এরপর কী?
স্বাধীনতার মাত্র ৪৮ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় প্রবেশ করলো- স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশ এজন্য আনন্দিত। ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ অন্য অনেক দেশের পক্ষেই এতো দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের তকমা এড়ানো সম্ভব হয়নি।
নিঃসন্দেহে এজন্য গত দশ বছর ধরে নিরলস পরিশ্রম দিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃতিত্ব দাবি করতেই পারেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আর কারোরই এই উন্নয়নে অংশীদারীত্ব নেই। বরং দেশের প্রতিটি নাগরিক দেশের এই সাফল্যে তার কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। তারপরও একজন নেতৃত্বের প্রয়োজন পড়ে, একটি দেশকে সঠিক দিক নির্দেশনায় এগিয়ে নিয়ে যাওযার জন্য।
বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জেলের ভেতর জাতীয় নেতাদেরকে হত্যা করার পর যে নেতৃত্বশূন্যতা দেখা দিয়েছিল এবং তাদের অবর্তমানে সেনা বাহিনীর অফিসারদের জায়গা করে দেওয়ার যে চেষ্টা দেখা দিয়েছিল শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে সে অবস্থা থেকে বের করে এনেছেন। একথা খুবই সত্য যে, শেখ হাসিনা রাজনীতিতে এসেছিলেন বলেই জেনারেল জিয়াউর রহমানের করা রাজনৈতিক দল বিএনপি বেগম জিয়াকে রাজনীতিতে নামিয়েছিল। এবং এরপর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যা কিছু আন্দোলন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অর্জন করতে হয়েছে তা শেখ হাসিনাই মূলতঃ করেছেন আর ‘বাই ডিফল্ট’ বেগম জিয়া তার ‘বেনিফিসিয়ারি’ বা সুবিধাভোগী হয়েছেন।
নিন্ম মধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত হওয়া কিংবা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ যেমন এক নতুন মাত্রায় প্রবেশ করছে তেমনই এর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে কিছু দায় ও দায়িত্বও গ্রহণ করতে হবে। অর্থনীতির কচকচানি যদি বাদও দিই তাহলে আমাদের একথা মাথায় রাখতে হবে যে, এই নতুন উচ্চতায় প্রবেশ করা হলো, মাত্র এক দশক আগেও সেটা ভাবা যায়নি কারণ অনেকেই তখন বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছিল।
দেশটি সে পথে হাঁটছিলও। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে আজকের অবস্থানে আসাটা যেমন কষ্টসাধ্য ছিল তেমনই এই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা এর চেয়ে সামনের স্তরে প্রবেশেও তেমনই শ্রমসাধ্য বিষয়। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক দু’ক্ষেত্রেই বাংলাদেশকে সমান দক্ষতা দেখাতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের একদা সমৃদ্ধ দেশগুলির দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, তাদের সমৃদ্ধি দুঃস্বপ্নের মতো মিলিয়ে গিয়ে এখন সেখানে মানুষ আর উন্নয়নের কবরস্থান রচিত হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন বিপদের সম্ভাবনা আছে কিনা তা নিয়ে আমার ভাবাটা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা একটু যদি ভেবে দেখি যে, কী কারণে কোন্ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্য কিংবা আফ্রিকার একদা সমৃদ্ধ দেশগুলি আজকে দুরবস্থায় পতিত হয়েছে তাহলে দেখতে পাই যে, অনেকগুলো দেশেই রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বিরাজমান ছিল এবং সংঘাত এতোটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল যে, বিদেশি আগ্রাসী শক্তিসমূহ সেসব দেশে খুব সহজেই আক্রমণের সুযোগ লাভ করেছিল।
বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং দুই বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থান করায় একদিকে যেমন সুবিধে রয়েছে তেমনই বিপদের সম্ভাবনাও কম নয়। বিশেষ করে আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশ এই দুই বৃহৎ ও ক্ষুধার্ত অর্থনীতির চোখে বন্ধুপদবাচ্য নাও হতে পারে। এর অন্যতম কারণ হয়তো, বাংলাদেশের জনসংখ্যাধিক্য এবং এই জনসংখ্যার পালিত ধর্মটি ইসলাম। সে কারণে বাংলাদেশকে আরো বেশি সতর্কতা ও সাবধানতা দেখাতে হবে বলে যে কোনো বিশ্লেষকই মনে করে থাকেন।
এই মুহূর্তের বাংলাদেশকে দেখি আমরা। একদিকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় প্রবেশ করায় যেমন আনন্দমিছিল হচ্ছে তেমনই আরেক দিকে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে দেশের নির্বাচন, গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং দেশের ভেতর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকা নিয়ে।
আমরা অবশ্য পেরিয়ে এসেছি সেই দুঃসময়, যখন যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে, নির্বাচন অনুষ্ঠানকে ঠেকানোর জন্য জ্বালাও-পোড়াও-রাজনীতি বাংলাদেশকে প্রায় বসবাসের অযোগ্য রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। সাধারণ মানুষের ব্যক্তি-নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হয়েছিল সেই সময়। সেখান থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল সময়ে প্রবেশ করবে সেটা হয়তো অনেকেই ভাবেননি, কিন্তু এখন পরিস্থিতি একটু বদলালেও সম্পূর্ণ আশঙ্কামুক্ত হওয়া যাচ্ছে না।
বিচারিক আদালতের এক রায়ে দুর্নীতির দায়ে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন যে, এই সাজা প্রদানকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ পুনরায় অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। কিন্তু সে আশঙ্কা কেটেছে কারণ এই বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে কোনো ধরনের উগ্র বিক্ষোভের পথে হাঁটেনি। সে জন্য তারা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। যদিও আদালতের নির্দেশকে আইনী প্রক্রিয়াতেই মোকাবিলা করার কথা কিন্তু বাংলাদেশে সে পথ অনুসরণ অতীতে দেখা যায়নি। সরকার বলছে এই বিচার প্রক্রিয়ায় তাদের কোনো হাত নেই। আমরা সেটা বিশ্বাস করতে চাই।
যদিও বিএনপি সরকারকেই মূলতঃ বেগম জিয়াকে জেলে রাখার জন্য দায়ী করছে। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে এমনিতেই যে অবিশ্বাস ও অচলায়তনের ইতিহাসকে আমরা এতোদিন জেনে এসেছি তা আরও বেড়েছে এবং শত্রুতা ক্রমশঃই তীব্র হচ্ছে। আমরা এও জানি যে, এই দুই পক্ষ যখন একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুতা করে তার খেসারত দিতে হয় বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে।
অপরদিকে দেশের ভেতরকার ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলি এখন মূলতঃ নিশ্চুপ হয়ে আছে কারণ তাদের মূল ও অক্ষশক্তি বিএনপি তাদের নেতৃত্বের সংকটকে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় ব্যস্ত। কিন্তু তাই বলে তারা একেবারেই শক্তিহীন হয়ে পড়েছে সেটা মনে করার কোনো কারণ নেই। নিকট অতীতে দেখা গেছে যে, আওয়ামী লীগ একটি উগ্র ধর্মভিত্তিক শক্তিকে তাদের কাছে টেনে রাখার জন্য অনেকগুলো ব্যাপারে ছাড় দিয়েছে।
যদিও একথা আওয়ামী লীগের শত্রুও মনে করে না যে, তারা বা অন্য যে কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে তাদের প্রিয়জন মনে করে। এর কারণ বহুবিধ হলেও, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের নিবু নিবু শলতেটি এখনও জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টাকে মুখ্য কারণ হিসেবে মনে করা যায়। কিন্তু তারপরও এদেশের ধর্মভিত্তিক শক্তিগুলোরও বয়স হয়েছে, তাতে মিশেছে তরুণ রক্ত, যারা স্বাধীনতার পরে জন্মেছে এবং তারা হয়তো আওয়ামী লীগকে পরীক্ষা করে দেখতে চাইতেও পারে। যদিও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ‘ইসলাম-বিরোধী’ রাজনীতি করার প্রচারণা কখনও কখনও সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং যার খেসারতও বাংলাদেশকেই দিতে হয়।
মোটকথা, এই মুহূর্তে আনন্দের জোয়ারে ভাসা বাংলাদেশের সামনে বেশ কিছু অনুচ্চারিত কিন্তু জ্ঞাত প্রশ্নও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
এক. সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন; দুই. রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার তীব্র লড়াই; তিন. ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার-সমীকরণ এবং দেশের অর্থনীতির গতিকে ধরে রাখতে নিকট ভবিষ্যতে যে কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির ষড়যন্ত্রকে কী ভাবে মোকাবিলা করা যাবে সেটা।
আগেই বলেছি যে, একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণেই দেশটির অর্থনীতিতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ই, সেই সঙ্গে দেশটির দিকে আগ্রাসী শক্তির শকুন-দৃষ্টিও পড়ে, ফলে দেশটি ক্রমশঃ তার সক্ষমতা হারাতে শুরু করে। বাংলাদেশে সেরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না সে নিশ্চয়তা এখনও দেয়ার মতো সময়, সুযোগ ও পরিবেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি এই মুহূর্তে সচেতন মানুষের মনকে নাড়া দেয়, তাহলো, এরপর কী? এই প্রশ্ন যেমন রাজনৈতিক, তেমনই সামাজিক, ততোটাই অর্থনৈতিক এবং তার চেয়েও বেশি এই আনন্দ, উল্লাস ও উদযাপনকে স্থায়ীত্ব দেয়ার।
রচেস্টার ২৭ মার্চ, মঙ্গলবার ২০১৮
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/পিআর