ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

উন্নয়ন-উৎসব-উৎকণ্ঠা তবুও পুলকিত বাঙালি হৃদয়

ফারুক যোশী | প্রকাশিত: ১০:১৪ এএম, ০৬ এপ্রিল ২০১৮

 

গত মার্চ মাসটায় আমাদের অনেক দিবস ছিল। জাতীয়ভাবে উচ্চারিত এ মাসটা এমনিতেই বাঙালি জাতির একটা প্রধান চিহ্ন। ৭ ই মার্চ , ২৬ শে মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনের একটা অংশ। এ দিবসগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালি জাতির অধিকার আদায় আর সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান। স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপ দেয়ার রক্ত উন্মাতাল করা আহ্বান আসে এই মার্চ মাসেই।

খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই সারা বাংলাদেশ উৎসবে মেতে উঠে এই সার্বজনীন দুটো দিবস ঘিরে। এই মাসেই জন্ম নেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ১৭ মার্চ। এটা বাংলাদেশের শিশু দিবস হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে। কিন্তু না, এই মার্চে দিবস আছে অনেক। ডিজিটাল পৃথিবীর কল্যাণে সারা বাংলাদেশই দেখি আমরা প্রতিদিন। এই প্রতিদিনের বাংলাদেশে আমরা পাই উন্নয়নের ঢাকঢোল। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) দেয়া তথ্যে বাংলাদেশ পৌঁছে গেছে অনেকে অনেক উপরে।

এনইসি’র দেয়া তথ্যে যখন বাংলাদেশ একটা অভ্যন্তরীণ স্বীকৃতি পেলো, তখন মিছিলে মিছিলে সয়লাব হয়ে গেছে বাংলাদেশ। নিন্ম মধ্যম আয়ের তথা উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছতে আমাদের বাকি আছে এখনও ছয় বছর, তা-ও তারাই বলছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেয়া এ হিসাব যদিও জাতিসংঘ কিংবা বিশ্বব্যাংক মানছে না।

স্বাভাবিকভাবে এ নিয়ে বিতর্ক আছে। তবুও বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষের বার্ষিক মাথাপিছু রোজগারের খতিয়ান তারা দিয়ে দিচ্ছে। ১৬০২ ডলারের আয়ের হয়ে গেছে বাংলাদেশ। এ হিসাব নিয়েই নিয়েই জয়গান শুরু হয়েছে। যারা এ হিসেবে দিয়েছে, তারা জানে কত হাজার বাংলাদেশীদের কাছে কত মিলিয়ন টাকা আছে (ডলার বলাই বাঞ্ছনীয়)। তারা জানে বাংলাদেশের কোন্ ব্যবসায়ী পৃথিবীর সেরা ধনীদের একজন । তারা এও জানে এই বাংলাদেশ থেকে কিভাবে হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যায়। খোদ আমেরিকা থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায়ই এ টাকাগুলো বেরিয়ে গেছে। দুর্নীতির সূচকও তাদের চেয়ে আর হয়ত বেশি কেউ জানে না। একটা উন্নয়নশীল দেশে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাটা এতই নড়বড়ে যে, হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে যায়, অথচ রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে যেন গড়িমসি করে ।

উন্নয়শীল দেশ হবার একটা পূর্বশর্ত হল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধির ব্যাপারটা। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন। সকল মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা সর্বোপরি দেশে নিরাপত্তার ব্যাপারটাতো আছেই। আমরা যদি চোখ রাখি, বাংলাদেশের মানচিত্রে। রাজধানী থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপকতা যেভাবে গ্রাস করছে সারা দেশটাকে তা এখন আর ভাবনার কোন ব্যাপার নয়। একটা বেকার গোষ্ঠি গড়ে উঠেছে, যারা পেশায় রাজনীতিবিদ, তাদের বাড়ি-গাড়ি দেখলে মনে হয় কাজ থেকে বেকারত্বটাই ভালো, নেতার সাথে সেলফিই উত্তম।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে আমাদের গড় আয় ১২০০ ডলারের উপরে উঠে গেছে। গড় আয়টা বাংলাদেশের হাজার হাজার মিলিয়নারদের অর্থের সাথেই সম্পর্কিত। এদের এক একজনের অর্থ মিলিয়ে নিলে হয়ত কয়েক কোটি মানুষের জাতিসংঘের নির্ধারিত গড় আয়ের সমান হয়ে গেছে। জাতিসংঘও সে হিসাব নিশ্চয়ই রাখে। নিন্ম আয় আর মাথা গোজার ঠাঁই নেই বস্তিবাসীর সংখ্যা কি তারা জানে না, জানে না কি বাংলাদেশের মানুষ কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। তবুও তাদের হিসেবে, এই বস্তির ছেলেটা যে কাগজ কুড়োয় কিংবা চায়ের দোকানে ভোর থেকে শুরু করে মধ্যরাত পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে পায়ে খোলস তোলে, তাদের আয়টাও ১২০০ ডলারের উপরে উঠে গেছে।

২) ৩১ মার্চ ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠে প্রথম আমার এলাকার একটা সংবাদ দিয়ে শুরু হলো দিন। বিউটি ধর্ষণ-হত্যা মামলার প্রধান আসামি ধরা পড়েছে আমাদের এলাকা বিয়ানীবাজার থেকে। স্বাভাবিকভাবেই একটা ধাক্কা লেগেছে। হবিগঞ্জ থেকে বিয়ানীবাজার- বিস্তৃত তাদের হাত। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে লুকিয়ে থাকার জায়গা সে পেয়েছে আমাদের এলাকায়ই।নিন্ম মধ্য আয়ের দেশে পৌঁছিয়ে দেয়া সংস্থা কি জানে না, হবিগঞ্জের বিউটির মতো অসংখ্য ধর্ষণের ’মহাঅপরাধে’র ঘটনাগুলো।

এই কর্পোরেট সমাজ বিউটিদের নিউজের শিরোনাম করতে দেয় না। রেইন ট্রি ধর্ষণ যেন একটা শৈল্পিক প্রচারণা পেয়েছিল, কারণ দ্বন্দ্বটা ছিল রাজায় রাজায়। অথচ বিউটিকে অপহরণ করা হয়েছে, দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হয়েছে। গরীব শ্রমিক বাপ এধার থেকে ওধারে ঘুরেছেন, আহারে রাষ্ট্র! অবশেষে হাওরের ঘাসে নিথর পড়ে থাকে বিউটি, পড়ে থাকে ‘দুর্বৃত্তায়নের বিউটি’ হয়ে। একজন শ্রমিকের মেয়ের নিরাপত্তা দিতে পারে নি রাষ্ট্র। মাসদিন নিঁখোজ থাকার পরও মেয়েটাকে উদ্ধার করতে পারে না যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, যে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কর্মীরা উদ্ধার করতে পারলো না বিউটিকে, বাঁচাতে পারলো না বিউটিকে, সেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কর্মীরা ঠিকই বাবুলকে ধরতে পারে বিয়ানীবাজারে গিয়ে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার সদিচ্ছার ছবি হলো বাবুল মিয়াকে আটক করা। কিন্তু একটা মেয়েকে বাঁচাতে সে সদিচ্ছাটা ছিলো কোথায়?

এখন বিচার ব্যবস্থার দিকে তাকিয়ে দেখার পালা। আসলে যে দেশে নেতার সাথে সেলফি তোলা সমৃদ্ধি অর্জনের সিঁড়ি হয়, জনবিচ্ছিন্ন অসংখ্য নেতাদের যারা মতো পাহারা দেয়, শৃগালের মতো অকারণে হুক্কা হুয়া করে কিংবা খাবলে খেতে চায় প্রতিবাদী মানুষের শরীর, সেখানে জনপ্রতিনিধির ছেলে বাবুল বিউটিকেতো অপহরণ করবেই দিনের পর দিন কোথাও না কোথাও রাখবেই, ধর্ষণ করবেই। নিরাপত্তা কর্মীরা সেখানে পা মাড়াবে সে সাধ্যটা কিভাবে হয় ? উন্নয়নের ডামাডোলের সাথে বিউটিদের লাশ বড়ই বেমানান, বড় বেশি অমানবিক।

৩) দেশ আর জাতির এই উন্নয়নের ঢাকডোলের মাঝেই অভিবাসী মানুষ জেগে উঠেছে পৃথিবীর দেশে দেশে। ক্ষমতার অংশীদার মানুষগুলোও সবকিছু পেছনে ঠেলে ঢোল পেটাচ্ছে সারা পৃথিবীতে। উৎসব উৎসব ভাব আছে বিদেশি মিশনগুলোতে। বাংলাদেশের জাগরণে একজন বাঙালি হিসেবে আমরাও পুলকিত হই।

যখন বৈশাখী আনন্দ নিয়ে আমরা এখানে উৎসবে মেতে উঠি, স্বতস্ফূর্ত এক শিকড় খোঁজা থাকে আমাদের। আমাদের সামনে ভেসে ওঠে টুকরো টুকরো গ্রাম, বহমান নদী, সবুজ প্রান্তর, সব মিলিয়ে একটা আবহমান বাংলাদেশ। আর সেকারণে যখন এমনকি ক্ষমতার অংশীদার মানুষগুলোও তাদের উন্নয়ন নিয়ে মাতোয়ারা হয় কিংবা মিশনগুলো উপরের নির্দেশে বিশাল বাজেটের উৎসবে মেতে উঠে, তখন তাদের আহ্বানে আমরাও অংশ নেই মাঝে মাঝে। কিন্তু প্রতিবারই যেন হোঁচট খেতে হয়। সেই একই মুখ দেখি। বার বার ফিরে আসে একই চেহারা। গতানুগতিক উচ্চারণ।

আগে বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন বাংলা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা ম্যানচেস্টার সহকারী হাইকমিশনে উপস্থিত হতো, এবারে সেসুযোগ হয়নি। অভিযোগ করেছেন দুটো বাংলা স্কুলের প্রধানরা। স্বাভাবিকভাবেই হয়ে উঠেনি এটা সার্বজনীন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস নিয়ে প্রতিবছর একটা অনুষ্ঠান হয় পৃথিবীর বিভিন্ন বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোতে। বাংলাদেশের ইতিহাস আর এগিয়ে চলাকে ফোকাস করা হয় এসব অনুষ্ঠানে। সেজন্যে ম্যানচেস্টারের এ অনুষ্ঠানটায় প্রায় প্রতিবারই যাই। গোছালো একটা অনুষ্ঠান ছিলো গত ২৮ মার্চ সন্ধ্যায়, একটা বিলাসবহুল রেস্তোরাঁয়। কিছু নির্ধারিত অতিথি ছিলেন।

ব্রিটেনে বিদেশের বিভিন্ন দূতাবাসের প্রতিনিধিবর্গ, বিভিন্ন কাউন্সিলের লর্ড মেয়র, মেয়র, পুলিশের প্রধান,কাউন্সিলারসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানুষের উপস্থিতি ছিলো এ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটা ভালো লাগে এজন্যে যে, বাংলাদেশ নিয়ে কিছু তথ্যবহুল উচ্চারণ থাকে এখানে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের দিকে এগিয়ে যাবার শ্লোগানটি উচ্চারিত হয়েছে এবারে ভালোভাবেই, বিদেশি অতিথিদের সামনে। প্রতিবার দেখা মুখগুলো ভালো লেগেছে আর ভালো লেগেছে গতানুগতিক উচ্চারণ শুনিনি সেজন্যে। কারণ এখানে সহকারী হাইকমিশনার ছাড়া কারো বক্তব্য দেবার সুযোগটুকু রাখা হয় না।

৪) উন্নয়নে গতি এসেছে এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্যে বিশাল বাজেট বরাদ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায়। আগে বৈদেশিক সহায়তাই ছিল আমাদের একটা প্রধান মাধ্যম, এখন সেখানে এগিয়ে এসেছে প্রবাসীদের রেমিটেন্স প্রবাহ। কৃষিতেও উৎপাদন বেড়েছে। ক্ষুদ্র পুঁজিরও প্রসার ঘটেছে। কিন্তু সব উন্নয়নই ফুটো হয়ে যায়, যখন ক্ষমতার অংশীদাররা দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নে জনগণের বিপরীতে দাঁড়ায়। উন্নয়নের শ্লোগান তখন বড়ই বেমানান লাগে যখন বিউটিরা হাওরে পড়ে থাকে নিষ্প্রাণ, কিংবা ঝোপঝাড়ে খোঁজে নিতে হয় তনুদের লাশ। পুরুষ-শৃগালের খাবলে খাওয়া শরীর। উন্নয়নের শ্লোগান সেখানেই ম্লান হয় যখন অভিযোগের আঙ্গুল ওঠে দেশ এবং জাতির অতন্দ্র প্রহরীর দিকে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন