ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র নির্বাচন : প্রসঙ্গ কথা

ফারুক যোশী | প্রকাশিত: ০৯:৫৮ এএম, ২২ মার্চ ২০১৮

প্রায় আট বছর পূর্বে ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে টাওয়ার হ্যামলেটসে প্রথম সরাসরি ভোটের মাধ্যমে মেয়র নির্বাচন শুরু হয়। বারার ভোটারের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়া এ নির্বাহী মেয়রের পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাভাবিকভাবেই তাই শুরুতেই এ নিয়ে প্রতিযোগিতা শক্ত হয়ে ওঠে।

যুগের পর যুগ ধরে এই টাওয়ার হ্যামলেটস বারায় লেবার দলের আছে একটা শক্ত ভিত। এই ভিতে আছে বাঙালি কমিউনিটির দৃঢ় অবস্থান। এ বারাকে কেন্দ্র করেই বেথনাল গ্রিন-বো সংসদীয় এলাকার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন রুশনারা আলী। বাঙালি অধ্যুষিত এ এলাকায় তাই নির্বাচন এলেই বাঙালি প্রতিনিধিত্বের জন্যে একটা প্রচেষ্টা থাকবেই।

স্বাভাবিকভাবে এ বারায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জনপ্রতিনিধিদের আধিক্য আছে। কিন্তু যখনই কোন গুরুত্বপূর্ণ কিংবা প্রধান পদে নির্বাচন জমে ওঠে, তখনই বাঙালিরা কোন না কোনভাবে পিছিয়ে পড়েছেন অতীতে। তাই ২০১০ এ যখন মেয়র নির্বাচন ঘোষণা করা হল, তখন গোটা ব্রিটেনেই যেন লেবার দলের রাজনীতিতে একটা কাাঁপন শুরু হলো। দলের অভ্যন্তরে এ নিয়ে শুরু হলো দ্বন্দ্ব, এবং এই দ্বন্দ্ব এক সময় আদালত পর্যন্ত গড়ায়। প্রভাবশালী লেবার দলীয় নেতা এবং তৎকালীন কাউন্সিলার লুৎফুর রহমান আদালতে গিয়েও শেষপর্যন্ত দলীয় মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হন।

তবে এই ব্যর্থতাটাই যেন লুৎফুরের জন্যে আশীর্বাদ হয়ে আসে। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করেন এবং তার সাথে লেবার দলের অনেক নির্বাচিত কাউন্সিলার সংযুক্ত হন। লেবার দলের বিশ্বাসের সাথে জড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষ তখন লুৎফুরের সমর্থনে এগিয়ে আসে। এবং তারা এটাকে একটা সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ হিসেবে বিবেচনা করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে লেবার দলের প্রার্থীকে হারিয়ে লুৎফুর রহমান মেয়র নির্বাচিত হন।

বাঙালিদের জন্যে এ এক ইতিহাস। ব্রিটেনের মূলধারার রাজনীতিতে বাঙালিদের দ্বিতীয় বিজয় হিসেবেই ছিলো এটা পরিগণিত। মেয়র নির্বাচিত হবার পর শুধু বাঙালিই নন, অবাঙালি ভিন্ন বর্ণ-ধর্মের মানুষও লুৎফুরের কার্যক্রমে আশাবাদী হয়ে ওঠে। ২০১৪ সালের দ্বিতীয় মেয়র নির্বাচনেও লুৎফুর বিজয়ী হয়ে আসেন। কিন্তু বছর না যেতেই লুৎফুর কূটরাজনীতির শিকার হন। জাতীয় রাজনীতি আর আইনের মারপ্যাচে লুৎফুর ছিটকে পড়েন রাজনীতি থেকে। সব কিছু হারান। মেয়র পদ থেকে শুরু করে তার উচ্চতর আইন পেশা থেকে পর্যন্ত তাকে বিদায় নিতে হয়, বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই।

২) সেই থেকে টাওয়ার হ্যামলেটসে বাঙালিদের হার মানা শুরু। টাওয়ার হ্যামলেটস বারায় বাঙালিদের আধিক্য থাকা স্বত্ত্বেও লেবার পার্টিতে মেয়রের পদে প্রার্থী হতে পারলেন না কোন বাঙালি। জন বিগস প্রার্থী হলেন। স্বাভাবিকভাবেই লেবার অধ্যুষিত এই বারা ফিরিয়ে নিতে পারলেন না সাবেক মেয়রের গ্রুপের (টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট) প্রার্থী রুবিনা খান। একজন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ রাজনীতিক রুবিনা খান মোট ভোটের ৩৭.৮১ শতাংশ ভোট পান, অন্যদিকে লেবার দলের প্রার্থী জন বিগস ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হন। ২০১৫’র উপ নির্বাচনে হার মানার মধ্যি দিয়েই আবার শুরু পেছনে হাঁটার। কিন্তু তারপরও টিম টিম করে জ্বলেছে বাঙালিদের ভাগ্যাকাশ, এই টাওয়ার হ্যামলেটসে।

এবারে নির্বাচন হচ্ছে ৩ মে । মাসের চেয়ে সামান্য বেশি সময় আছে প্রার্থীদের কাছে। কিন্তু এ নির্বাচনেও বাঙালিদের ওপর ছায়া দেয়া কালো মেঘ সরার কোন সম্ভাবনাই যেন নেই। লুৎফুর রহমানকে ঘিরে যে একটা ঐক্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো, এই ঐক্য এই টাওয়ার হ্যামলেটসে আর নেই। প্রকাশ্যে এ নিয়ে কোন উচ্চারণ না হলেও এবার রাবিনা খানকে কেন জানি পাত্তাই দিলেন না সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমান।

রাবিনা খানের পক্ষে আগের বার লুৎফুর রহমানের ডেপুটি মেয়র ওহিদ আহমদ সমর্থন দিয়েছিলেন, সেই তিনি এবার মেয়র নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। এবং ব্যাখ্যাহীনভাবেই পতিত মেয়র ২০১৫’র তারই প্রার্থী রাবিনা খানের বিপরীতে গিয়ে ওহিদের পক্ষে ভোট চাইছেন। কি অদ্ভুদ রাজনৈতিক সমীকরণ। অথচ এবারে রাবিনা খানের পক্ষে একটা জনসমর্থন তৈরি করা যেতো। রাবিনার ক্যারিয়ার নিয়ে নতুন করে কোন সমালোচনা আসার কথা নয়। কারণ তিনি পরীক্ষিত। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি একজন লেখক। ‘আয়সাস রেইনবো’ নামের একটা উপন্যাস লিখেছেন তিনি। কাজ করেছেন বিবিসি-আইটিভি’র বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে । তিনি শর্ট ফিল্মও নির্মাণ করেছেন। রাজনীতিতে কিংবা কমিউনিটি নেতৃত্বে তার যোগ্যতা প্রশ্নবোধক নয়।

অহিদ আহমদও কমিউনিটি রাজনীতিতে লুৎফুর রহমানের সাথে কাজ করেছেন। রাজনীতিতে তিনিও একটা পরিচিত নাম। তিনি ছিলেন ডেপুটি মেয়র। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্নটা আসতেই পারে মাত্র তিন বছরের মাথায় এই বিচ্ছিন্নতা কেন। লুৎফুর রহমানকে মানুষ ভোট দিয়েছিলো।

বাঙালিরা বিজয় নিয়ে এসেছিলো। ২০১৫তে লুৎফুর রহমান ছিটকে পড়ার পর জন বিগস এর গত তিন বছরের কার্যক্রম শেষে বাঙালিরা একটা ঐক্যে পৌঁছাতে পারতো। এই ঐক্যে নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে পারতেন লুৎফুর। কিন্তু তিনি ওহিদের পক্ষে ভোটে নেমে কি বাঙালিদের ঐক্যের ফাটলকে আরও বিস্তৃত করলেন না ?

এ প্রশ্নটা আসতেই পারে। ৩ মে পর্যন্ত যদি এই দু’জন প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে থাকেন, তবে নিঃসন্দেহে ভোটে ফাটল ধরবে। আর ফাটল ধরা বললে ভুল হবে। ভোটাররা তখন জেনেই যাবে সাবেক লেবার দলের রাবিনা কিংবা ওহিদ কেউই কমিউনিটির ঐক্য গড়তে কোন পজেটিভ ভূমিকা রাখতে পারবেন না, তাই এমনকি বাঙালি ভোটারদের হিসাব নিকেশ পাল্টে যেতে পারে। যা লেবারের পক্ষেই যাবে। এবং তখন জন বিগসকে কেউ আটকাতে পারবে না।

৩) এবার কনজারভেটিব পার্টি থেকে আরেক প্রতিশ্রুতিশীল রাজনীতিবিদ ডা. আনোয়ারা আলী পেয়েছেন মনোনয়ন। যিনি তার তারুণ্য সময় থেকেই রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত। তরুণ নেতা হিসেবে তিনি ২০০৬ সালে কাউন্সিলার নির্বাচিত হয়েছিলেন লেবার দলের হয়ে এই টাওয়ার হ্যামলেটস এ। লেবার দলের সাথে তারও বনিবনা হয় নি। স্থানীয় লেবার দলীয় দ্বন্দ্ব তাকেও শেষপর্যন্ত লেবার পার্টিতে টিকতে দেয়নি।

আনোয়ারা আলী পেশায় একজন জিপি। ডা. আনোয়ারা পেশাগত জীবনে একজন সফল মানুষ। ব্রিটেনের স্বাস্থ্যসেবায় তার অসামান্য অবদানের কারণে তিনি এবছর পেয়েছেন রাণির দেয়া এমবিই খেতাব। ব্রিটেনের স্বাস্থ্যসেবায় তাঁর এই অবদান গোটা কমিউনিটিকে মূলধারায় বাঙালিদের সম্মানীত করেছে। তাছাড়া তেরেসা মে, বরিস জনসন, ডেভিট ক্যামেরুনসহ দলের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে তার রাজনৈতিক সংযোগ অত্যন্ত দৃঢ়।

বাংলাদেশে জন্ম নেয়া আনোয়ারা টাওয়ার হ্যামলেটসের আলো-বাতাসে বেড়ে উঠেছেন। এই কমিউনিটিকে তিনি জানেন অত্যন্ত কাছ থেকে। কমিউনিটির বিভিন্ন সমস্যাকে তিনি সম্মুখে নিয়ে আসছেন তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায়। তিনি মনে করেন লেবার দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দল গোটা টাওয়ার হ্যামলেটসকে পেছনের দিকে টানছে। লেবার দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দল, অপরিণামদর্শী নীতিমালার কারণে গোটা কমিউনিটি পিছিয়ে পড়ছে। এবং এই দ্বন্দ্বটা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি বছরই অনুদান সংকুচিত হয়ে আসছে।

স্বাভাবিক কারণেই কমিউনিটির সাথে সম্পর্কিত অসংখ্য চাকরি চলে যাচ্ছে। কারণ কথা বলার কিংবা সংগ্রাম করার মত নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না, তাই এটা হচ্ছে। অথচ ডা. আনোয়ারা মনে করেন, তার দলের কারণেই আজ টাওয়ার হ্যামলেটস বারার অসংখ্য মানুষ ‘বাই টু লেট’ স্কীমের মধ্য দিয়ে এই এলাকায় বাড়ির মালিক হচ্ছেন। তিনি মনে করেন, যুগ যুগ ধরে বাঙালিদের দেয়ার ইতিহাস আছে লেবার দলে, কিন্তু পাবার ইতিহাস খুবই অল্প। তিনি মনে করেন লেবার দল উন্নয়ন দিতে পারে নি এই টাওয়ার হ্যামলেটসে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই এবার সময় এসেছে উন্নয়নের গতিধারার সাথে টাওয়ার হ্যামলেটসকে একীভূত করতে তাকে কিংবা কনজারভেটিব দলকে ভোট দেয়া।

গত নির্বাচনে টোরি কিংবা তার দল মাত্র ৫ হাজারের সামান্য বেশি ভোট পেয়েছে উল্লেখ করলে তিনি বলেন, আগের অনেক প্রার্থীই ‘পেপার ক্যান্ডিডেইট’ হিসেবে নিজেকে মনে করতেন অর্থাৎ তারা মনে করতেন, এখানে কনজারভেটিবের নির্ধারিত ভোটই তার পার্টি পাবে। তিনি মনে করেন এবার হিসাব পাল্টাবেই। তার মতে এই এলাকায় তিনি জিপি হিসেবে বছরের পর বছর থেকে হাজার হাজার মানুষের সেবা করে আসছেন, কমিউনিটির সাথে তার আছে এক আত্মিক টান। যেখানেই তিনি যাচ্ছেন, সেখানেই তিনি মানুষের সমর্থন পাচ্ছেন।

৪) নিউহাম ব্রিটেনের আরেকটা বারা । বাঙালিসহ এশিয়ান মানুষের একটা দৃঢ় ও ব্যাপক অবস্থান আছে এই কাউন্সিলে। দীর্ঘ ষোল বছর স্যার রবির ওয়েলস এই বারার মেয়র ছিলেন। লেবার দলের অথচ তার কিছু কার্যক্রম কমিউনিটির মানুষকে দুঃখ দিয়েছে, লেবার দলের অভ্যন্তরে তার বিরুদ্ধেও ক্ষোভও ক্রমেই স্পষ্ঠ হয়ে উঠছিলো। কিন্তু এই কাউন্সিলের খুবই প্রভাবশালী নেতা হবার কারণে কেউই সাহস করে তাকে সরাতে পারে নি। ক্ষোভ জমেছে, প্রতিবাদ করেছেন কিন্তু জোরালো কিংবা প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করা ছিল রীতিমত সাহসের ব্যাপার।

এবার এই সাহস দেখালো নিউহামের লেবার দল। রুকশানা ফাইজ নামের পাকিস্থানী বংশোদ্ভূত নিউহাম বারার কাউন্সিলার ফাইজ সবাইকে নিয়ে সেই সাহস দেখালেন। বাঙালি কমিউনিটির টিভি মিডিয়ায় এসে তার সাহসের কথাও বলেছেন তিনি, ক্যাম্পেইন করেছেন স্যার রবিন ওয়েলস এর বিপক্ষে।

এবং শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় শেষে লেবার দলের ভোটাধিকারপ্রাপ্ত সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে স্যার রবীন ওয়েলসকে বিদায় করেছেন তারা। লেবার দলের নির্ধারিত আসন হিসেবে পরিচিত এই বারায় আগামীর নির্বাহী মেয়র হিসেব হয়তো ব্রিটেনের মানুষ দেখবেন আরেকজন এশিয়ানকে, কারণ তিনিই মনোনীত হয়েছেন আগামীর মেয়র প্রার্থী হিসেবে, নিউহাম বারায়। এটাই বিজয়, গণতান্ত্রিক।

টাওয়ার হ্যামলেটস কি কোন নতুন কোন আশার আলো দেখবে নিউহাম বারা থেকে এ প্রশ্নটি আমরা রাখতেই পারি, ৩ মে’র নির্বাচনকে সামনে রেখে ।

লেখক : লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/আরআইপি

আরও পড়ুন