ভয়ানক সময় দিতে দিতে প্রতিবার কান মলতাম, এই শেষ। আর কোনদিন পহেলা বৈশাখ কমিটিতে আমি নাই। কিন্তু উৎসবের দিন গোটা আয়োজন এতোটাই মুখরিত হতো যে সব কষ্টের মূল্য শোধ হয়ে যেত।
আয়োজনটিকে অতীতকালে বলতে হচ্ছে , কারণ, দেশের নেতিবাচকতার ধোয়া বিদেশেও বাঙালিদের ভেতরে হল্কা দেয় । উদযাপনের আনন্দের চেয়েও একের মতামত বা প্রাধান্যকে ছোট করতে দুই বাঙালিতেও যেন দুটো দল মত তৈরি হয়ে যায়, ছোট্ট কমিউনিটি আরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়। তাই আমাদের সেই উদযাপন এবার নিয়ে ২ বছর ধরে বন্ধ।
ছোট পরিসরে কমিউনিটি হল ভাড়া করে যা হয় তা যে কিছুমাত্রই না, তা বলাই বাহুল্য। তবে জাপানের রাজধানী টোকিও শহরে বড় বাঙালি কমিউনিটিতে কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন ভাবেই বহু বছর ধরে বৈশাখী মেলা, বৈশাখী অনুষ্ঠান খুব জাঁকজমকপুর্ণ ভাবেই চলে আসছে। দেশ থেকে গণ্যমান্য শিল্পীবৃন্দও আমন্ত্রিত হয়ে আসেন। তাই আশাবাদী হই, আমাদের সার্বজনীন এই উৎসব স্বদেশে পরদেশ সবখানেই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ধারা অব্যাহত রেখে বহমান চির অম্লান থাকুক।
লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম