ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সুস্থ উড়ান বাণিজ্য

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ১০:১১ এএম, ১৮ মার্চ ২০১৮

 

পারাবাত, ইউনাইটেড, জিমএমজি- এরকম অনেক নাম ছিল বাংলাদেশের এয়ারলাইন্স ব্যবসায়। কিন্তু এরা বেশিদিন ডানা মেলে থাকতে পারেনি। বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যখন বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশে এ সেবার অবস্থা নাজুক। বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে যাত্রীবাহী এয়ারলাইন্স ব্যবসা পরিচালনার প্রথম অনুমতি দেয়া হয় ১৯৯৬ সালে। বেসরকারি খাতে যাত্রীবাহী এভিয়েশন ব্যবসার ২২ বছরের যাত্রায় এ পর্যন্ত মোট ১০টি এয়ারলাইন্স কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি পায়। তবে এর মধ্যে ৭টিই বন্ধ হয়ে গেছে।

এরপর একে একে এলো নভো এয়ার, রিজেন্ট এয়ার, ইউএস-বাংলা। ভালভাবেই চলছিল সব। কিন্তু দেশের এভিয়েশন খাত এক বড় আঘাত পেলো নেপালে। ইউএস-বাংলার একটি বিমান বিমান গত সোমবার বিধ্বস্ত হয়েছে নেপালে, মারা গেছে পাইলট, কো-পাইলটসহ ৫১ জন। প্রত্যাশা থাকবে সংকট কাটিয়ে উঠবে ইউএস-বাংলা, কাটিয়ে উঠবে বেসরকারি এভিয়েশন খাতও।

কিন্তু কিছু প্রশ্ন এর মধ্যেই উঠতে শুরু করেছে। বলা হচ্ছে বিমানটির পাইলট স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন না। তার সাথে কোম্পানির বনিবনা চলছিল না। একই অবস্থা নাকি চলছিল কো-পাইলটের সাথেও। নেপালের কাঠমান্ডুতে বিধ্বস্ত হওয়া ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের পাইলট ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান গত সোমবার নেপালে যাওয়ার আগেই পদত্যাগপত্র দিয়েছিলেন।

যদি তা-ই হয়, এমন একজনের ওপর এতগুলো মানুষের দায়ভার আকাশে উড়িয়ে দিল কি করে ইউএস-বাংলা? বিমান সংস্থাটির কর্পোরেট ব্যবস্থাপনায় সুশাসন না থাকার ইঙ্গিত এটি। বিমানটিকে কাঠমান্ডু বিমান বন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সঠিক নির্দশেনা দিতে পেরেছিল কিনা সেটিও এক বিতর্ক।

আমাদের এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের একটু নড়েচড়ে বসার সময় এখন। যারা চলছে তারা কতটা ভালভাবে উড়ছে একটু নজর দেওয়া দরকার। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের এভিয়েশন খাতের পথচলা শুরু বাংলাদেশ বিমানের হাত ধরে। অভ্যন্তরীণ সিভিল এভিয়েশন খাতের ৪৭ বছর হয়েছে। আর যদি পুরো সিভিল এভিয়েশন খাতের কথা বলি, তবে সেটি ১৯১৯ সালে যাত্রা করে। আগামী বছর শত বছর পূর্ণ হবে। এই বাস্তবতায় আমাদের এভিয়েশন খাত শতবর্ষী। এই একশ বছরে কেন তবে এমন হযবরল অবস্থা? হযবরল একারণে বলা যে, একদিকে বিমান দুর্নীতিতে বিধ্বস্ত একটি নাম, অন্যদিকে বেসরকারিগুলো এখনো সেভাবে প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়নি।

রিজেন্ট, নভোএয়ার ও ইউএস-বাংলা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করলেও বানিজ্যিকভাবে খুব একটা ভাল অবস্থায় নেই। সরকারি সংস্থা বিমান মানেই ব্যবস্থাপনার সংকট। সেবার মান বলে কিছু নেই। ফ্লাইট বাতিল, যাত্রা বিলম্ব, নিম্নমানের যাত্রীসেবা, ইউনিয়নিজম, কোটি কোটি টাকা চুরি ও লোকসান - এসবই বিমানের ইমেজ। এ দেশে এভিয়েশন ব্যবসার এমন একটা নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির জন্য পুরষ্কারের দাবিদার হতে পারে বিমান।

বিমান পরিবহন বড় ব্যয়ের ব্যবসা। একটি উড়োজাহাজের অনেক দাম। সেই টাকা বিনিয়োগ করে লাভ উঠানো সহজ বাণিজ্য নয়। উড়োজাহাজের মতো এর যন্ত্রাংশও বেশ দামী। এছাড়া এর আমদানী প্রক্রিয়াও বেশ জটিল বাংলাদেশে। এই পরিষেবার আরেকটি বড় খরচ রক্ষণাবেক্ষণে। বেসরকারি বিমান কোম্পানিগুলোর জন্য কোনো হ্যাঙ্গার নেই বিমানবন্দরে। বিদেশে বিমান মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যাপক খরচ করতে হয় বেসরকারি সংস্থাগুলোকে। ফলে বাণিজ্য টান পড়ে, সময়মত রক্ষণাবেক্ষণ করাও হয়তো সম্ভব হয় না। আবার বিমানের নিজস্ব হ্যাঙ্গার থাকা সত্ত্বেও বিদেশে যায় মেরামতের জন্য।

বেসরকারি বিমান সংস্থার জন্য হ্যাঙ্গার না থাকা, আবার থাকার পরও বিমান বিদেশে গিয়ে কাজ করানো এক রহস্যময় ব্যাপার। একটি বিমান নষ্ট হলে বিদেশে নিয়ে যেতে হয়। বিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে যায়। অথচ বেসরকারি এয়ারলাইনাররা বলছে তাদের জনবল আছে, প্রায় এক-চতুর্থাংশ খরচে এসব মেরামতের কাজ করানো সম্ভব।

বাণিজ্যিক পাইলট লাইসেন্স পাওয়া যায় বাংলাদেশ ফ্লায়িং একাডেমি থেকে। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হয় না। যখন বিমানের ত্রুটি হয়, তখন একজন প্রকৌশলী সঙ্গে সঙ্গে তা বের করতে না পারলে বিদেশ থেকে ভাড়া করে প্রকৌশলী আনতে হয়।

বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো গত ৪/৫ বছর ধরে গড়ে উঠেছে। মোটামুটি একটা আস্থার জায়গাও তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে এরা। শিডিউল মেনে চলা, সেবার মান সব মিলিয়ে মানুষ নির্ভর করতে শুরু করেছিল। নেপালের ঘটনার পর কি প্রভাব আসবে সেটা দেখার বিষয়।

এই দুর্ঘটনার পর অনেকেই অভিযোগ করছেন দেশের বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো মুনাফাকেই বড় করে দেখছে। আমি মনে করি এই মুনাফা পানে যে দৃষ্টি তা ইতিবাচক। ব্যবসা করতে নেমে লোকসান দেওযায় কোন কৃতিত্ব নেই। তবে এই ব্যবসায় নিরাপত্তার বিষয়টি বেশ বড় একটি ভাবনা। পুরনো এয়ারক্রাফট আনা, কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পাইলট, ঝুঁকিপূর্ণভাবে অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনাসহ যেসব অভিযোগ উঠেছে সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে তা আমলে নেওয়া প্রয়োজন।

দেশে সরকারি বিমান সংস্থার সঙ্গে বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোর বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা রয়েছে। যাত্রীসেবার মান ও মুনাফার দিক দিয়ে বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো অনেক এগিয়ে। কিন্তু পেশাদারিত্বের জায়গাটি কতটা হয়েছে তা নিয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে। বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর পাইলটরা কর্তৃপক্ষের ব্যাপক চাপে থাকেন। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, কুয়াশা বা নিজের নানা অসুবিধা থাকলেও তাদের ঝুঁকি নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করতে হয় বলে অভিযোগ আছে। একটি ঘটনা দিয়ে সবকিছুকে বিচার করা যাবেনা। কিন্তু সতর্ক হলে, সজাগ হলে এই উড়ান বাণিজ্য প্রসারিত হবে, সেটা নিশ্চিত।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন