ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

কোটা নিয়ে কিছু কথা : মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

ফরিদ ছিফাতুল্লাহ | প্রকাশিত: ০৩:১০ পিএম, ১২ এপ্রিল ২০১৮

কোটা থাকতে হবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যতদিন মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য যোগ্য হয়ে না ওঠে, যতদিন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সাম্যাবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হয় ততদিন পর্যন্ত সময়োপযোগী ও যৌক্তিক পরিমাণে কোটা থাকতেই হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে একথা অবশ্যই যথাযথ যে, কোটা বৈষম্য সৃষ্টি করে না, বৈষম্য দূর করে।

কিন্তু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী মেধা ও যোগ্যতার প্রতিযোগিতায় নিজেদেরকে যোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে কোটার কারণে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়লে তা শেষ পর্যন্ত তাদের জন্য শুভ হবে না। কোটাধিকারীদের মনে যদি এই ধারণা জন্মায় যে, মেধা বা যোগ্যতার চর্চার কী দরকার যখন তাদের ফেভার করার জন্য নির্দিষ্ট কোটার ব্যবস্থাই আছে- তাহলে তারা যোগ্যতর হয়ে উঠবে কীভাবে? এগুবে কীভাবে? পশ্চাদপদতা কাটিয়ে উঠবে কীভাবে? কোটা ব্যবস্থার এই মনস্তত্ত্ব উপেক্ষণীয় নয়।

এ কারণেই বলছি আপনার প্রাধিকারের তালিকায় পিছিয়ে পড়াদের জন্য কোটার চেয়ে তাদেরকে মেধা ও যোগ্যতায় যোগ্য করে তোলার আয়োজনের গুরুত্ব বেশি থাকা উচিত। স্বাধীনতার পর থেকে সকল সরকার পিছিয়ে পড়াদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করেই দায় সেরেছে। তাদেরকে যোগ্যতর করে তোলার জন্য পর্যাপ্ত আয়োজন করতে পারে নাই।

পিছিয়ে পড়া জনপদে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখি না। স্বাধীনতার প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় পার হলেও পার্বত্য জেলা তিনটির একটিতেও একটিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় নাই। মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য এখনও রাজধানী শহর বিকল্পহীন। মেধা ও যোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে আজকের যুগে শারীরিক প্রতিবন্ধিতা কোনো বাধাই হতে পারে না যদি তাদের জন্য পর্যাপ্ত বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকে। এই দেশে সেরকম বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কতটা আছে?

এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র বাংলাদেশে জেলাভিত্তিক ইজম এই রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিকতার ধারণার বিপরীত একটি বিষয়। যত ক্ষুদ্র মাত্রাতেই হোক বিষয়দুটি সাংঘর্ষিক। ভুলে গেলে চলবে না সারাদেশকে বিভাগ, জেলা, উপজেলায় বিভক্ত করা শুধুই প্রশাসনিক প্রয়োজনে। অন্যকোনো বিবেচনা এখানে নেই। এই দেশের সকল জেলায় একই ভাষিক জনগোষ্ঠীর বসবাস। নৃতাত্ত্বিক বা অন্য কোনো ক্রাইটেরিয়াতেও কোনো বৈসাদৃশ্য নাই। তাই পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য কোটা সংরক্ষণের চেয়ে মানসম্পন্ন উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিতকরণের কাজে বেশি জোর দেয়া উচিত। উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের ব্যাপারে সারা দেশের সুষম অগ্রগতির জন্য কোটা ব্যবস্থা সীমিত আকারে থাকতে পারে জেলায় জেলায় রেষারেষিকে উৎসাহিত না করেই।

গোপালগঞ্জ বা বগুড়ার মানুষ একই ভাষা, ধর্ম বা সংস্কৃতির ধারক। কোনো ভেদাভেদ আছে কি? যতটুকু আছে তার প্রায় পুরোটাই আমাদের হাতে তৈরি। কৃত্রিম।

ভারতের মতো বহু ভাষাভাষী, বহু সংস্কৃতির দেশ বাংলাদেশ নয়। এই জেলাভিত্তিক যূথবদ্ধতার মধ্যে এই দেশের সমরূপিতার জন্য প্রচ্ছন্ন হুমকি রয়েছে। এটা বোঝা জরুরি। দেশব্যাপী সুষম উন্নয়নের জন্য এটা প্রতিবন্ধক। শুধু নিজ জেলাপ্রেমের কারণে আখ উৎপাদনশীল জেলায় চিনিকল স্থাপন না করে যেখানে আখের চাষই নাই সেই জেলায় চিনিকল স্থাপনের মতো অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়া কি গ্রহণযোগ্য? নিকটবর্তী রাজশাহীতে একটি চালু এয়ারপোর্ট থাকা সত্বেও শত শত কোটি টাকা খরচ করে বগুড়াতে আরেকটি এয়ারপোর্ট নির্মাণের মতো অপচয়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হয় শুধুমাত্র অযৌক্তিক জেলাপ্রেমের কারণে। এই দেশে 'বাংলাদেশ'এর সরকার প্রতিষ্ঠিত না হয়ে তাই 'বগুড়া' বা 'গোপালগঞ্জ' এর সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এককেন্দ্রিক ছোট্ট এই দেশটায় জেলায় জেলায় কেন বিভক্তি,বিদ্বেষ এবং রেষারেষি থাকবে? আমরা কি দূর ভবিষ্যতে জেলাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ দেখতে চাই? তারপর সেই সূত্রধরে বিছিন্নতাবাদ?

৫৬ শতাংশ যদি কোটায় নিয়োগ পায় তাহলে যোগ্যতায় পিছিয়ে থাকা কোটাধিকারীরাই প্রশাসনে সংখ্যাগুরু হয়। মেধাবীরা হয় সংখ্যালঘু। এই চিত্র দেশের দক্ষ প্রশাসনের অনুকূলে নয়। আর কোটা সংস্কারের যৌক্তিকতার এটা একটা কারণ।

দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় শিক্ষালাভ করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতার দিক থেকে প্রথমসারির লোকদের দ্বারা প্রশাসন পরিচালিত হওয়াটা জনগণের প্রাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। সেরারাই দেশের প্রশাসনের কর্ণধার হবেন- জনগণের এই চাওয়া কি অন্যায়?

মুক্তিযোদ্ধা কোটার সঙ্গে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আবেগ জড়িত। জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আমাদের রয়েছে অপরিসীম শ্রদ্ধা ও সম্মান। এই শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনে কোনো রকম কার্পণ্য বা শৈথিল্য প্রদর্শন বরদাশত করার নয়। সত্যিকারের সম্মান প্রদর্শন করতে হলে এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বংশধরদের কোটা বা ভাতাকে তাদের প্রতি করুণা হিসেবে উপস্থাপন করা উচিত নয়। তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাদি তাদের জন্য করুণাসুলভ নয় সম্মানজনক হওয়া উচিত। সাম্প্রতিক কোটাবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে নানামুখী আলোচনায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যদি সামান্যতম অশ্রদ্ধাও প্রকাশ পেয়ে থাকে তা কোনভাবেই কাম্য হওয়া উচিত নয়। এই কোটা নিয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পরিবারকে সারাদেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ বানানোর মতো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি কেন তৈরি হবে? এর দায় কার? কেন আজ জনগণের একটা অংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে তাচ্ছিল্য করার সুযোগ পাবে? মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করে আখেরে কার লাভ?

অধিকাংশ নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটার পর্যাপ্ত প্রার্থী না থাকার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে দেশের সরকার বা জনগণ কতটুকু ভেবেছে? আমি যদি বলি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোর জন্য উচ্চ শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা এর একটি কারণ?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান সন্ততির জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ কোটা রাখাই কি যথেষ্ট? কোটাগুলো পূরণ হল কি না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এই কোটায় পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষার্থী পেল কিনা, দেশের মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোর সকল সন্তান এই কোটা সুবিধা লাভ করল কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা এবং সেই মোতাবেক পদক্ষেপ নেয়া দরকার নয় কি? প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা আজও কেন অসম্পন্ন? দেশের আনাচে কানাচে কেন এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে দীনহীন জীবন যাপন করতে হয়? মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নোংরা রাজনীতি বন্ধ হবে কবে বলতে পারেন? কবে আমরা শিখব সম্মান ও করুণার পার্থক্য? মুক্তিযোদ্ধারা কি কোনো বিশেষ দলের একক দায় বা সম্পদ? নাকি সমগ্র জাতির?

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে যে সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের মনের জ্বালা জুড়িয়েছ, তাদের মনে স্বস্তির সুবাতাস প্রবাহিত করেছে সেই সরকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাশা অনেক। যুদ্ধাপরাধের বিচার সেই প্রত্যাশার সমাপ্তি নয়, সূচনা। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে প্রচ্ছন্নভাবে ও প্রকাশ্যে বিভিন্নভাবে বিভিন্নক্ষেত্রে অপমান, অপসারণ ও কোনঠাসা করার যে ঘৃণ্য ধারাবাহিকতা চলে আসছে তা নিয়ে হাজার পৃষ্ঠার গ্রন্থ বা হাজার মিনিটের তথ্যচিত্র বানানো যাবে। জাতি এর অবসান চায়। যুগোপযোগী ও আজকের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে যৌক্তিক ভাবনা চিন্তার উন্মেষ জরুরি।

কোটা বিরোধী আন্দোলন যেন এই ক্ষেত্রে আমাদের চোখ খুলে দেয়। জাতির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যেন কোটা, ভাতা ইত্যাদি নিয়ে বিব্রত হবার মত ন্যূনতম আশংকাও ভবিষ্যতে সৃষ্টি না হয়। নাতি-পুতি শুধু নয় এই দেশ এই জাতি পৃথিবীর বুকে যতদিন টিকে থাকবে ততদিন মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য, তাদের বংশধরদের জন্য সম্মানজনক কোটা, ভাতা ইত্যাদি চালু থাকবে। ভবিষ্যতে কখনো যদি এর প্রয়োজন ফুরিয়েও যায় তবুও তাদের সম্মানে প্রতীকী হলেও এটি অব্যাহত থাকবে।

ভাবাবেগ যেমন উপেক্ষণীয় নয় তেমন সকল সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ভাবাবেগতাড়িত হওয়াও বাস্তবসস্মত নয়। আমরা কি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমাদের সম্মান শুধু মুখে মুখে উচ্চারণ করব? শুধু লোক দেখানো? নাকি দেশে ও সমাজে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের ও তাদের বংশধরদের সম্মানজনক অবস্থান প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করব? ভুলে যাওয়া উচিত নয় মুক্তিযোদ্ধাদের সীমাহীন আত্নত্যাগের বিনিময়েই আমরা এই স্বাধীন ভূখণ্ড লাভ করেছি। তা না হলে কোথায় থাকতাম আমরা আজ? কী হত আমাদের জাতিগত পরিচয়? কুর্দিদের কথা ভাবুন একবার। স্বতন্ত্র জাতিসত্তা হওয়া সত্বেও শতাব্দীর পর শতাব্দী জাতিটি দেশহীন, রাষ্ট্রহীন।

আমরা যেন অকৃতজ্ঞ অভিশপ্ত জাতি হিসেবে চিহ্নিত না হই। আমরা যেন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আমাদের সকল কলহ বিবাদের ঊর্ধ্বে স্থান দেই। সবচেয়ে ভাল এবং কাঙ্ক্ষিত পরিস্থতি যেন হয় এরকম- মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধররাই মেধায়, মননে, শিক্ষায়, যোগ্যতায় সমাজের অগ্রসর শ্রেণি এবং দেশের নিয়ন্ত্রণভার তাদের হাতেই। যারা প্রাণ বিসর্জন দিয়ে, রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে এই দেশ কেবলমাত্র তাদের হাতেই নিরাপদ। নতুন ঊষাকালে সবার বোধোদয় ঘটুক।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন