ধর্ষিত বিউটি আমার বোন, আমি বিচার চাইছি
বিউটি ধর্ষিত হয়েছে। শুধু ধর্ষিত হয়নি, ধর্ষণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। বিউটি ধর্ষিত হলো কী তাকে হত্যা করা হলো, তাতে কোন যায় আসে না আমাদের। আমাদেরও যেত আসতো, যদি বিউটি হাওরের দরিদ্র দিন মজুরের মেয়ে না হয়ে শহুরে কেউ হতো, ধনাঢ্য কারো কেউ হতো। আমরা মানববন্ধন করতাম, মিছিল করতাম। টক শোতে কথা বলতাম, প্রতিবাদ করতাম। তথাকথিত প্রগতিশীলেরা ‘স্বাক্ষর’ সংগ্রহ অভিযান করতাম। কেউ কেউ ব্যানার আর প্ল্যাকার্ড নিয়ে শাহবাগে দাঁড়াতাম, ধর্ষণের প্রতিবাদে।
অমন কিছুই ঘটেনি বিউটির ক্ষেত্রে, ঘটবেও না। মূলধারার গণমাধ্যম, আমরাও পাশ কাটিয়ে গেয়েছি খবরটি প্রকাশ করতে, প্রচার করতে। কেউ আমরা একটিবার ঘটনাটির খবর বা নেপথ্যে জানাবার চেষ্টাও করিনি। কেউ কেউ ভেবেছে ‘বিউটি’ একটি বিরোধীদলীয় প্রপাগান্ডা। এতে বিরোধী রাজনীতি রয়েছে। কেউ ভেবেছে এত উন্নয়নের খবরের মাঝে বিউটি একটা ‘উপদ্রব’। বিউটিকে নিয়ে কিছু না বলাই ভালো। বিউটিকে নিয়ে কথা বলে আবার না সরকার সমর্থকদের রোষাণলে পড়তে হয়।
গণমাধ্যমে নিজেকে যতটা গণমানুষের বলে মুখে দাবি করে, বাস্তবে তা কখনোই নয়। এখনও পর্যন্ত খবরের কাগজের প্রধান শিরোনাম বড় দুই রাজনৈতিক দলের বাইরে নয়। এখনও প্রভাবশালী, প্রতাপশালী মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ীরাই আমাদের প্রধান খবর। বনানী ধর্ষণ আমাদের কাছে যতটা গুরুত্ব বহন করে, বরিশাল বা বদরগঞ্জের ধর্ষণের গুরুত্ব এতটা নয়। বনানীর খবর যায় ফ্রন্ট বা ব্যাক পেজে, ছ’কলাম, চার কলাম। অন্য ধর্ষণের খবরগুলো যায় গ্রাম বাংলা, মফস্বলের পাতায়।
আমরা নারীর উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন এসব বলে বলে যখন মুখে ফেনা তুলছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জয়বাংলার চেতনায় স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য যখন বাতি জ্বালছি। ঠিক তার পূর্বে মুহূর্তে, বাতির নিচে অন্ধকার। বিউটি পড়ে আছে। বিউটির লাশ পড়ে আছে। হাওরের মাঠে পড়ে আছে ধর্ষিত, মৃত বিউটি।
বিউটি শায়েস্তাগঞ্জের দিনমুজর সায়েদ আলীর মেয়ে। মাত্র ১৬ বছরের কিশোরী। দুর্বৃত্ত বাবুল ও তার লোকেরা বিউটিকে ধরে নিয়ে যায়। মাস খানেক আটকে রাখে। আটকে রেখে চলে নিয়মিত নির্যাতন। দরিদ্র বাবা সায়েদ আলী ছোটেন এখানে সেখানে। মেয়ের সম্ভ্রম বাঁচাতে যায় কতজনের কাছে! পরে মামলাও করে।
বিউটি পালিয়ে আসে ধর্ষকদের হাত থেকে। তবুও মুক্তি নেই। বিউটি ভেবেছিল, ধর্ষকের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে, পালিয়ে এসে। কিন্তু না, ধর্ষক বাবুল আবারও তাকে তুলে নিয়ে যায়। এবার আর শুধু ধর্ষণ নয়। ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে মামলার কারণে ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করা হয়। কী বীভৎস! কী ভয়াবহ!
ধর্ষণ যে কতটা ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলে যায় নারীর মন ও শরীরে, তা কেবল ধর্ষিতা মাত্রই জানে। ধর্ষিত হচ্ছে নারীরা, একের পর এক। আমরা দর্শক, নির্বিকার। ধর্ষণ হচ্ছে নির্বিবাদে, নির্বিচারে। গোটা বাংলাদেশ হয়ে উঠছে ধর্ষকের অভয়ারণ্য।
ধর্ষণ আরও হবে। আরও বাড়বে। আরও মহামারীর আকার ধারণ করবে। ধর্ষণ হবে বাসে, ক্লাসে, অফিসে, বাড়িতে, রেস্তোরাঁয়, মার্কেটে- সর্বত্র। এখানে ধর্ষকেরা ধর্ষণের পর খুন করে যায়, যাতে ধর্ষিতা ধর্ষণের ঘটনাটি আর কাউকে না বলতে পারে। আর কেউ কেউ ধর্ষণের বীভৎস অভিজ্ঞতা নিয়ে না মরে বেঁচে থাকে। আমরা কোন ধর্ষণেরই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারিনি, দেইনি। আমরা পশুগুলোকে ‘পুরুষ’ থেকে মানুষ করতে পারিনি। নারীমাত্রই ‘যৌনবস্তু’ এর বাইরে চিন্তা করতে শেখাইনি।
আমরা শহরে বসে, বহুতল ফ্ল্যাটে বসে ভাবছি নিরাপদে আছি। অন্যের মেয়ে, বোন, বউ ধর্ষিত হয়েছে, তাতে আমার কী? শুধু পুরুষ কেন, স্লিভলেন্স পরা, মুখে চড়া মেকআপ দেয়া কথিত নারীবাদীদেরও প্রতিবাদ দেখিনি। দেখব কেন? বিউটি তো গুলশান, বারিধারা, বনানী থাকত না, সে কারো কেউ না। কোন মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ী নেতার কারো কোন সুতোয় আত্মীয়ও না।
বিউটি আমার বোন। বিউটিরা আমার বোন। প্রতিটি ধর্ষিত মেয়ে আমার বোন। আমি বিউটির মতো, বিউটিদের মতো আমার ধর্ষিত বোনদের ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চাইছি।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/এমএস