আর নয় ব্যথাভারাতুর সহমর্মিতা
সবুজ ঘাসে লাল কাপড়ে পড়ে আছে বিউটি। কিন্তু এটি বাংলাদেশের পতাকা নয়, কিন্তু এই দৃশ্যই যেন হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের মানচিত্র। দুই মাস আগে তাকে প্রথম ধর্ষণ করেছিলো কতগুলো পুরুষ, যাদের বিরুদ্ধে সে মামলাও করেছিলো। কিন্তু পুলিশ সেই আসামীদের গ্রেফতার করেনি, কারণ গ্রাম শালিসের লোকজন বলেছিলো তারা নাকি বিচার করবে।
বিচার তারা করেছে, তা হলো, মেয়েটিকে আবার ধর্ষণ করে হত্যা। সামাজিক মাধ্যমে ঘুরছে সেই ছবি। কিন্তু এটিই শেষ না। অসংখ্য সব ধর্ষণের খবর। এমনকি দুই বছর হয়নি এমন কন্যা শিশুও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে।
অনেক ধরনের অপরাধ হয়। কিন্তু বাংলাদেশে প্রধান অপরাধসমূহের মধ্যে বেশি বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা। রাষ্ট্র নারী প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে, স্পীকার পেয়েছে, মন্ত্রী, এমপি নেত্রী পেয়েছে, অর্থনীতিও উন্মুক্ত বাজারে নারীর শ্রম এবং উৎপাদনকৌশলের মর্যাদা দিতে আগ্রহী হয়েছে। কিন্তু সমাজের কোথাও নারীর উপর পীড়ন বন্ধ হচ্ছেনা।
এই যে দেশের আইন থাকতে, আদালত থাকতে ফতোয়া আর গ্রাম শালিসের মাধ্যমে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিহিত করার চেষ্টা করা হয়, তা আর কিছু নয়, নারীদের বুঝিয়ে দেওয়া যে, তারা নারী। বুঝিয়ে দেওয়া যে নারীর প্রতি সহিংসতার বিচারে পুরুষের কথাই চূড়ান্ত, আইন নয়। পুরুষতন্ত্র, রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্র, আধিপত্য বজায় রাখার একটি উপায় হল নারীদের ধর্ষণ করা। তা-ই ধর্ষণ কেবল নারী নির্যাতন নয়, বৃহত্তর সামাজিক অন্যায়ের একটি প্রকাশ। আর এ অন্যায়টি করছে রাজনীতি, আইন-শৃংঙ্খলাসহ সামাজিক ও প্রশাসনের সাথে জড়িত পুরুষরা।
অনেকেরই প্রশ্ন এসব বন্ধ হবে কী করে বা এর প্রতিকার কী? এই সমাজ এতো নিষ্ঠুর যে, সে ধর্ষণ নামের অপরাধের বিচারের চেয়ে ধর্ষিতার মৃত্যুকামনা করাকেই শ্রেয় মনে করে। একটা জোরালো প্রতিবাদ হওয়া দরকার। যে যখনই রাজনৈতিক শক্তি, ধর্মীয় উসিলা কিংবা আর্থিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে ধর্ষণের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করবে তাকে সম্মিলিতভাবে জানিয়ে দিতে হবে প্রতিবাদের শক্তি কেমন হয়।
কিন্তু তার আগে আমাদের ভাবনার জগতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। একজন নারীর, মেয়ের স্বাধীন ও সহজ জীবনযাপনের অন্যতম শর্ত— তার শরীরটিকে পুরুষদংশন থেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আর এই বাঁচানোর কথা বলে আমরা যেন ধর্ষণের শিকার নারীকে ব্যথাভারাতুর সহমর্মিতা বেশি না দেখাই। এই ধরনের সহমর্মিতা এক ব্যাধি যা নারীকে সাহস দেয় না, তাকে আরও বেশি করে ট্রমায় ফেলে।
সাহস উচ্চারণই বেশি প্রয়োজন। ধর্ষণের শিকার নারীর লজ্জা পাওয়ার, মুখ লুকাবার কিছু নেই। লজ্জা পাবে, মুখ লুকাবে ধর্ষক। কারণ অপরাধ সে করেছে। আমাদের গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম, আমাদের নারী আন্দোলনে এ বার্তাই দিতে হবে বেশি করে। সামাজিক মাধ্যমে আহা-উহু করে বিউটির ছবি শেয়ার করার চেয়ে সেই কুলাঙ্গারের ছবি বেশি করে শেয়ার করা জরুরি।
আমরা শাহবাগে যাব, বক্তৃতা করব, মোমবাতি জ্বালাব – সবই ঠিক আছে। কিন্তু একটা সামাজিক পরিবর্তনের ভাবনা আসুক সবার মনে। একটা পরিষ্কার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া দরকার- বাংলাদেশের সমাজ পুরুষতন্ত্র ও তার ধ্বজাধারীর কবলে থাকবে না, থাকতে পারেনা।
যে বা যারা মানুষকে লিঙ্গপরিচয়ের ঊর্ধ্বে দেখেনা বা দেখতে পারেনা, তাদের চোখের সার্জারি করে ফেলতে হবে। কারণ এই চোখ আইন ও বিধান সৃষ্টি করে ধর্ষণের মাঠ তৈরি করে। এই চোখই নারীকে হেয় করে দেখে। তা-ই আমাদের দেশে নির্যাতিত বা ধর্ষিত মেয়েই শাস্তি ভোগ করে বেশি। ধর্ষিতাকে শাস্তি দেওয়ার আইন নেই কিন্তু রেওয়াজ আছে আমাদের। এই গ্রাম শালিস সেই ধরনের এক রেওয়াজ।
ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধ ধর্ষকের; দোষ, পাপ, অন্যায়, অনৈতিকতা ধর্ষকের; এই জরুরি কথাটি তার পরিপার্শ্বে সোচ্চার হয় না বলে ধর্ষিত নারী প্রায়শই অবসাদগ্রস্ত হয়, জীবনকে অর্থহীন ভাবতে থাকে ও আত্মহননাভিমুখী হয়।
এখানে গণমাধ্যমের উদ্যোগ প্রয়োজন অনেক বেশি। ধর্ষকের শাস্তি নিয়ে প্রশাসন ও রাষ্ট্র ভাববে কি ভাববে না সেই চিন্তায় না গিয়ে গণমাধ্যম পারে প্রতিটি ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে সমাজকে চিনিয়ে দিতে সেইসব অপরাধীদের।
গণমাধ্যমে বা সামাজিক মাধ্যমে যারা লিখেন, যারা আন্দোলন করেন, তারা মনে রাখবেন এই সমাজ এখন এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, ধর্ষকের সংশোধন আর সম্ভব নয়। আর এদের সমর্থনে বিরাট এক সঙ্গমেচ্ছু বাহিনী ছড়িয়ে গেছে সারাদেশে যারা নারীর সম্মতির পরোয়া করেনা। এদের পক্ষে আছে রাজনীতি, প্রশাসনিক শক্তি এ সামাজিক বিধি বিধান।
ধর্ষণ এমনই এক মর্মবিদারী অপমানজনক এবং অপরিমেয় পীড়াদায়ক ঘটনা, এমনই সুদূরপ্রসারী তার পরিণাম যে, যারা সেই পরিণাম কাছ থেকে দেখেননি, ধর্ষকের প্রতি তাদের ক্রোধ, ঘৃণা কখনও তাদের সমান হবে না যারা সেই দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। তা-ই শুধু প্রতিবাদ নয়, একটা প্রতিশোধস্পৃহা তৈরি হোক এখন থেকেই। ক্ষমা পরম ধর্ম, কিন্তু সব ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই নয়, অহিংসা পরম ধর্ম, কিন্তু নারীর সন্মান মৃত্যুর চেয়েও বড়।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস