স্বাধীনতার জয় হোক, শুভবুদ্ধির জয় হোক
অতীতমুখী দৃষ্টি নিয়ে স্বাধীনতা দিবস ও স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি রোমন্থনে সুফল হয় না। অতীত অভিজ্ঞতা স্মরণ করে, ইতিহাসের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে উন্নততর নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টির সংকল্প গ্রহণ করলে এবং সংকল্প সফল করার জন্য কাজ করলে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কল্যাণকর হবে। প্রগতির উপলব্ধি ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি দরকার।
১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজির লক্ষণাবতী দখল থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধ পর্যন্ত কালে বাংলা শাসিত হয়েছে তুর্কি, পাঠান ও মোগলদের দ্বারা। এই শাসকেরা ছিলেন বিদেশি। এঁরা অভিহিত হয়েছেন ‘যবন’ বলে। সেকালে যবন বলে বোঝানো হতো বিদেশি, বিভাষী, বিধর্মী, বিজাতি।
বাংলা তখন ছিল একের পর এক বিদেশি রাজবংশের দ্বারা শাসিত। তারপর ইংরেজ শাসন, তাও বিদেশি, বিভাষী, বিধর্মী, বিজাতি। পরে পাকিস্তান এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অগণিত প্রাণের বিনিময়ে এবং বিরাট বিপুল ক্ষয়-ক্ষতির মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।
ব্রিটিশ-শাসিত বাংলায় রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে যে অগ্রগতি, তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের সময় দেখা দেয় গণজাগরণ। সেই গণজাগরণ, গণআন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঘটেছে ইংরেজ শাসন ও জমিদারি ব্যবস্থার অবসান, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।
গণজাগরণের ক্লাইমেক্স ছয়দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মোকাবিলা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তের মার্চের সর্বাত্মক জাতীয় অভ্যুত্থান ইত্যাদির মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের কাল সেটা। পরে তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। অনেক মূল্যের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
বিনামূল্যে কোনোকালেই কোনো জাতি বড় কিছু অর্জন করেনি। বড় কিছু অর্জনের জন্য প্রত্যেক জাতিকেই বড় মূল্য দিতে হয়েছে। আমাদেরও তাই করতে হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিনামূল্যে আশা করার সুযোগ ছিল না।
ভৌগোলিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের সীমানা পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র, মরুভূমি ইত্যাদি দ্বারা গঠিত স্বাভাবিক সীমানা নয়। ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ও ব্রিটিশ সরকারের বিভেদনীতির মধ্য দিয়ে এবং ১৯৭১ সালে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশের সীমানা। সতর্ক প্রচেষ্টা দ্বারা এই সীমানা রক্ষা করতে হচ্ছে।
প্রতি মাসেই ভারত সরকারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী দ্বারা কিছু বাংলাদেশির প্রাণ যাচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বাড়ছে নানা অসাম্য। ধনী ও গরিব, নারী ও পুরুষ, গ্রাম ও শহর, বাঙালি জনগোষ্ঠী ও কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ইত্যাদির মধ্যে রয়েছে নানা পার্থক্য ও অসাম্য। এসব অবলম্বন করে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা সাম্রাজ্যবাদী মহল থেকে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ হাসিলের জন্য চালানো হয়। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কিংবা বহুত্বমূলক সমন্বয়ের দৃষ্টিভঙ্গি কার্যকর নেই।
পৃথিবীর সর্বত্র সব রাষ্ট্রেই বাস্তবে জনগণের মধ্যে এই অনৈক্য ও অসাম্য বিরাজমান আছে। তারা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কিংবা বহুত্বমূলক সমন্বয়ের নীতি অবলম্বন করে চলছে। আমাদের রাজনীতিতে দুর্বলতার অন্ত নেই। সমাজে সংহতি নেই, আছে বিযুক্তি। রাজনীতি দুর্বল। দেশের শিল্পনীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ।
রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক চরিত্র দুর্বল। প্রধান দুই দল দলীয় স্বার্থে গণতন্ত্র প্রার্থনার জন্য তাদের প্রতিনিধিদের বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোতে পাঠায়, ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্কে পাঠায়। কিন্তু তাদের আচরণ গণতন্ত্র বিরোধী। তাঁরা অনেকে বিদেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। অনেকেই তাঁদের সন্তানদের যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়ায় নাগরিক করেছেন। বাংলাদেশের প্রতি তাঁদের আস্থা আংশিক না পূর্ণ? এঁদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্র রূপে গড়ে উঠবে?
স্বাধীনতা দিবসে কেবল বিজয়ের আনন্দ এবং নিজেদের সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন নিয়ে গর্ব করাই যথেষ্ট নয়। দরকার আমাদের রাষ্ট্রের দুর্বলতাগুলো নিয়ে চিন্তা করা এবং সমস্যার সমাধানের কর্মসূচি প্রণয়ন করা এবং তা নিয়ে কাজের সংকল্প গ্রহণ করা। সংকল্পে অধীন থেকে কাজ করে এগিয়ে চলতে হবে।
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। কৃষি সম্পদ ও খনিজ সম্পদ উন্নত অর্থনীতির ইঙ্গিতবাহী। বাংলাদেশের জনগণের চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তির সদ্ব্যবহার সম্ভব হবে অনুকূল সরকার গঠন করা গেলে এবং দল নির্বিশেষে রাজনীতিকে সুস্থ, স্বাভাবিক ও প্রগতিশীল করা গেলে। জনজীবনের ও নেতৃত্বের নৈতিক উন্নতি অপরিহার্য। শুভবুদ্ধির বিজয় ও অশুভবুদ্ধিকে পরাজিত রাখতে হবে। এটা হঠাৎ আকস্মিকভাবে হয়ে যাওয়ার ব্যাপার নয়, নিরন্তর সাধনার ব্যাপার।
সদর্থক ও নঞর্থক উভয় দিক নিয়েই চিন্তা-ভাবনা দরকার এবং উন্নত ভবিষ্যৎ সৃষ্টির সংকল্প, কর্মসূচি ও কার্যক্রম দরকার। স্বাধীনতার জয় হোক। শুভবুদ্ধির জয় হোক।
লেখক : অধ্যাপক, দার্শনিক, রাষ্ট্রচিন্তাবিদ।
এইচআর/জেআইএম