ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

উন্নয়ন অস্বীকারও একটি অনিরাময়যোগ্য রোগ

মাসুদা ভাট্টি | প্রকাশিত: ১২:৪৬ পিএম, ০৪ এপ্রিল ২০১৮

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে- বাক্যটি বহুল ব্যবহৃত কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। যদিও এই সত্য নিয়ে আজকাল তামাশা করার চেষ্টা করছেন অনেকেই। যারা দেশের এই অগ্রগতি নিয়ে তামাশা করেন তারা নানা ভাবে বিভক্ত। প্রথমতঃ যারা দেশের উন্নয়নকে একেবারেই দেখতে পারেন না তারা মূলতঃ কাজটি করেন ঈর্ষা থেকে। এই ঈর্ষা রাজনৈতিক, অ-রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত সকল ক্ষেত্রেই লক্ষ্যণীয়।

রাজনৈতিক ভাবে যারা এখন ক্ষমতার বাইরে রয়েছেন তারা ভাবছেন যে, তারা ক্ষমতায় থাকলে হয়তো এর চেয়ে অনেক বেশি উন্নয়ন করতে পারতেন। কিন্তু তারা যখন ক্ষমতায় ছিলেন তাদের পক্ষে এখন যতোটুকু যা হচ্ছে তার সিকিভাগও করা সম্ভব হয়নি। বৈশ্বিক সূচকগুলো বলছে যে, গত দশ বছরে বাংলাদেশ এক লাফে তিন ধাপ জিডিপি প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে। অনেকেই আবার জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে উন্নয়ন বলে মানতে নারাজ। তারা বলতে চান যে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি নাকি একই রাস্তাকে কয়েকবার করে ভাঙলে-গড়লেও ঘটে থাকে। খোঁড়া যুক্তি সন্দেহ নেই, কিন্তু তাদের কথাও মানতে হবে কারণ উন্নয়নকে সকলের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলাও উন্নয়ন-সক্ষমতার বৈশিষ্ট্য বটে।

অ-রাজনৈতিক যারা মনে করছেন যে, দেশের কোনো উন্নয়ন ঘটেনি তারাও এক ধরনের রাজনৈতিক অন্ধত্বের জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে উন্নয়নকে দেখার চেষ্টা করেন। উদাহরণ দিচ্ছি। একটি টক শো’য় একজন বক্তা অনেকক্ষণ ধরে দেশে উন্নয়নের জন্য যে ভয়ঙ্কর পরিমাণ খরচ হচ্ছে তার ফিরিস্তি দিয়ে এক সময় বলতে শুরু করলেন যে, পদ্মা সেতু করতে দেশের যে অর্থ খরচ হচ্ছে তাতে পদ্মা সেতু করার কোনো দরকার নেই। অন্য বক্তা এই বক্তব্যের কী উত্তর দেবেন তা ভেবেই পেলেন না। তিনি বললেন যে, আপনি যদি একবার পদ্মাপাড়ে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ আঁটকে থেকে তারপর ফেরিতে উঠতে পেরে সেখানে দাঁড়িয়ে এই তত্ত্ব দেন তাহলে আপনার অবস্থাটা সাধারণ মানুষ কী করবে সেটা ভেবে সিউরে উঠছি।

আর তাহলে পদ্মা সেতু না করে সেই টাকাটা আপনি কী কাজে ব্যয় করতে চান সেটা একবার যদি বলতেন? পদ্মা সেতু বিষয়ক বক্তা এসবের কোনো উত্তর না দিয়ে কথা নিয়ে গেলেন বাংলাদেশে এক কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করতে কেন ভারতের তুলনায় বেশি খরচ হয় সে প্রশ্নে। এবারও অন্য বক্তা বলতে শুরু করলেন যে, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ ঘনবসতির দেশ, এদেশে জমি অধিগ্রহণ একটি বিশাল সমস্যার ব্যাপার, তাছাড়া এদেশে রাস্তা করার কাজে ব্যবহৃত কাঁচামালের কোনোটিই প্রাকৃতিক ভাবে কিংবা উৎপাদন করা এখনও পর্যন্ত সম্ভব নয়, বিদেশ থেকে আনতে হয় বলে খরচ অনেকটাই বেশি হয়।

এরপরও টক শো’র বক্তা এসব দিকে না গিয়ে নতুন সমস্যার কথা বলবেন। আপনি যাই-ই বলবেন, উন্নয়ন বিষয়ে তাদের পাল্টা বক্তব্য থাকবেই এবং থাকেও। ফলে, আপনি কোনো ভাবেই প্রমাণ করতে পারবেন না যে, দেশের কোনো ধরনের উন্নয়ন ঘটেছে। তারা বলতে শুরু করবে যে, হ্যাঁ, উন্নয়ন ঘটেছে তাদেরই যারা সরকার-ঘনিষ্ঠ। মজার ব্যাপার হলো, সরকার-ঘনিষ্ঠ না হয়েও তারা দশ বছর আগের তুলনায় এখন নিজেদের অবস্থান আরো সুসংহত করেছেন কেবল দেশের সার্বিক অগ্রগতির কারণেই।

দেশের সর্বত্রই ব্যক্তিক্ষেত্রে এই উন্নতি চোখে পড়ে এবং সাধারণ মানুষ সেকথা স্বীকারও করছে। তার চেয়েও বড় কথা হলো, রাজনৈতিক ভাবে বিরোধী দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আন্দোলন করেই তেমন একটা সুফল পাচ্ছে না কারণ সাধারণ মানুষকে তারা কোনো ভাবেই মাঠে নামাতে পারছে না। সাধারণ মানুষ ধরেই নিয়েছে যে, এই মুহূর্তে দেশের কাছ থেকে যা পাওয়া যাচ্ছে তা হারানোটা ঠিক হবে না। ভবিষ্যতে বিকল্প কোনো রাজনৈতিক দলের ওপর তাদের নির্ভরশীলতাও ঠিক তৈরি হচ্ছে বলে টের পাওয়া যাচ্ছে না।

অপরদিকে কিছু ব্যক্তি যারা দেশের কোনো ভালোকেই ভালো মনে করেন না, তারাও মূলতঃ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখে থাকেন যে, দেশে কোনো ধরনের উন্নয়ন হয়নি। যা হয়েছে সবই কেবল লুটপাট এবং চুরি-ডাকাতি। প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে যে, তাহলে দৃশ্যমান যে সকল উন্নয়ন আমরা দেখতে পাই, সেগুলো তবে কি? প্রশ্নকারীর প্রশ্নের মুখে উত্তরদারা কোনো রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই বলে দেন যে, এতে সরকারের কোনোই কৃতিত্ব নেই। তাহলে নতুন প্রশ্ন আসে যে, এতোদিন তবে হলো না কেন এরকম কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন? এক্ষেত্রে হয় উত্তরদাতা রেগে যাবেন না হয় আপনাকে কটূবাক্যে জর্জরিত করবেন, যার প্রথম ও প্রধানটিই হবে যে, হয় আপনি সরকারের দালাল না হয় আপনি নিশ্চিত ভাবেই সরকারের কাছ থেকে কোনো সুবিধা লাভ করেছেন।

তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, দেশের এই উন্নয়ন-সাফল্য নিয়েও বরাবরের মতো বাংলাদেশ বহুধা বিভক্ত। দেশের কোনো অর্জনই সকলে মিলে আমরা উদযাপন করতে পারছিনে বা বলা ভালো যে, উদযাপন করতে দেয়া হচ্ছে না। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়শীল দেশে প্রবেশের যে সূচনা বাংলাদেশ করেছে তাতে দল-মত নির্বিশেষে আনন্দিত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু সেটাও সম্ভব হয়নি কারণ একপক্ষ এটা প্রমাণ করতেই উঠেপড়ে লেগেছে যে, এই উন্নয়ন আসলে কিছু নয়, দেশ এখনও যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়েছে। সত্যকে অস্বীকার করা এক ধরনের রোগ এবং সে রোগের নিরাময় নেই। ফলে আমরা এধরনের উন্নয়ন অস্বীকারকারী রোগীদের আরো অনেকদিন দেখতে পাবো বলেই বিশ্বাস করি।

কিন্তু উন্নয়নকে অস্বীকার করা এক ব্যাপার আর প্রকৃত উন্নয়নকে নিয়ে তামাশা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। এর সঙ্গে জড়ানো যায় কথায় কথায় উন্নয়নের দোহাই দিয়ে যে কোনো অন্যায়কে বৈধ করার চেষ্টাকে তাহলে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় পরিস্থিতি আসলে বেশ ঘোলাটে হয়েই ওঠে। কারণ, যে পক্ষ উন্নয়নকে অস্বীকার করছে তারা ধরে নিচ্ছি ‘চোরের সঙ্গে রাগ করে মাটিতে ভাত খেতেও রাজি’। কিন্তু যারা বিশেষ করে সরকারি দলের নেতাকর্মীসমর্থকগণ যখন তাদের যে কোনো অন্যায়কেও উন্নয়ন দিয়ে বৈধ করতে চান তখন সেটা জনগণের জীবনের ওপর বিশাল ও অমোচনীয় চাপ হয়ে ওঠে। মানুষ তখন উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সুশাসনের অভাব যেমন ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম, শেয়ার বাজারে কেলেঙ্কারীসহ এমপি-মন্ত্রীদের যে কোনো অনিয়মকে জড়িয়ে তার জন্য গোটা সরকার ব্যবস্থাকে দায়ী করতে শুরু করে এবং সেক্ষেত্রে তার কাছে উন্নয়ন ততোটা অর্থবহ হয় না।

মানুষ নিশ্চিত ভাবেই তখন হিসাব মেলাতে শুরু করে যে, উন্নয়নের বিনিময়ে তিনি কি কি হারাচ্ছেন এবং যখন সে হিসেবে বড় ধরনের গড়মিল দেখা যায় তখনই তারা বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে সরকারের প্রতি এবং উন্নয়নের প্রতিও। পরিস্থিতি সে দিকে টেনে নেওয়ার জন্য চেষ্টা চলছে অবধারিত ভাবেই, এবং যেসকল রাজনৈতিক, অ-রাজনৈতিক পক্ষ দেশের কোনো উন্নয়নই দেখতে পান না তারা এখন কোমড় বেঁধে সরকার আর জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে চাইছে, আর মাঝখানে তারা নিয়ে আসতে চাইছেন উন্নয়নকে, যা সম্পূর্ণ ভাবে ষড়যন্ত্রমূলক কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণতা। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গে’র মতো প্রবাদবাক্য এদের জন্য সম্পূর্ণ ভাবে প্রযোজ্য বটে।

মজার ব্যাপার হলো, বিদেশে লেখাপড়া করা বিজ্ঞ ব্যক্তিরা পর্যন্ত এদেশে উন্নয়নতো দেখতেই পান না, বরং বলতে থাকেন যে, একই সঙ্গে কী করে উন্নয়ন ও দুর্নীতি বাড়ে কিংবা গোটা উন্নয়নটাই একটা ধাপ্পাবাজি ছাড়া কিছু নয়। তারা একবারও এ প্রশ্নটি করেন না যে, বাংলাদেশে গত দশ বছরেই ধারাবাহিক ভাবে দুর্নীতির সূচকে নিচের দিকে নেমেছে, অর্থাৎ দুর্নীতি কমেছে এবং তার প্রভাবটি উন্নয়নের ওপর স্বাভাবিক ভাবেই পড়েছে।

আরো মজার ব্যাপার হলো, এমনিতে এসব জ্ঞানীজনেরা বিদেশি সংস্থার সূচককে খুউব মূল্য দিয়ে থাকেন, যদিও অর্থনৈতিক অগ্রগতির যে কোনো সূচকেই যে বাংলাদেশ এগিয়েছে সেটাকে তারা তাদের আলোচনায় আনেন না কিন্তু একটি অখ্যাত ও অজ্ঞাত জার্মান সংস্থার করা গবেষণায় বাংলাদেশকে ‘নয়া-স্বৈরাচারের দেশ’ হিসেবে প্রমাণ করার বৃথা চেষ্টাকে তারা বেশ আনন্দ নিয়ে উল্লেখ করে থাকেন।

হয় তারা স্বৈরাচারী শাসন কাকে বলে সেটা জানেন না, নয় তারা ইচ্ছে করেই স্বৈরাচার বা গণতন্ত্রহীনতার মতো শব্দবন্ধকেই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যবহার করায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন কারণ তারা আসলে এইসব নেতিবাচক শব্দবন্ধের ‘প্রোডাক্ট’। যে কোনো পথচলতি ব্যক্তিকে থামিয়ে যদি প্রশ্ন করা হয় যে, “দশ বছর আগেকার আপনার জীবন আর এখনকার জীবন কি এক?” তিনি নিঃসন্দেহে বলবেন যে, না তার জীবন বদলেছে। সময়ের স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষের জীবন বদলায়, কিন্তু সেই বদলে সরকার বা রাষ্ট্রের একটি প্রকট বা প্রচ্ছন্ন হাত থাকে।

একজন চলিশশোর্ধ্ব বা ত্রিশোর্ধ্ব ব্যক্তির জীবনে সরকার বা রাষ্ট্রের প্রভাব নিয়ে যদি প্রশ্ন করা যায় তাহলে নিশ্চিত ভাবেই জানা যাবে যে, দশ বছর আগেকার সরকার বা রাষ্ট্রের চেয়ে গত দশ বছরের সরকার বা রাষ্ট্রের প্রভাবে তার জীবনে যে পরিবর্তনটি ঘটেছে তা সত্যিকার অর্থেই ইতিবাচক। খুউব মাইক্রো উদাহরণ হিসেবে ব্যক্তির জীবনকে দেখলে, ম্যাক্রো উদাহরণ হিসেবে দেশের অবকাঠামো বা বিদ্যুৎখাতের দিকে নজর দেবার আহ্বান জানাবো। তাতেও যদি কেউ পরিবর্তন না দেখেন তাহলে নিশ্চিত ভাবেই তাকে অন্ধ বলতে হবে, যদিও তার দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিকই। দুঃখজনক সত্য হলো, সরকারের বহুবিধ ত্রুটির কারণে এই উন্নয়ন না-দেখা রোগীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বৈ কমছে না।

ঢাকা ৩ এপ্রিল, মঙ্গলবার ২০১৮

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন