ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ভুলব না, ভোলা উচিত নয়

শান্তা মারিয়া | প্রকাশিত: ০৯:৪৯ এএম, ২৬ মার্চ ২০১৮

কয়েকটি দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি। একজন কবি, প্রতিবাদী ও সংগ্রামী নারী মেহেরুননেসা। বাড়ির বৈদ্যুতিক ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত তার দেহ। নির্যাতন শেষে জবাই করে হত্যা করা হলো তাকে। বিশ্বখ্যাত দার্শনিক গোবিন্দচন্দ্র দেব। অজাতশত্রু। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। নিজের বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে তাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। ছাত্রাবাসে মৃতদেহের স্তূপ। কবর দেওয়ার মানুষও নেই। শাঁখারি বাজার। মৃত মায়ের কোলে মৃত শিশু। দুজনকেই হত্যা করা হয়েছে বেয়নেট চার্জ করে। এমনি দৃশ্যের পর দৃশ্য। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, জগন্নাথ হল, লক্ষ্মীবাজার। সব বিধ্বস্ত। সব মৃত।

জ্বলছে সংবাদ পত্রিকার অফিস। মর্টারের গোলায় বিধ্বস্ত ইত্তেফাক ভবন। ভাঙা শহীদ মিনার। সবই এই শহরেরই ঘটনা। শুধু সময়টা ১৯৭১ সালের মার্চ। রাতের অন্ধকারে হিংস্র শ্বাপদ এগিয়ে আসছে। ঝাঁপিয়ে পড়ছে ঘুমন্ত মানুষের উপর। নখে দাঁতে ছিঁড়ে খাচ্ছে। একটি দেশের সেনাবাহিনী সে দেশেরই নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকের উপর এমন হত্যার তাণ্ডব বইয়ে দিতে পারে তা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রির আগে অবিশ্বাস্য ছিল।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাণ্ডব চালায় বিহারিরাও। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে হত্যা, ধর্ষণ, লুট ও অগ্নিসংযোগের তাণ্ডব চলে। পাকিস্তানি বাহিনী ও বিহারিরা একযোগে বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসই চলে এই ধ্বংসযজ্ঞ। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে যখন গণহত্যার নীল নকশা তৈরি হয় তখন কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একই দেশ ছিল। তার মানে নিজদেশের মানুষকে নির্বিচারে হত্যার অনুমোদন দেয় সামরিক জান্তা। নিজদেশে গণহত্যা চালাতে অজস্র অস্ত্রের আমদানি। নিজের দেশের পুলিশবাহিনীকে হত্যার পরিকল্পনা করছে সে দেশেরই সরকার। ভাবা যায়?

নিজের দেশের আধা সামরিক বাহিনীর উপর গণহত্যা চালাচ্ছে সে দেশের সরকার। এটাও সম্ভব হয়েছে ৭১ সালে। শুধু সামরিক জান্তা নয় এর সঙ্গে ছিল রাজনৈতিক দল পিপিপি এবং তাদের নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোও। আসল কথা হলো, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় ও পূর্ববাংলার গণজাগরণ দেখে তারা ঠিকই বুঝেছিল বাঙালিকে আর দমিয়ে রাখা যাবে না। একথা তো সত্যি যে বাঙালিকে তারা কোনদিনই নিজের দেশের মানুষ বলে মনে করেনি। পশ্চিম পাকিস্তানিদের চোখে আমরা বরাবরই ছিলাম তাদের ঔপনিবেশিক শোষণের বস্তু।

তারা আমাদের পাট নিবে, পাট বেচা বিদেশি মুদ্রা নিবে, ভূমির ফসল নিবে। আমরা হবো দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। আমরা একটু ‘কম মুসলমান’। আমরা ‘সাচ্চা পাকিস্তানি নই’।

আর এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে তো পশ্চিম পাকিস্তানিরা চিরদিনই ঘৃণার চোখে দেখেছে। তাদের ভিটা মাটি থেকে উচ্ছেদ করে ভারতে পাঠাতে পারলেই উত্তম। তারা চেয়েছিল এদেশের ভূমি। তাই তারা ৭১ সালে পোড়ামাটি নীতি নেয়। তার মানে এদেশের মানুষকে হত্যা করে ভূমি দখল করে নেওয়া। এদেশে থাকবে শুধু পাকিস্তানিদের ধামাধরা কিছু দালাল রাজাকার। আর এদেশের নারীরা হবে পাকিস্তানিদের যৌনদাসী। তাদের গর্ভে জন্ম নিবে গোলামের জাতি।

পশ্চিম পাকিস্তানিদের এবং তাদের এদেশীয় সমর্থকদের সবচেয়ে বেশি রাগ ছিল ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের উপর। এরাই জনগণের চোখে আঙ্গুল দিয়ে শোষণের চিত্র তুলে ধরে। তাই অপরেশন সার্চ লাইটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গণহত্যার তাণ্ডব বয়ে যায়। কক্ষে ঢুকে ঢুকে হত্যা করা হয় ছাত্রদের। বাড়িতে ঢুকে হত্যা করা হয় শিক্ষকদের। গণধর্ষণের জন্য রোকেয়া হল থেকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় ছাত্রীদের। তাদের রাগ ছিল শহীদ মিনারের উপর। কারণ শহীদ মিনার ভাষা আন্দোলনের প্রতীক। যে ভাষা আন্দোলন থেকে বাঙালির স্বাধিকার চেতনার জন্ম।

পঁচিশে মার্চ তাই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় শহীদ মিনার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গোবিন্দচন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মতো বিখ্যাত শিক্ষকদের যেমন হত্যা করা হয় তেমনি চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারিদের আবাসিক এলাকাতেও চলে হত্যাযজ্ঞ।

মধুর ক্যান্টিনের প্রতিষ্ঠাতা মধুদাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়। রেহাই পায়নি শিশুরাও। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বাঙালি পুলিশদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘাতক পিশাচরা। একই সঙ্গে ইপিআর এর বাঙালি জওয়ানদের উপর চলে নিধনযজ্ঞ। পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজার, লক্ষ্মীবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় যে নির্মমতা চলে ইতিহাসে তার নজির বিরল। মায়ের কোলে থাকা দুগ্ধপোষ্য শিশুদের মাটিতে আছড়ে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। বাবার সামনে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে মেয়েকে, ছেলের সামনে মাকে।

ছাব্বিশে মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। আমাদের গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এই মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় এদেশের বেসামরিক জনগণের উপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন ছিল অপরিমেয়। ভয়ংকর নির্যাতনে প্রায় এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে যেতে বাধ্য হয়। ধ্বংস হয় এদেশের সম্পদ। লুটতরাজ চলে অবাধে। আশ্রয় শিবিরে যাওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করে অসংখ্য মানুষ।

মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে পুরো দেশটি পরিণত হয় বধ্যভূমিতে। বিহারি, রাজাকার, আলবদর, আল শামসের ঘাতকরাও ছিল সমান হিংস্র।

বাঙালিকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল এরাই। একাত্তরের ঘাতক-জল্লাদদের জঘন্য ভয়ংকর অপরাধ কি ভোলা সম্ভব? পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার, আল বদরের ঘাতকদের মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো কখনও ভোলা যায় না। ভোলা যায় না তাদের অপরাধ যারা আমাদের মা-বোনদের ‘গনিমতের মাল’ আখ্যা দিয়ে তুলে দিয়েছিল ঘাতকদের হাতে।

দেরীতে হলেও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার হচ্ছে। কুখ্যাত রাজাকার ঘাতকদের শাস্তি হচ্ছে। তবে এটা যথেষ্ট নয়। দরকার সবগুলো অপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার নাৎসি বাহিনীর ঘাতকদের বিচার অর্ধ শতাব্দি পরও হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকা থেকেও তাদের খুঁজে আনা হয়েছে। তাহলে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাতকদের বিচার হবে না কেন? তাদের অনেকে তো এখনও জীবিত আছে। আন্তর্জাতিক বিচারের আওতায় কি তাদের আনা যায় না?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোরিয়ার নারীদের উপর নির্যাতন চালানোর জন্য কোরিয়ার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়েছে জাপান। তাহলে বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তান ক্ষমা চায়নি কেন? ত্রিশ লাখ শহীদ ও নির্যাতনের শিকার চার লাখ নারীর প্রতি ন্যায়বিচারের জন্য এটি প্রয়োজন।

আমরা যেন যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধগুলো কখনও ভুলে না যাই আর কখনও ভুলে না যাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন