স্টিফেন হকিং : অসামান্য এক বিজ্ঞানী
মানুষ স্টিফেন হকিং তাঁর জীবনের প্রথম স্মৃতি ছিল, তিনি একটি নার্সারিতে দাঁড়িয়ে কেঁদে আকাশ মাথায় করছেন। আর তাঁর চারিদিকে খেলাধুলা আর আনন্দে মশগুল একদল শিশু ও তাঁর বাবা মা হতভম্ভ বিস্মিত হয়ে তাঁকে দেখছেন। সেই আড়াই বছরে তাঁকে নার্সারি থেকে নিয়ে ফের দেড় বছর পর তাঁর বাবা মা তাঁকে নার্সারিতে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। কেম্ব্রিজের সেরা স্কুলে ব্যারনে শিশু হকিং এর অভিযোগ ছিল , “এরা তো আমাকে কিছুই শেখায় না।” কারণ যা শেখাতো তা তিনি কিছুতেই অনুধাবন করতে পারতেন না, শিখবেন কেন? তাঁর ছোট বোন ৪ বছরে যা শিখেছিলেন তিনি ৮ বছর বয়সে তা শিখতে পারেন নি।
মানুষ এই শতাব্দীর অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁকে স্মরণ করবে। কিন্তু আমার কাছে তার আবিষ্কারের থেকেও অনেক বড় অপার বিস্ময় মানুষ হকিং এবং চিকিৎসাশাস্ত্রকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ২২ থেকে ৭৬ অবধি তাঁর জীবনকে সচল রাখতে ব্যবহৃত অবিস্মরণীয় সব যন্ত্র । মানুষ হকিং নিজেই বিজ্ঞানের অগ্রসরতার এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত। সর্ব অঙ্গ, সর্ব ইন্দ্রীয় নিয়ে আমরা এক জীবনে কিছুই করতে পারি না। শারীরিক কোন যন্ত্রণা বা অস্বস্তিতে কাজ থেকে বিরতি নেবার পাঁয়তারা করি। আর হকিং ২২ বছর থেকে স্নায়ু রোগে শারীরিকভাবে প্রায় জড়ভরত হয়েও কি প্রচন্ডভাবে বেঁচে গেলেন!
আমাদের মত সুস্থ সবল মানুষের জন্য কত বড় লজ্জা! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি তখন পদার্থবিদ্যায় ২য় বর্ষে পড়ি। বর অফিসের ট্যুরে ভারতে গেলো। হাতে করে উপহার সামগ্রী বলতে কিচ্ছু না, নিয়ে আসলো এক বই । “ দ্য ব্রিফ হিস্টোরি অব টাইম।” দেশে তখন অরিজিনাল বইটা পাওয়া যেত কিনা বা আদৌ নীলক্ষেত কপিও এসেছিল কিনা খোঁজ নেয়া হয়নি। কিন্তু আমার বর অরিজিনাল কপিই এনেছিল এবং হতাশ হয়ে খেয়াল করেছিল তার পদার্থবিদ্যার শিক্ষার্থী বৌ এই বইয়ের নামই শোনেনি! আসলে কোন বিষয়ের শিক্ষার্থী হওয়া আর পরবর্তীতে তাতে একাত্ম হতে পারা দুটো ভিন্ন ব্যাপার।
প্রচন্ড আগ্রহ নিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু এক জীবনে আমার যে উপলব্ধি হয়েছে, তা হলো, পদার্থবিদ্যা খুব বেশি মেধাবী অথবা খুব ধৈর্য্যশীলদের জন্য, কারণ এই বেসিক সাইন্সে ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে এবং সফলতার মুখ দেখতে এই দুই গুণেরই খুব প্রয়োজন। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ দুটো গুণের কোনটাই আমার নাই। অন্যদিকে সদ্যপ্রয়াত স্যার হকিং এর এই দুটোই ছিল অসীম!
মনে আছে, সারাবিশ্বে তুমুল সাড়া জাগানো সেই বেস্ট সেলার বইটা নিয়ে বিসমিল্লাহ করে পড়তে শুরু করেও খুব বেশিদূর এগুতে পারিনি। একে তো আমি খারাপ পাঠক। তার ওপর একবার আগ্রহ হারিয়ে ফেললে বা সূত্র ধরতে না পারলে আর এগুতে পারিনা। আজো সেই বই শেষ হয়নি। অথচ তাঁর “Black Holes and Baby Universes and Other Essays” গ্রন্থটা গোগ্রাসে গিলেছিলাম। তাঁর বায়োপিক “ দ্য থিওরি অব এভরিথিং”- এর এক শব্দও যেন মিস না করি, তাই সাবটাইটেল সহই দেখেছিলাম।
ম্যুভিটি তাঁর প্রথম স্ত্রী জেনের লেখা ,তাঁদের বিবাহিত জীবনের ৩০ বছরকে ঘিরে রচনা “ ট্রাভেলিং টু ইনফিনিটি : মাই লাইফ ইউথ স্টিফেন”- থেকে নির্মিত। হকিংয়ের প্রথম বিয়ের সমাপ্তি দিয়ে শেষ টানা সেই ম্যুভি যেই দেখেছেন সেই হকিংকে অকৃতজ্ঞ বিবেকহীন ছাড়া কিছু ভাববেন না। কিন্তু আমার আজকের পরিণত বয়সে লব্ধ স্থিরতায় কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আগে তার কার্যকারণ নিয়ে কিছু পর্যালোচনা করতে চেষ্টা করি।
একটা মেয়ে প্রেমের খুব শুরুর দিকেই জেনে গেছে তার ভালো লাগার মানুষ স্নায়ু রোগে ( মোটর নিউরন ডিজিজ) আক্রান্ত, জীবনসীমা বেঁধে দেয়া ২ বছর। আর সেই সময়েও সেই প্রেমিকের সাথে জীবনের সেতুবন্ধনে যেই মেয়ে জেদ ধরতে পারেন , সে নিঃসন্দেহে অতিমানবী। অধিকন্তু স্টিফেন হকিং তখন কেমব্রিজের এক সাধারণ ছাত্রই ছিল। তাঁর মেয়ে লুসি হকিং এর সাক্ষাৎকারে উঠে আসে তারা ৩ ভাই বোনই শিশুবয়স থেকে বাবার দেখা শোনা করে এসেছেন এবং তখন তাঁদের বাবা মোটেও কোন বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন না।
সময়ের মায়াবী স্পর্শে স্যার হকিং এর অনন্য সাধারণ মেধার স্বীকৃতি যখন মিলতে শুরু করে, তখন বিশ্ব উজাড় করে তাঁকে ধরে রাখতে তাঁর মেধার নির্যাস পেতে তাঁর ওপর ইন্ভেস্ট করা শুরু করে। তার বিশেষ চেয়ার, ভয়েস সিন্থেসাইজার সবকিছুই।
সর্ব অঙ্গ বিকল হয়ে যেন তীব্রভাবে সক্ষম, সুতীক্ষ্ণ এবং আরো শাণিত হলো তাঁর মস্তিষ্ক। তার জন্য সার্বক্ষণিক সেবিকাও নিযুক্ত হলো। এবং সেই সেবিকাও বিশেষায়িত। তিনি আর দশজন সেবিকার মত রুগীর প্রাত্যহিক কর্ম কান্ড ছাড়াও তাঁর জৈবিক চাহিদা জাগ্রত করা এবং তা মেটানোর অভিনব পন্থাও প্রয়োগ করতেন, যেটা এমন রুগী মাত্রই সাধারণত হিসেবের বাইরে থাকে।
অপরদিকে ছিল মহীয়সী স্ত্রীর সর্বময় নিঃশর্ত ভালোবাসা, যত্ন- যা জীবনসঙ্গীর সাথে মানুষ ভাগাভাগি করে, কিন্তু স্যার হকিং এর হাত পেতে নেয়া ছাড়া দেবার খাতায় কিছুই ছিল না। সেবিকার সেবা অর্থের বিনিময়ে পাওয়া, সেটায় কোন মানসিক চাপ নাই, ঋণী হবার হিসাব নাই, হীনম্মন্যতার অবকাশ নাই। বরং সেবা যথাযথ না পেলে অভিযোগের সুযোগ আছে।
মনস্তত্ববিদরা ভালো জানবেন, তবে স্যার হকিং এই নিয়ে খোলামেলা, অকপট, সৎ কোনও আলোচনা বা কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বলে শুনিনি। কিন্তু সাধারণ বুদ্ধিতে, যুক্তিতে আমি স্যার হকিংকে ছাড়পত্র দিতেও যদি হিসাব মিলাই, তিনি এই যাবজ্জীবনকালীন কৃতজ্ঞতার অসম ভার নিতে পারছিলেন না বলেই হয়তো সেবিকার সাথে গাঁটছড়া বাঁধার সিদ্ধান্তে নেন এবং জেনের সাথে ৫ বছর সেপারেশনে থেকে অবশেষে ১৯৯৫তে বিচ্ছেদের দ্বারস্থ হন।
সাহিত্যে ডক্টরেট জেন হকিংএর সাথে সম্পর্ক ফিকে হয়ে যাবার বিধ্বস্ত মুহূর্তে তার ভালো লাগার কাজ, সংগীতের দিকে ঝুঁকেছিলেন এবং ১৯৯৭ এ একজন সংগীতজ্ঞকেই বিয়ে করেন। কিন্তু, আমার পর্যালোচনা একটা খুঁটি পায় যখন জেন সবসময়েই ছায়ার মত স্টিফেনের খোঁজখবর নেয়া ও সহায়তা অব্যাহত রেখেছেন, হকিং শারীরিক অক্ষমতায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে, এর সমর্থন হিসেবে।
২০০৫ এ ২য় স্ত্রী, প্রাক্তন সেবিকার সাথে বিচ্ছেদের পর জেন স্টিফেনের পেশাদার সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং আমৃত্যু তাঁর খেয়াল রেখে যান। আজ যখন হতাশা জাগে, বিশ্বের প্রায় সব ধরনের স্বীকৃতি, সন্মান প্রাপ্তির পরেও ব্ল্যাকহোল, মর্টাল থিওরি ও মহাবিশ্বের উৎপত্তি রহস্য আবিষ্কারকের হাতে নোবেল কেন উঠলো না, তখন তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের আজীবনের হতাশাই গাঢ় হয়। কারণ, বিজ্ঞানে নোবেল পাবার প্রধানতম শর্ত, ব্যবহারিকভাবে প্রমাণিত, তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় দুরুহ এক কর্ম। যদিও বলা হয়, হকিং এর খুব কাছেই চলে গিয়েছিলেন। তবুও, কিছুই এসে যায় না। বরং নোবেল কমিটির তাঁকে নোবেল না দিতে পারার সীমাবদ্ধতার জন্য আফসোস থাকা উচিত।
স্যার হকিং বলেছিলেন মানুষের মস্তিষ্ক কম্পিউটারের মত, অকেজো হলে এর কোন ভূমিকা নেই, স্থান নেই। তেমন মস্তিষ্কের মৃত্যু হলেও তার আর পরকাল বলে কিছু নেই, মানব জীবনেরও নেই। অন্ধকারকে ভয় পাওয়া মানুষ পরকাল নামক জুজুর ভয় আর ধর্ম বানায়। তিনি তাঁর বিশ্বাস নিয়েই মারা গেছেন। এবং কাউকে সন্মান করতে হলে তাঁর বিশ্বাসকে সন্মান করতে হয়, সেই বিশ্বাস নিজের বিশ্বাসের সাথে যতই সাংঘর্ষিক হোক। তাই বিশ্বাস করি তিনিও পরকালে নন, এই জগতেই আছেন। আজীবন তিনি নিজেই স্রষ্টার এক বিস্ময়কর সৃষ্টি আর বিজ্ঞানের অসামান্য অগ্রগতির চূড়ান্ত উদাহরণ হিসেবেই থেকে যাবেন।
লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম