ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বিদেশ মানেই টাকা, আঙ্গুর বেদানা আর সস্তা মদ খাওয়া না

তানজীনা ইয়াসমিন | প্রকাশিত: ১০:১২ এএম, ১৫ এপ্রিল ২০১৮

পরিচিত এক ভদ্রলোক স্টুডেন্ট ভিসায় আমেরিকা গিয়ে ক্লাসের পর পার্ট টাইম জবে গিয়েছিলেন। পেট্রোল পাম্পের কাজ। দেখলেন টয়লেটটা বেশ ময়লা হয়ে আছে । দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে । নাক সিঁটকে এসে কাজে মন দিলেন। বস এসে টয়লেট ঘুরে ওনাকে একই কথা জানালেন। তিনি সায় দিয়ে বিরক্ত চোখে মুখে বললেন , “হ্যা সকালে ক্লিনিং ম্যান এসেছিল। কিছুই কাজ করে যায়নি !” 

বস অবাক হয়ে বললেন , “কোন ক্লিনিং ম্যান তো আসবার কথা না। বাইরের কেউ এসে টয়লেট ব্যবহার করে থাকবে। ক্লিন তো তোমাকে করতে হবে! ” ভদ্রলোক কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন তিনি কানে ভুল শুনছেন, না কি বস তাকে চিনতে পারেনি। তিনি ভুল শোনেননি নিশ্চিন্ত হবার পর বসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে নিজেকে নিরস্ত করতে করতে ভাবলেন তার কাছে দুই অপশন; ১. দেশে ফিরে যাওয়া ২. এই শর্ত মেনেই কাজ করা।

উল্লেখ্য, বিদেশে গেলেই কেউ জবের মোয়া নিয়ে বসে থাকে না। বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে কোনভাবে একটা জোগাড় হলে বিরাট শুকরিয়া। পেছনে পড়ে আছে বিদেশে আসার জন্য পরিবারের বিরাট খরচের পাহাড়। তিনি সব ইগো ঝেড়ে কাজে মন দিলেন। গল্পটা সেদিন খুব মনে পড়ছিল যেদিন আমাদের অফিসের ভেতরে কিছু অভ্যন্তরীণ কক্ষ অদল বদল, সজ্জা পরিবর্তন হলো। ম্যুভারস এন্ড প্যাকার্সরা মালামাল বহন করে ট্রাক ভরে আনা নাওয়া করবে। কিন্তু বাকি কাজ?

আমাদের নেটওয়ার্কিং টিমের প্রধান, পঞ্চাশোর্ধ স্যুটেড বুটেড ভদ্রলোক। কি অবলীলায় মেঝের ছোট ছোট ব্লক কাটা কার্পেট সরিয়ে তারও নিচের স্ল্যাব সরিয়ে নেমে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে সবগুলি তারের সূত্র ধরে ধরে নেটওয়ার্ক ক্যাবলের অবস্থান পরিবর্তন করলেন। শীতের দিনে স্যুট, শার্ট খুলেও ভেতরে গেঞ্জি ভিজে ন্যাতন্যাতা হয়ে গেলো। সেই মুহূর্তে তার সাথে কোন নির্মাণ শ্রমিকের কোন তফাৎ করা যেত না।

যে যা পারলো হাত লাগালো, আমি চেষ্টা করেও বেশি কিছু পারলাম না। কারণ আমরা এভাবে যে কোন কাজ করার তরিকাই তো জানিনা। উল্টা ভুল ভাল স্ল্যাব সরিয়ে, ক্যাবল টেনে কাজ বাড়ানো। অথচ ওদের সবার দেখলাম কি অনায়াস অভ্যস্ত ভঙ্গি! যেন এটাই ওদের পেশা! সদ্য চাকরিতে ঢোকা লিকলিকে শরীরের সেলস এক্সিকিউটিভ মেয়েটা যেভাবে বিশাল বিশাল কার্ডবোর্ড কায়দা করে তুলে এদিক সেদিক নিল, তাজ্জব হয়ে উপলব্ধি করি আমার ছেলেদের স্কুলের ট্রেইনিংগুলো কি জন্যে ছিল।

এদের প্রাইমারি স্কুলেই গার্হস্থ্য বিজ্ঞান থাকে, ছেলে মেয়ে সবার জন্যই। তারা একদিন রান্না করে, আরেকদিন সুঁই কাঁচি নিয়ে ব্যাগ বানিয়ে আনে, আরেকদিন সিরামিকে মগে ডিজাইন করে বাড়ি ফেরে, আরেকদিন কাঠের জিনিস বানায়। প্রথম প্রথম চাকরিতে যোগদান করে ভাবতাম, কি ব্যাপার আমার ডেস্কটা কেউ মোছেনি, কেউ ঝাঁট দেয়নি! যেদিন পাশের ডেস্কের কলিগ নিজেই আমার ডেস্কের নিচে ভ্যাকুম করতে শুরু করলে সেদিন লজ্জার মাথা খেয়ে বুঝলাম, এটা আমার কাজ। এটা করার কোন পিওন চাপরাশি থাকেনা। এবং সত্যি সেই কাজ নিজে হাতে করার পর থেকেই অহেতুক অগোছালো ময়লা করা হারাম হয়ে গেছে ।

আলোচিত বহুব্রীহি নাটকে দেখেছিলাম গৃহকর্তার নীতিবাক্য গৃহকত্রী হাতে কলমে প্রতিফলন দেখাতে গৃহকর্মী রহিমার মা আর কাদেরকে খাবার টেবিলে বসিয়ে খেতে দিলেন। স্বয়ং গৃহকর্তাও কিন্তু তখন অস্বস্তি ঝাড়তে পারেননি। পারা যায় না, কারণ ওদের কাজটা আমরা পুরোটা হাতে নেইনি, সেই কাজের প্রতি অশ্রদ্ধা আমাদের জিনে বহুদিনের। এক পুরুষে এই ট্যাবু আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় থেকে সম্ভব না। সে কেউ যত মহানুভব হোক, টক শো আর ফেসবুকে যাই ঝেড়ে দিক, এক দিনে এই ব্যবধান মুছে ফেলা সহজ না।

এবং ঠিক এই কারণেই সভ্য দেশে পাশাপাশি বসে সকল শ্রেণির মানুষ খেতে আড্ডা দিতে পারে। সুবিধা হলো যে কোন পেশার কাজ করতে পারে, যেটা আমরা না খেয়ে মরে গেলেও পারবো না। কারণ এই সমাজে সবাই সব কাজ নিজে করে সেই কাজের প্রতি শ্রদ্ধা অর্জন করেছে। জাপানে যে কোন ঘন্টা ভিত্তিক কাজের মজুরির ক্ষেত্রেই ন্যাশনাল মিনিমান সমান, ঘন্টায় সর্বনিম্ন প্রায় ৬৫০ টাকা। সে আপনি যেই পেশাতেই থাকুন। তাই ভেদাভেদ নাই। সব কাজের কষ্টটা সবাই জানে বলেই সমান গুরুত্ব ও যথাযথ মূল্য দেয়।

আমার নিজের অভিজ্ঞতায় আমি দেখি, আমরা এখানে যে যার প্রফেশনে আছি আমাদের দৈনন্দিন সময়ের ৩০- ৩৫% , এবং একজন আরেকজনে তফাৎ ঐটুকুই। বাকি ৬৫%-৭০% সময় আমরা সবাই এক। আমরা গৃহকর্মী, ড্রাইভার, সুইপার, একক বাসা হলে দারোয়ান,মালি সব। এমনকি সেলুনের হাই চার্জ আমাদের বাঙালি মানসিকতায় খাপ খাওয়াতে বাধে বলে বেসিক লেভেলের হেয়ার কাট অনেকেই নিজেই দেয়,বাচ্চাদেরটা ছেটে দেয়। সেই অর্থে নাপিতও।

আসবাবপত্রের দোকানে অর্ডার দিলেও বেশির ভাগ দোকানই ডেলিভারি দেবে আসবাবের পিস বাই পিস। ম্যানুয়াল পড়ে পড়ে আপনাকে টেবিল, শেল্ফ , খাট বানাতে হবে। তো মিস্ত্রীও তো হলেন! যখন বাজারে বের হই, তখন কেউ ড্রাইভ করে দেয়না, কেউ সদাইভর্তি ঢাউস ট্রলি থেকে সদাই ব্যাগেও ভরে দেয় না। গাড়িতে তোলা- নামানো, বাড়ি এনে গোছানো তো দূর। সেই বাজার এনে দম নিয়ে ২য় পর্ব রান্না, ধোয়া বাড়ারও কোন শেষ নাই।

কিছু কিনে যে খাবো সেই উপায়ও খুব সামান্য। খাবার হালাল হারামের বিষয় তো আছেই, আরো আছে আমাদের স্বাদের খাবার পাওয়া। এবং এই নাইট্রোজেন চক্র বড়দের না, শিশুদেরও। সকালে টিফিন নিয়ে নাস্তা করে বের হও। কিন্ডারগার্টেনের শিশু হলেও একা সবটা খাবার খাও, একা টয়লেট করো, জামা পাল্টাও , এলোমেলো করলে গোছাও, ময়লা তুলে জায়গায় ফেলো, জুতা ঘরে ঢুকে সোজা করো। না, তাদের ট্রেনিং না দিয়ে কিছুই করানো হয় না। কিন্তু এই জিরো বয়সের ট্রেনিংই সারাজীবন চলে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে গ্রথিত হয়ে যায়। অন্তত ক্লান্ত বিধ্বস্ত বাবা মায়ের নিজের ছেলে মেয়ের সবকিছু মুখে লোকমা পাকিয়ে দেয়ার যাবজ্জীবন দাসত্বটা করতে হয় না।

শুনতে কটু লাগছে, মনে হচ্ছে বাচ্চার জন্য তো এটা করতেই হয়। কিন্তু এই মায়ার প্যাকেজ ডিল তাকে ভবিষ্যতের জন্য পঙ্গু অকর্মণ্য ছাড়া কিছু বানাচ্ছে না। আমাদের ক্যাডেট কলেজে পড়া শিশুদের স্মার্টনেস সচরাচর বেশি , কারণ তারা একা বড় হবার সুযোগ পেয়েছে। এসব দেশে বাচ্চারা সব স্কুলেই তা পেয়ে যায়। বিদেশে পড়তে আসা আমাদের দেশের ছেলে মেয়েগুলির মধ্যে এই স্পুন ফিডিং ট্রিটমেন্ট পাওয়া বাচ্চাগুলি কি যে যাতনায় দিন পার করে তা নিয়মিত দেখেই এই বোধোদয় হয়েছে।

সর্বোপরি যারা আজীবন দেশে থাকেন তারা এই যাতনা কোনদিনই জানেনই না! সকালে বুয়া কেন আসলো না, কেন ড্রাইভার আসলোনার অপেক্ষায় মেজাজ নষ্ট করা। যানবাহন অপ্রতুল বলে একটা মানুষের জন্য রাস্তায় একটা করে গাড়ি নামে কাজে যাবার আর ফেরার সময়ে। চেইন রিঅ্যাকশনের মত একটার সাথে একটা সমস্যার চেইন, অবিচ্ছেদ্য বন্ধন! জাপানের ঘর হয় ছোট, রাস্তা বড়, পার্ক বড়, রাস্তা গুনে যানবাহন, পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্য ১৫/২০ মিনিট হেঁটেই যেতে হয়।

আমরা ঘর বড় চাই, হাঁটবো না, গাড়িও চাই- আমাদের জায়গা থেকে এতটুকু ছাড় দেবোনা, চিপস, সিগারেট রাস্তায় না ছুঁড়ে পারবো না, আর সরকার সব করে দেবে! দেশে হাঁটা চলা না করা আমাদের ফাস্ট ফুড, প্রসেসড ফুড খাওয়া শরীর রোগ ভোগের বাসা। পেট বড় পা চিকন, অপুষ্ট দেহ কাঠামো। আয়েশী শরীরে জ্যামে আটকে থেকে আর খানা খাজানা করতে করতে দেশোদ্ধারের আর সামাজিক মাধ্যমে জ্ঞানী সচেতন মহামানব হবার কত সুযোগ!

গরীব দেশের মোবাইল ডাটাও বাতাসের দাম, পানির দরও না! ২৫০-৫০০ টাকায় মাস পার! জাপানে আমরা ৫০০০ টাকাতেও যে ফোরজি পাই তাতেও মোবাইলে অন্য অপেরাটরে কথা বললে মিনিটে ৩০টাকা। তাই অতি প্রয়োজন ছাড়া কোন বাতচিত নাই। এতো কীসের কথা? আপনি কি জননেতা? কত স্বর্গে আছেন রে ভাই, এপ্রিশিয়েট করতে শিখুন। বিদেশ মানেই টাকার ওপর শুয়ে আঙ্গুর বেদানা আর সস্তা মদ খাওয়া না। অপশন আছেই দেশ ত্যাগের, বাছাই আপনার।

লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।
[email protected]

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন