ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মুনাফা হিসাবের পূর্বে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন

সাবিনা শারমিন | প্রকাশিত: ০২:৪৯ পিএম, ১৭ মার্চ ২০১৮

 

জরুরি অবস্থায় দ্রুততর সময়ে উড়োজাহাজ থেকে কিভাবে সকল যাত্রীদর নিরাপদে বের করতে হয়,জীবনের প্রথম পেশা কেবিনক্রু ট্রেনিং 'ইভাকুয়েশন প্রসিডিওর' বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ট্রেনিং সেন্টারে তা শিখেছিলাম। প্রশিক্ষণে বলা হয়েছিলো প্রতিটি উড্ডয়ন এবং অবতরণের সময়ই জরুরি অবস্থা। শুধু উড্ডয়ন এবং অবতরণ কালই নয় প্রকৃতপক্ষে আকাশে ওড়ার সকল সময়টিই জরুরি অবস্থা। কারণ, সাইত্রিশ আটত্রিশ হাজার ফুট উচ্চতায় এয়ারক্রাফটের ভেতরের সকল কিছুই কৃত্রিমভাবে ব্যবস্থাপনা করা থাকে।

তাই যাত্রাকালীন সকল সময়টিতেই সকলকেই একটি সীমিত স্থানে নিয়ম কানুন মেনে তুচ্ছ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে নিরাপত্তার বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা অত্যন্ত অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু সাধারণ যাত্রীরা নিরাপত্তার বিষয়টি যতোটা না গুরুত্ব দেয় তাঁর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় আরাম-আয়েশ, খাবার-দাবার, অনটাইম প্রস্থান এবং চিত্তবিনোদনের বিষয়গুলোতে। অনেক সময়ই যাত্রীরা বুঝতে চেষ্টা করেন না যে উড়োজাহাজ আকাশে ওড়ে। রাস্তায় নয়। সেখানে টেকনিক্যাল কারণ ছাড়াও আবাহাওয়া জনিত কারণ থাকতে পারে যা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

উড্ডয়নরত অবস্থায় যাত্রী এবং ক্রু উভয়কেই মনে রাখতে হয়, যে কোন সময় ছোটখাটো কারণেও কেবিনের ভেতর আগুন ধরে যেতে পারে। স্বাস্থ্যগত কারণে হঠাৎ কোন যাত্রীর অক্সিজেনের অভাব হতে পারে। কোন গর্ভবতী নারী যাত্রীর ডেলিভারি পেইন উঠতে পারে। যে কোন যাত্রীর হার্ট এটাক হতে পারে, ডিকম্প্রেশনে হঠাৎ অক্সিজেন মাস্ক সিলিং থেকে নেমে পড়তে পারে! যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে হতে পারে জংগল সারভাইভাল। এমনকি পানিতে জরুরি অবতরণ করার প্রয়োজন হতে পারে। তখন নামার আগে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট পরে নামতে হবে!

তাই যে কোন সময় জরুরি অবস্থায় লাইফ জ্যাকেটের প্রয়োজন পড়লে সেটিও প্রতিজন যাত্রীর জন্য সীটের নিচে লাগানো থাকে। যাত্রাকালীন স্বাভাবিক সময়তেও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে হঠাৎ এয়ারক্রাফট ডিসেন্ট করে নেমে যেতে পারে। যার অনেক কারণই যাত্রীদের পক্ষে জানা একেবারেই সম্ভব নয়। তাই সাধারণ নিরাপত্তার জন্য উড্ডয়নের পর স্বাভাবিক অবস্থাতেও সীটবেল্ট ঢিলে করে বেঁধে রাখতে বলা হয়ে থাকে। যদিও সিটবেল্ট বাঁধতে বললে অনেকেই সীট বেল্ট বাঁধতে অনীহা প্রকাশ করে।

উড়োজাহাজের ভেতর ধূমপান করা একেবারে নিষিদ্ধ হলেও এখনো অনেক যাত্রী টয়লেটে গিয়ে ধূমপান করেন। সাধারণ যাত্রীরাএও জানেননা সামান্য একটি সিগেরেটের আগুন থেকে পুরো জাহাজে আগুন ধরে যেতে পারে। কখনো কখনো ইঞ্জিন থেকেও আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। ১৯৩৭ সালের মে মাসে জার্মান বিজ্ঞানী জেপলীন অনেকগুলো এয়ারশীপ ( ইঞ্জিনের সাহায্য ভাসমানবেলুন) তৈরি করেছিলেন। সেগুলোর মধ্যে হিন্ডেনবুরগ নামের একটি এয়ারশীপ যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে অবতরণ করার সময়আগুন লেগে সকল যাত্রীর প্রাণ ভস্মীভূত হয়েছিলো। যার সূত্রপাত তখনকার দিনে যানা যায়নি।

তাই ক্র্যাশ ল্যান্ডিং এর সময় এয়ারপোর্টের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দ্রুত সার্ভিস দিতে সক্ষম হ'লে পুড়ে যাওয়া থেকে অনেক প্রাণ বেঁচে যেতে পারে। এও জানা গেছে যে উড়োজাহাজের ইঞ্জিনের ভেতর ছোট একটি পাখি ঢুকে গেলে কোন একটি উড়োজাহাজে বিরাট বিভ্রাট ঘটে যেতে পারে । প্রতিটি ফ্লাইট উড্ডয়ের আগেই কেবিন ক্রুরা যাত্রীদের ডেমোনেস্ট্রেশন করে সকল ধরনের নিরাপত্তা নির্দেশাবলী যাত্রীদের দেখিয়ে এবং বুঝিয়ে দেয়া হয়। সেই সাথে জরুরি অবস্থায় জরুরি বহির্গমন দরজা কোনদিকে চিহ্নিত করা আছে তাও দেখিয়ে দেয়া হয়। যাত্রীদের নিজেদের জীবনের প্রয়োজনেই এই নিরাপত্তা নির্দেশাবলী ভালো করে জেনে নেয়া উচিৎ।

কারণ দুর্যোগ হঠাৎ একদিন ঘটে যায়। উড্ডয়নের পূর্বে যদি ক্রুদের নির্দেশনা ভালোভাবে অনুসরণ করেন তাহ'লে তাঁরা বুঝে নিতে পারবেন যে জরুরি অবস্থায় কোন দিকে আগুন লাগলে, সে এলাকা বাদ দিয়ে কোন নির্দিষ্ট দরজাটি খুলতে হবে। সে ক্ষেত্রে ক্রুদের সাথে ব্রিফিং নিয়ে কোন কোন এবল বডিড স্মার্ট যাত্রীও সহযোগী হতে পারেন।

সম্প্রতি নেপালের ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে ঘটে গেছে ইউ এস বাংলা এয়ারলাইন্স এর মর্মান্তিক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। জাতীর জীবনে এটিএকটি করুণ দুর্যোগ। খুব সম্ভবত যতোদূর জানা গেছে উড়োজাহাজের পেছন দিকটাতে আগুন লেগে গিয়েছিলো। যার কারণে হয়তো সামনের দরজা খোলা হয়েছিলো। এবং সম্ভবত বেঁচেও গিয়েছিলো হয়তো সামনের দিকের যাত্রীরা।

পত্রিকায় এও জানা গেছে কো-পাইলট প্রিথুলা রশিদ অনেক যাত্রীদের জীবন বাঁচিয়েছেন। যদিও সেটি কেবিন ক্রুদের দায়িত্ব ছিলো। সে যাই হোক জরুরি অবস্থায় প্রাণ বাঁচানোই বড় কথা। মনে প্রশ্ন জেগেছে ,তাহলে সামনের কেবিনের ইমারজেন্সি দরজা খোলার কেবিন ক্রু কি আগেইবিপদ্গ্রস্থ হয়েছিলেন? নাকি তিনিও কো-পাইলট প্রিথুলার সাথে 'ইভাকুয়েশনে' অংশ নিয়েছিলেন? তাহলে বিষয়টি কি এমন যে তিনি ককপিট থেকে বের হয়ে সামনের দরজা খুলে দিয়েছিলেন,যাতে অনেক যাত্রী বেঁচে গিয়েছিলেন?

উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার ব্যাপারে ককপিট এবং কন্ট্রোল টাওয়ারের যে উল্টো উল্টি দোষারোপ চলছে তাতে করে সকলের মনেই এখন একটি প্রশ্ন যে, ভুলটি আসলে কাদের হ'লো ! যদিও বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানের কোনও ভুল ছিলনা বলে মনে করছেন ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ। এ পরিপ্রেক্ষিতে তাদের বক্তব্য ‘কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে পাইলটের কথোপকথনের যে অডিও বের হয়েছে ,আপাত দৃষ্টিতে সেখানে কন্ট্রোল টাওয়ারের কিছু মিস-গাইডেন্স ছিলো বলেই তাঁরা মনে করছেন।

প্রসঙ্গত বলতে হচ্ছে আকাশযান মাটি থেকে যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁদেরকে বলা হয় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার বা এটিসি । মূলত তাদের ক্লিয়ারেন্স পেলেই পাইলট ল্যান্ড করার প্রস্তুতি নেন। কে এখানে দায়ী সেটির সঠিক কারণ প্রকৃতপক্ষে তদন্ত নির্ণয় করলেও এটি বলা যাচ্ছে যে এই ভুলের কারণ কমিউনিকেশন গ্যাপ। এতে কোন সন্দেহ নেই।

যদিও প্রাথমিকভাবে ইউ এস বাংলা এয়ারলাইন্স দাবি করছেন ক্যাপ্টেনের এখানে কোনও দোষ নেই। কারণ তাঁদের যুক্তি হচ্ছে,ক্যাপ্টেন আবিদ ৭০০ ঘণ্টারও বেশি সময় ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন এবংত্রিভুবন এয়ারপোর্টে শতাধিক ল্যান্ডিং এরঅভিজ্ঞতা তাঁর রয়েছে। তবে’নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে পাইলটের শেষ চার মিনিটের কথোপকথনের যে অডিও পাওয়া গেছে তা থেকে তাঁরা আপাত দৃষ্টিতে অনেক কিছু দাবি করলেও বিষয়টি প্রফেশনালি বিশেষজ্ঞ দিয়ে তদন্ত করতে হবে।

আমজনতার রায় এখানে গণনাযোগ্য নয়। তাছাড়া ব্ল্যাক বক্সে সকল তথ্যই ধারণ করা আছে যা বের করতে কিছুদিন অপেক্ষাতো করতেই হবে। সকল তথ্য যার যার স্বার্থে গোপন করা হলেও ব্ল্যাক বক্সের তথ্য গোপন করা যাবেনা। যদিও আমাদের আশার আলো জেগে ছিলো ক্যাপ্টেন আবিদ ক্রিটিক্যাল অবস্থা হলেও হলেও বেঁচে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও সকল কথা সাথে নিয়ে চলে গেলেন !

যদিও উড়োজাহাজের নিরাপত্তার দায়টি এয়ালাইন্স কর্তৃপক্ষের,তথাপি টিকেটের ব্যয় এবং সর্বোপরি মানুষের মূল্যবান জীবনটি কিন্তু একেবারেই নিজের। তাই সকল কিছুর ক্ষতিপূরণ হলেও স্বজনদের কাছে স্বজনের জীবনের ক্ষতিপূরণ কখনোই অর্থ দিয়ে পরিশোধ করা যায় না। ককপিট ক্রু, কেবিন ক্রু, যাত্রী, এদের সকলের জীবন নির্ভর করে এয়ারলাইন্স এর উড়োজাহাজের ফিটনেসে,পাইলটকেবিন ক্রুদের উপর। কিন্তু

এয়ারলাইন্সগুলো এসকল বিষয় গুলোকে গুরুত্ব কম দিয়ে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনে মূল্য ছাড়ের বিষয়ে যাত্রীদের সাথে একরকম বড়শিতে ছোট মাছ গেঁথে বড় মাছ ধরার হটকারিতার মতোন। যাত্রীরাও সে অফার আকর্ষিত হয়ে অল্পটাকার প্যাকেজ অফার খুঁজে বড়শির টোপ গেলেন। সেটিই স্বাভাবিক। ইউ এস বাংলার টিকেট কেনার সময় যাত্রীরা কি জানতেন ত্রুটিপূর্ণ উড়োজাহাজে তাঁরা ভ্রমণ করতে যাচ্ছেন ? কি সরকারি কি বেসরকারি এই তথ্য যাত্রীদের জানানো এখন সময়ের দাবি।

তবে যাত্রীদের নিজেদেরও বুঝতে হবে যে অল্প টাকার অফারে কেমন এয়ারলাইন্স এর উপর ছেড়ে দেয়া হচ্ছে তাঁদের অতি মূল্যবান জীবনটি। কারণ অন্যান্য সকল সেবার চেয়ে 'সেইফটি ফার্স্ট' বিষয়টিতে তাদের গুরুত্ব দিতে হবে সবচেয়ে আগে। কারণ যাত্রার বাহনের নিরাপত্তার বিষয়টি অন্যান্য সকল কিছুর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ইউএস বাংলার দুর্ঘটনা হিউম্যান এরর বলেই মনে হচ্ছে।

মানুষের ভুলে এতোগুলো জীবনের করুণ পরিণতি হবে এটি মেনে নেয়া ভীষণ কষ্টের। তাই স্ট্যান্ডার্ড এয়ারলাইন্স, উড়োজাহাজ ,পাইলট, এটিসি এই সকল বিষয় বিবেচনা করা এয়ারলাইন্স নির্বাচন করার এখনই উপযুক্ত সময়। প্রয়োজনে টিকেট কাটার সময় যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো এয়ারলাইন্সগুলো জানিয়ে দিক। যাত্রীদের অর্থেই একটি এয়ারলাইন্স কোটি কোটি টাকা ব্যবসা করে টিকে থাকে। নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার কারণেই সেই সাধারণযাত্রীদের তাঁদের নিজ নিজ দায়িত্বে বুঝে নিতে হবে। এটি প্রত্যেক যাত্রীর অধিকার। কারণ মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছুই নেই।

নিরাপত্তার বিষয়ে যদি স্ট্যান্ডার্ড প্রসিডিওর অনুসরণ না করা হয় ,তবে আমি বলবো এটি নির্ঘাত হত্যাকান্ড। এ জন্য দোষী ব্যক্তিদেরউপযুক্ত শাস্তি দাবি করা যায়। যদি একজন পাইলট নির্ধারিত সময়ের বেশি ঘন্টা অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও ফ্লাই করে থাকেন তবে সেটিও বের করা হোক। এটি আমাদের সকলের জন্য একটি শিক্ষা।

আমরা জানি মানুষের মৃত্যু কোন না কোনভাবে অনিবার্য। কিন্তু অতিরিক্ত ব্যবসার উদ্দেশ্য যদি স্ট্যান্ডার্ড পলিসি অনুসরণে ফাঁকি দেয়া হয়, যদি একজন পাইলটকে নির্ধারিত সময়ের বেশি চাপ প্রয়োগ করে কাজ করানো হয় এবং সে কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটে থাকে তবে সেটি মেনে নেয়া যায় না। আর যাই হোক মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করে ব্যবসা বন্ধ করার এখনি সময়।

লেখক : ব্যবস্থাপক প্রশিক্ষণ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড।
[email protected]

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন