ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

জাতীয়তাবাদের আলোকে বৈশাখ হোক অর্থবছর

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:৫১ পিএম, ১৫ এপ্রিল ২০১৮

শাজনুশ টিটন

পড়ালেখা শুরু করার পর থেকেই দুইটা কথা আমাদের সকলের পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে গেছে। একটি হলো, আমাদের দেশ বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। আর কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ।

কৃষি এবং ষড়ঋতু-এই শব্দ দুটি একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আর এর সাথে জড়িত আমাদের দেশের অর্থনীতি। ষড়ঋতু ছাড়া আমাদের দেশের কৃষি যেমন তার সাফল্যে পৌঁছাতে পারে না, তেমনি কৃষির সাফল্য ছাড়া আমাদের অর্থনীতি অচল। আর তাই, আমাদের দেশের জন্য ষড়ঋতু, কৃষি ও অর্থনীতি- একটি আরেকটির পরিপূরক।

আমাদের দেশের ষড়ঋতুর শুভ সূচনা হয় বৈশাখ থেকে। বৈশাখের শুরু অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ, বাংলা বর্ষের প্রথম দিন, যেদিন আমরা খুবই উৎসাহের সাথে বাংলা নববর্ষ পালন করে থাকি। এই বাংলা নববর্ষ এবং আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা খুবই সম্পর্কযুক্ত অতীতকাল থেকেই।

বাংলা নববর্ষের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন শাসকের শাসনামলে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন থেকে খাজনা আদায়, বকেয়া আদায় করা হতো। অর্থাৎ, সেই সকল শাসনামলের অর্থনৈতিক বছর শুরু হতো বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন থেকে।

কয়েকজন শাসক এই ব্যবস্থার পরিবর্তন করলেও, বৈচিত্র্যময় আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল কৃষি ব্যবস্থা অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি বিধায় তাদের আবার পূর্ব অবস্থায় ফিরে আসতে হয়। যদিও এরপর বিভিন্ন শাসনামলে অর্থনৈতিক বছর পরিবর্তন হয়েছে।

অতীতকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ‘বাংলা নববর্ষ’ আমাদের ব্যবসায়ী সমাজের কাছেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এইদিন তারা ‘হালখাতা’ করে থাকেন। অর্থাৎ, পূর্বের সমস্ত বকেয়া আদায় করে নতুন হিসাব শুরু করেন এবং উপস্থিত সকলকে মিষ্টিমুখ করিয়ে থাকেন। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আমাদের গ্রাম বাংলায় মেলার আয়োজন বাঙালির দীর্ঘকালের ঐতিহ্য, যা এখন শহরেও পৌঁছে গেছে।

পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ৩/৪ দিন ধরে মেলার আয়োজন বর্তমান সময়ে শহুরে জীবনেও ঐতিহ্যের পর্যায়েই দাঁড়িয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, পহেলা বৈশাখ কেন্দ্রিক একটি বড় অর্থনৈতিক বাজার গড়ে উঠেছে, যা বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে আরো সমৃদ্ধ করেছে।

বাঙালি জাতি বারবার বিদেশি শাসন- শোষণের নিষ্পেষণে হয়েছে নিগৃহীত। নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে সাংস্কৃতিক উৎসব পালন করতে গিয়ে। তবুও, বাঙালি বিচ্যুত হয়নি তার আপন সত্তা ও আদর্শ থেকে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন প্রমাণ করে বাঙালি জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র। বাঙালি জাতির কাছে বাংলা নববর্ষ ভিন্নমাত্রা পায় তখন থেকেই। এরই ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল অস্ত্র ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে, আমাদের দেশের অর্থনৈতিক বছর পরিবর্তন করে, বাংলা বছরের সাথে মিলিয়ে, পহেলা বৈশাখ থেকে নতুন অর্থবছর করা এখন সময়ের দাবি। অর্থাৎ, নতুন অর্থবছর হবে ১ বৈশাখ (১৪ এপ্রিল) থেকে ৩০ চৈত্র (১৩ এপ্রিল)।

যদি আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক বছরের দিকে তাকাই, তাহলে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সময়ে অর্থনৈতিক বছর শুরু হয়। যেমন, উন্নতদেশ কানাডা, জাপানের অর্থনৈতিক বছর শুরু হয় ১ এপ্রিল থেকে। ১৯০ বছর আমাদের শাসন করা যুক্তরাজ্যেও শুরু হয় ১ এপ্রিল থেকে।

আমাদের প্রতিবেশি দেশ, যাদের আমাদের মত আবহাওয়া এবং কৃষিনির্ভর অর্থনীতি রয়েছে, তাদের দিকে তাকাই এবার। ভারত ও মিয়ানমারের অর্থবছরও শুরু হয় ১ এপ্রিল থেকে। তাই, আমাদের অর্থবছর পরিবর্তন করা খুবই যৌক্তিক।

ইংরেজি মাসের মাঝ থেকে অর্থবছর শুরু করার নজিরও বিশ্বে রয়েছে। যেমন, ইরানের অর্থবছর শুরু হয় ২১ মার্চ থেকে আর আফগানিস্তানের শুরু হয় ২১ ডিসেম্বর থেকে। বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থবছর শুরু হয় ১ অক্টোবর থেকে এবং আরেক শক্তি চীনের শুরু হয় ১ জানুয়ারি থেকে। আর তাই, আমাদের অর্থবছর পরিবর্তন করা খুবই ন্যায়সঙ্গত।

আমাদের প্রতিবেশি দেশের মধ্যে একমাত্র পাকিস্তানের অর্থবছর শুরু হয় আমাদের মতো ১ জুলাই থেকে। যেই পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত, সেই শাসনব্যবস্থা প্রসূত অর্থবছর অব্যাহত রাখা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী। আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্যই ছিলো শাসনব্যবস্থা বদলের। স্বাধীনতার দীর্ঘ প্রায় ৪৮ বছর পরেও নিজস্ব সংস্কৃতি ও অর্থনীতির নির্ভর করে অর্থবছর প্রণয়ন করতে না পারা বাঙালি জাতির জন্য একটি বিশাল ব্যর্থতা।

তাই, বাংলা ১৪২৫ নতুন বছরে সকলের দাবি হোক, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের আলোকে, পহেলা বৈশাখ থেকে নতুন অর্থবছর চাই।

সকলকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা।

লেখক: শিক্ষার্থী, মাস্টার্স ইন সোসিওলজি এন্ড সোশ্যাল পলিসি, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন