ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

শুধু প্রবৃদ্ধি অর্জন নয়, চাই আর্থিক খাতে জবাবদিহিতা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ১০:০৫ এএম, ০৭ এপ্রিল ২০১৮

 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। একই সঙ্গে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় প্রায় দেড়শ' ডলার বেড়ে এক হাজার ৭৫২ ডলার হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের এ অংক এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।

মঙ্গলবার জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ও মাথাপিছু আয়ের সাময়িক হিসাব প্রকাশ করেছে বিবিএস। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। বিবিএস প্রতি বছরই অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে এসে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়সহ বিভিন্ন খাতের সাময়িক হিসাব প্রকাশ করে থাকে। এ হিসাব করতে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের বিভিন্ন উপখাতের ৫ থেকে ৯ মাসের তথ্য ব্যবহার করা হয়। অর্থবছর শেষে গিয়ে বিবিএস চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করে।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ৭ দশমিক ৪০ শতাংশ। বিবিএসের সাময়িক হিসাবে, সে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এ বছরের প্রবৃদ্ধির হার বাংলাদেশের জন্য রেকর্ড। এর আগে বাংলাদেশে সাড়ে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়নি। প্রায় এক দশক ৬ শতাংশের বৃত্তে আটকে থাকার পর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘর অতিক্রম করে।

ভাল খবর। কিছুদিন আগে আরেক ভাল খবর ছিল যে, দেশ জাতিসংঘের স্বল্পন্নোত স্তর থেকে উন্নয়নশীল স্তরে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। মধ্য আয়ের দেশের লক্ষ্য দ্রুত অর্জিত হলো প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার, রেমিট্যান্স প্রবাহ বেগবান থাকা এবং টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল থাকার কারণে।

২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশে (যাকে অনেকেই উন্নত দেশ বলছেন) পরিণত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের দুটি দিক আছে। একটি অর্থনৈতিক বাস্তবতা, অন্যটি রাজনৈতিক সদিচ্ছা। আর্থসামাজিক অগ্রগতিতে আমরা ভালো করছি-এ রকম একটা স্বীকৃতি আমরা পেয়েছি। একে কাজে লাগিয়ে যদি নতুন বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ সমাবেশ করতে পারি, কম সুদে বৈদেশিক ঋণ নিতে পারি, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারি, অভ্যন্তরীণ কর আদায় বাড়াতে পারি, তাহলে একটা প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ হয়।

এই অগ্রযাত্রায় আর্থিক খাতে সুশাসন এক বড় প্রত্যাশার জায়গা। কিন্তু সেখানেই আমরা অস্থরিতা ও দুর্বৃত্তায়ন দেখছি। দুর্বৃত্তায়িত অর্থনীতির দৃষ্টান্ত অনেক। অফিস আদালতে ঘুষ, বড় কাজে কমিশন ভাগাভাগি, নির্মাণ কাজের অর্থ লোপাট, জমি বেচাকেনায় চুরি, রাজস্বখাতে দুর্নীতিসহ নানা ফিরিস্তি দিয়ে শেষ হবেনা। তবে আর্থিকখাতের বড় বড় ঘটনা সবাইকে পরাজিত করছে বলেই মনে হয়।

মার্কিন রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর আবার আলোচনায় হলমার্ক কেলেংকারি, বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি, ফার্মার্স ব্যাংক কেলেংকারিসহ নানা কারণে ব্যাংক ও আর্থিক খাত যখন কঠোর সুশাসন প্রত্যাশিত, তখন আমরা দেখলাম উল্টোচিত্র।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০০৮-এ বলা হয়েছিল জনগণের রায়ে সরকার গঠন করতে পারলে দলটি ৫টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিবে। সেগুলো হল (১) দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ এবং বিশ্বমন্দার মোকাবিলায় সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, (২) দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা, (৩) বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়ন, (৪) দারিদ্র্য বিমোচন, এবং (৫) সুশাসন প্রতিষ্ঠা।

আর ২০১০ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ১৭তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “আমার নিজস্ব একটা উন্নয়ন দর্শন আছে। আর তা হচ্ছে দেশের সিংহভাগ গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের উন্নয়ন। ভূমিহীন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠির উন্নয়ন। আর এজন্য আমি মনে করি, শুধু প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেই হবে না, এই প্রবৃদ্ধির ফসল যাতে দরিদ্র মানুষের ঘরে পৌঁছে তার উপায় বের করতে হবে।”

প্রধানমন্ত্রী এখনও এই দর্শনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলেই বিশ্বাস আছে। কিন্তু আর্থিক খাতসহ সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়নের যে গতি বা চেহারা উন্মোচিত হচ্ছে তাতে দেশ থেকে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও অসমতা দূরীকরণ এক দুরূহ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যের সম্পদ গ্রহণ, অধিগ্রহণ, হরণ, দখল, বেদখল, আত্মসাতের মাধ্যমে দুর্বৃত্তায়ন হয়।

দুর্বৃত্তরা সমাজের মোট সম্পদ শুধু হরণই করেনা, প্রতিষ্ঠানসমূহও ধ্বংসও করে দেয়। এই প্রক্রিয়ায় রাজনীতির সহযোগিতায় ক্ষমতাধররা অধিকতর ক্ষমতাবান হয়, আর ক্ষমতাহীন দরিদ্রের অক্ষমতা কেবলই বাড়তে থাকে। দুর্বৃত্ত-লুটেরাদের সঙ্গে বাজার-অর্থনীতি-রাজনীতি-সরকার এর সমস্বার্থের সম্মিলনই যেন চারদিকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

অর্থনীতি এবং রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নে গুটি কয়েক লোক অঢেল বিত্ত সম্পদের মালিক হয়েছে। এমন অবস্থা চলছে যে, তাতে প্রবৃদ্ধি যদি বাড়েও সেই উন্নয়ন মানুষকে কেবল বঞ্চনা দিতে তাকে। উন্নয়নের মানবিকীকরণ চাইলে ফাও-খাওয়া শ্রেণি আর গোষ্ঠীকে রাজনীতি ও সরকার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সহমর্মী ও আস্থাশীল সুদূর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। সমাজ থেকেও প্রচণ্ড শব্দে এই দাবি উঠতে হবে।

কোনও কোনও গবেষক বলেন, কালো অর্থনীতির আকার এখন বৈধ অর্থনীতির প্রায় ৭৫ শতাংশেরও বেশি। আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি, চোরাচালান, কালোবাজারি, মাস্তানি, চাঁদাবাজি, ঠিকাদারির নামে পুঁজি লুণ্ঠন, রাজনৈতিক নেতা-পাতিনেতা-কর্মীদের লুটপাট কিংবা মন্ত্রী-সাংসদদের মার্জিন-শিকার- এগুলোই কালোটাকার প্রধান উৎস, এটা মোটামুটি সবার জানা। জমিজমা, প্লট, অ্যাপার্টমেন্ট, বাড়ি, দোকানপাট ইত্যাদি বেচাকেনায় সঠিক দাম কখনও দেখানো হয় না সরকারের কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য। তাই কালোটাকা সৃষ্টি হওয়াটা এখানে লেনদেনের ভেতরকার সংস্কৃতি।

এসব চেনা পথের বাইরে এক ভয়ংকর উপদ্রব আর্থিক খাতে অনিয়ম আর দুর্নীতি। আর্থিক খাতে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রভাবই দুর্নীতির বড় কারণ। ব্যাংক কর্মকর্তারা না চাইলেও অনেক সময় অনিয়মের সঙ্গে আপোস করতে হয় রাজনৈতিক চাপের কারণে। ঋণ পাওয়ার যোগ্য না হলেও ঋণ দিতে হয় বাধ্য হয় ব্যাংক, বিশেষ করে সরকারি ব্যাংক।

সব সরকারের আমলেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে দলীয় লোকদেরকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বসানোর কারণে এ ব্যাংকগুলোতে সবসময়ই দুর্নীতির প্রকোপ থাকে বেশি। দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে আর্থিক খাতে সব ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেও অসহায় কোনও কোনও ক্ষেত্রে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অনিয়মে কিছুই করার থাকেনা বাংলাদেশ ব্যাংকের। সেখানে মূল আধিপত্য অর্থমন্ত্রণালয়ে ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের।

একজন সচিবের নেতৃত্বে এই বিভাগ হয়ে উঠেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন ও ব্যাংকিং জগতে সুশাসনের প্রধান অন্তরায়। বাজার বিবেচনায় কত বড় আমাদের আর্থিক খাত? অথচ ব্যাংকের সংখ্যা কেবল বাড়ছে। ব্যাংক মালিকানা কেনার যে হিড়িক পড়েছে, তার সঙ্গে আসলে মানি লন্ডারিং ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে ব্যাংক বর্তমানে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। পুরনো ব্যাংকের সঙ্গে আরো কিছু নতুন ব্যাংক যুক্ত হয়েছে গত কয়েক বছরে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অনিয়ম ও দুর্নীতির যেসব চিত্র উন্মোচিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে তাতে করে ব্যাংকগুলোতে আস্থার সংকট সৃষ্টি হতে পারে সহসাই, যা কেউ চায় না। ব্যাংকিং সেক্টরের বিভিন্ন নিয়মকানুন সঠিকভাবে পরিপালন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনগত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত জরুরি। আর এক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী মানুষেরা অন্তরায়।

আর্থিক খাত এখন যতটা না ‘ব্যবসাবান্ধব’, তার চেয়ে অনেক বেশি দলবান্ধব। আমরা বুঝতে পারছি অর্থনীতি ও প্রশাসনে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। আইন বন্দী হয়ে পড়েছে টাকার কাছে। আর্থিক খাতে যে কয়টি কেলেংকারির ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোকে বিশ্লেষণ করে নতুন করে এই জগতে সুশাসনের কথা চিন্তার সুযোগ এসেছে। রিজার্ভ চুরির ঘটনা কেবলই সাইবার নিরাপত্তার দৃষ্টিতে না দেখে দেখতে হবে পুরো জগতটিকে কি করে দুর্বৃত্তদের কবল থেকে বের করে আনা যায় সেই বিবেচনায়।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, সারাবাংলা ডট নেট, দৈনিক সারাবাংলা (প্রকাশিতব্য) ও গাজী টেলিভিশন (জিটিভি)।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন