পূর্ণিমা, আপনি ধর্ষণকে উস্কে দিচ্ছেন!
যার যে যোগ্যতা নেই, তা না করাই ভালো। আমরা অনেকেই মনে করি, উপস্থাপনা খুব সহজ। কেবল দেখতে সুন্দর হলেই হলো। মেকআপ নিয়ে, সাজগোজ করে স্টুডিওতে এসে বসলেই হলো, না প্রয়োজন আছে লেখাপড়ার, না প্রস্তুতির।
সিনেমার নায়িকা পূর্ণিমাকে দেখে আমার অন্তত তাই মনে হয়েছে। পূর্ণিমার ‘এবং পূর্ণিমা’ সেলিব্রেটি শো’র উপস্থাপনা দেখে তা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। পূর্ণিমা আগেও উপস্থাপনা করেছেন। মেরিল- প্রথম আলো’র অনুষ্ঠানে তাকে চমৎকার লেগেছে, স্বীকার করছি। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখবেন, সেখানে উপস্থাপনার চেয়ে বেশি ছিল অভিনয়।
উপস্থাপনা আর অভিনয় এক নয়। উপস্থাপনা অন্য বিষয়। আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ, আনিসুল হক বা আব্দুন নূর তুষারের কথা ভাবুন। রুবানা হকের কাছেই শুনেছি, আনিসুল হক একটি অনুষ্ঠানে কি বলবেন, কীভাবে বলবেন তা নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা আর ভাবনার জালে নিজেই জড়িয়ে যেতেন। আর আব্দুন নূর তুষার’কে তো খুব কাছ থেকে দেখা। প্রায় এমন কোন বিষয় নেই, যা তুষার জানেন না বা তার জানা নেই।
বলতে বাধ্য হচ্ছি, এখনকার বেশিরভাগ চ্যানেলই কপি প্রোগ্রাম নির্মাণ করে। ‘কফি উইথ করণ’ বা ‘এবং ঋতুপর্ণ’ কপি করলেই যে ‘করণ জোহর’ বা ‘ঋতুপর্ণ ঘোষ’ হওয়া যায় না, সেটা চ্যানেলগুলো বুঝতে অনেকটাই অপারগ। তা বুঝবার মতো মেধা যোগ্যতা বেশিরভাগ চ্যানেলেরই নেই।
যে কোনো বিষয়েই আলাপ হতে পারে। প্রেম, যৌনতা, পরকীয়া, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ- যে কোনো বিষয়। কিন্তু সেই বিষয়গুলো নিয়ে শালীনভাবে কথা বলতে হলে তো লেখাপড়া থাকতে হবে। তবেই না আলাপ হবে, আলোচনা জমবে।
সিনেমার নায়িকা হওয়া আর ভালো উপস্থাপনা এক বিষয় নয়। এখানে সিনেমার নায়িকা হতে খুব বেশি মেধা যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। অভিনেত্রী হবার চেয়ে ‘সুন্দরী’ হওয়াটা এখানে অভিনয়ের বড় যোগ্যতা। কেবল একটি ‘পোশাকী’ নাম রাখলেই হলো। আর যদি ‘খোলামেলা’ হবার যোগ্যতা থাকে তবে তো ‘সোনায় সোহাগা’। মিডিয়াও তখন তাকে ‘সাহসী’ অভিধায় ভূষিত করতে অস্থির থাকে যারপরনাই।
বলতে আরও বাধ্য হচ্ছি, এখানে খুব কম নায়িকাদেরই লেখাপড়া আছে বা তারা মনেও করেন লেখাপড়ার আদৌ কোন প্রয়োজন নেই। তারা জ্ঞান মেধার চর্চা, লেখাপড়াকে অপব্যয় মনে করেন। তার চেয়ে বরং অনেক বেশি পার্টিতে, ডিস্কোতে, হ্যাং-আউটে ব্যস্ত থাকতে ভালবাসেন তারা।
পূর্ণিমাকে আমি দোষ দিচ্ছি না। বরং তার জন্য আমার মায়া হচ্ছে, করুণা হচ্ছে। দেখতে ভালো অথচ মেধাশূন্য হলে একজন মানুষের যা হয়, পূর্ণিমারও তাই। পূর্ণিমা তার মেধা অনুযায়ী প্রশ্ন করেছেন। জানতে চেয়েছেন মিশা সওদাগরের কাছে, কার কার সাথে ধর্ষণ সিন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
শুধু তাই নয়, এ পর্যন্ত সিনেমায় কতগুলো ধর্ষণ করেছেন, আরও ধর্ষণ করতে চান কি-না এ জাতীয় কুরুচিপূর্ণ, যৌন সুরসুরি দেওয়া রীতিমতো অশ্লীল সব প্রশ্ন। মিশা সওদাগর বরং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে উত্তর দিয়েছেন। বলেছেন, মৌসুমী যেহেতু ভালো বন্ধু সে অভিনয়ের ব্যাপারে সহযোগিতাপ্রবণ। আমি এতটুকুও অবাক হতাম না, বিস্মিত হতাম না, পূর্ণিমা যদি মিশার কাছে জানতে চাইতেন, কতক্ষণ সময় ধরে ধর্ষণ করতে আপনার ভালো লাগবে বা এ জাতীয় কোন প্রশ্ন করতেন।
ধর্ষণ নারীর জীবনে কত ভয়াবহ প্রভাব রেখে যায় তা কেবল ধর্ষিতাই জানেন। ধর্ষণ কোন ফান ফ্যান্টাসির বিষয় নয়। রস তামাশার বিষয় নয়। গণমাধ্যম কখনও কখনও ধর্ষণকে আরও রগরগে, উত্তেজক করে তোলে ‘রাতভর’, ‘পালাক্রমে’, ‘উপর্যুপরি’ এসব শব্দের মধ্য দিয়ে। করে পুরুষতান্ত্রিকতার কারণে, বাণিজ্যিক স্বার্থে।
পূর্ণিমাও তাই করেছেন।‘কার কার সঙ্গে ধর্ষণ সিনে স্বাচ্ছন্দ্য’ এমন প্রশ্নের মধ্যদিয়ে ধর্ষণকে ‘রোমান্টিসাইজ’ করেছেন। এতে যে কারো কারো মধ্যে ধর্ষণ প্রবণতা বা ফ্যান্টাসাইজ হয়ে ধর্ষণ করবার ইচ্ছে জাগতে পারে, তা ভাববার প্রয়োজনবোধ করেননি। আসলে পূর্ণিমার সেই বোধটুকুও নেই।
এদেশের কতশত মেয়ে নির্যাতিত, নিপীড়িত, যৌন হয়রানি, ধর্ষণের শিকার, তারা তা বলতেও পারে না, সামাজিকতার ভয়ে। কেউ কেউ বিচার চাইতে গিয়ে আবারও ধর্ষিত হন, খুন হন। কারও কারও বাকি জীবন কাটে ধর্ষণের দুঃসহ স্মৃতিযন্ত্রণা নিয়ে।
আর পূর্ণিমা, আপনার কাছে ধর্ষণ নেহাত বিনোদন, তামাশা, ছেলেখেলা!
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/পিআর