আকাশে মৃত্যুর হাতছানি, শোকের সাগরে ভাসছে বাংলাদেশ
এমনিতে আমার উচ্চতাভীতি আছে। কোনো উঁচু ভবনে উঠে নিচের দিকে তাকালেই ভয় ভয় লাগে, যদি পড়ে যাই। গাড়ি চালিয়ে কোনো বড় ব্রিজ পার হওয়ার সময় ভয় ভয় লাগে, যদি গাড়িসহ ব্রিজ থেকে পানিতে পড়ে যাই।
বিমান ঠিকঠাক মত ফ্লাই করার পর সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন, সিট বেল্ট খুলে আরাম করে বসেন। আর তখনই উচ্চতাভীতি আমাকে গ্রাস করে নেয়। বই পড়ে, গান শুনে, সিনেমা দেখে সময় কাটানোর চেষ্টা করি বটে; আসলে সময় নয়, ভয় কাটানোর চেষ্টা। এত যে ভয়, কিন্তু বিমানে ওঠার পর ক্রুরা যে নিরাপত্তা সতর্কতা হাতেকলমে দেখান; তার কিছুই আমি দেখি না, শুনি না। এটা কিন্তু সাহসের কারণে নয়, ডেসপারেটনেস থেকে।
বিমানে ওঠার পর নিজেকে আমি নিয়তির হাতে ছেড়ে দেই। আমি জানি বিমান দুর্ঘটনা হলে এইসব সিট বেল্ট, অক্সিজেন মাস্ক, ইমার্জেন্সি এক্সিট বা লাইফ জ্যাকেট আসলে লাইফ বাঁচাতে পারবে না। বরং কখনো কখনো মনে হয়, সিট বেল্ট বাঁধা থাকা মানেই আটকে থাকা। লাফ দিয়ে বেরোনোর সুযোগ বন্ধ করে দেয়া। এসবই আসলে এলেবেলে কথা। এসবই প্রবল মন খারাপ বদলানোর চেষ্টা, চোখের জল আড়াল করার ব্যর্থ প্রয়াস।
সাংবাদিকতা পেশাটাই এমন। সোমবার দুপুর পর্যন্ত আমরা সবাই ব্যস্ত ছিলাম বেগম খালেদা জিয়ার জামিন নিয়ে। হাইকোর্টেও চারমাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের খবর নিয়ে মাত্র খেতে বসেছি, তখনই চট্টগ্রাম থেকে এজাজ মাহমুদ ফোন করে জানালেন কাঠমান্ডুতে মনে হয় ইউএস বাংলার ফ্লাইট বিধ্বস্ত হয়েছে। খবর নাও।
বিমান দুর্ঘটনার খবর প্রায়ই শুনি। কষ্ট পাই। কিন্তু দূরের দেশ বলে বেদনা অতটা ছুঁয়ে যায় না। কিন্তু ইউএস বাংলার ফ্লাইট শুনেই মনটা ছ্যাৎ করে উঠলো। ইউএস বাংলা মানে তো বাংলাদেশীরাও থাকতে পারে। সব দুর্ঘটনা, সব মৃত্যুই বেদনাদায়ক। কিন্তু নৈকট্য বেদনা বাড়ায়। ইউএস বাংলা শুনে এটো হাতেই নিউজ রুমে দৌড়ে এসে খবর নিতে বললাম। মিনিটখানেকের মধ্যেই বদলে গেল নিউজরুমের চিত্র। নিউজরুমের সারি বাঁধা সেটে দেশী-বিদেশী সব টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজ। রোবটের মত কাজে লেগে গেলাম সবাই।
পেসেঞ্জার লিস্ট মিলিয়ে স্ক্রলে যখন নামগুলো দিচ্ছিলাম, তখনও চেনা-অচেনার বিভ্রম। বাংলাদেশটা খুব ছোট। আস্তে আস্তে খবর পেতে লাগলাম। বৈশাখী টিভির এক কর্মী ফয়সাল এই ফ্লাইটে ছিলেন শুনে সেখানকার বার্তা প্রধান অশোক চৌধুরীকে ফোন করলাম। তিনি জানালেন, ‘ফয়সাল ব্যক্তিগত কারণে ৫ দিনের ছুটি নিয়েছিল। কিন্তু নেপাল যাওয়ার কথা জানায়নি। তবে পাসপোর্ট নাম্বার মিলিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে ফয়সাল এই ফ্লাইটেই ছিলেন।’ আমি জানতে চাইলাম, ‘ফয়সালের পোস্ট কী? তিনি পাল্টা বললেন, মাত্র তো শুক্রবার আপনার সাথে দেখা হয়েছে। এখনই ভুলে গেলেন?’ চমকে গেলাম, মানে? অশোক চৌধুরী জানালেন, ‘ফয়সাল প্রধানমন্ত্রীর বিট কাভার করতেন। গত শুক্রবার এই বিটের রিপোর্টারদের নৌবিহারে ছিলেন তিনি। আপনার সাথে ফেসবুকে ছবিও দেখেছি। র্যাফেল ড্রতে তিনি প্রথম পুরস্কার ৪০ ইঞ্চি এলইডি টিভিও জিতেছিলেন।’
চট করে মনে পড়ে গেল সব। পুরস্কার জিতে তার উচ্ছ্বাস, হাসিখুশি মুখটাই মনে পড়লো শুধু। ফয়সাল কাউকে বলে যাননি। তার মামা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বাহাদুর বেপারীও কিছু জানেন না বলে জানালেন। ফয়সাল সবাইকে চমকে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চমকে দিলেন গোটা জাতিকেই। বেদনা আস্তে আস্তে কাছে আসছে, ঘিরে ধরছে, অবশ করে দিচ্ছে সব। পরিকল্পনা কমিশনের দুই কর্মকর্তা নাজিয়া আফরিন চৌধুরী আর উম্মে সালসা অফিসের কাজে যাচ্ছিলেন নেপাল। ফোন করলাম সিনিয়র সচিব ড. শামসুল আলমকে। ধরা গলায় বললেন, ৮/৯ বছর আমার সাথে কাজ করেছেন তারা। খুবই দক্ষ ছিলেন তারা। সান্ত্বনা জানাতে নাজিয়া আফরিনের বাসায় ছিলেন তিনি। কথা বলতে পারছিলেন না। সান্ত্বনা জানানোর ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন যেন।
কার কাছে যেন শুনলাম ঢাকা কলেজের ৯১ ব্যাচের একজন ছিল ফ্লাইটে। চট করে ফোন করলাম সাংবাদিক রঞ্জন সেনকে। জানালেন তাদের ব্যাচের রফিক আজম রিমু স্ত্রী-সন্তানসহ বেড়াতে যাচ্ছিলেন নেপাল। রঞ্জন তখন রিমুর শুক্রবাদের বাসায়। তার গলাও ভেজা। ৯১ ব্যাচ মানে আমার ছোট ভাই আলআমিনেরও বন্ধু রিমু। গোলাম মোর্তজা, শাকিল আহমেদ, নাজমুল তপন আরো অনেকের ব্যাচমেট। দক্ষ সংগঠক রিমুর চটপটে চেহারাটা মনে এলো। চোখে ভাসলো তার ঠোঁটের কাটা দাগটিও।
আহারে একের পর এক শোকের ঢেউ ভাসিয়ে নিতে চাইছে। আমাদের প্রেজেন্টার নেহরিন মোস্তফার বন্ধু শশীও ছিল ফ্লাইটে। প্রডিওসার বাপী সারোয়ার জানালো তার স্ত্রীর তিন সহকর্মীও ছিলেন সেখানে। আহারে কী কষ্ট। এভাবেই একের পর খবর আসতে থাকে। মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কষ্টের ঢেউও উত্তাল হয়ে ওঠে। সিলেটের রাগিব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজের ১৩ নেপালী শিক্ষার্থী পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরছিল।
দিনভর ব্যস্ততায় ফেসবুকে ঢু মারা হয়নি। মধ্যরাতে বাসায় ফিরে ফেসবুক খুলতেই দেখি হাহাকার। সারাদিনের পেশাগত কারণে সারাদিনের রোবটিক শোক রাতে জল হয়ে গলে গেল। তখন পর্যন্ত ২৫ বাংলাদেশীসহ ৪৯ জনের মৃত্যুও খবর নিশ্চিত হয়েছিল। সকালে খবর আসে পাইলট আবিদ সুলতানের মৃত্যুর খবরও। ৫০ লাশের বোঝা বড় দুর্বহ। ফেসবুকজুড়ে নানান ছবি। ফ্লাই করার আগে চেক ইন। কেউ যাচ্ছেন অফিসের কাজে, কেউ থার্ড হানিমুন করতে, কেউ সপ্তম বিয়েবার্ষিকী পালন করতে চেয়েছিলেন, কেউ ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন। একজন ৫ দিনের জন্য বাংলাদেশকে ‘বাই বাই’ বলেছিলেন। তিনি কী জানতেন, এ ‘বাই বাই’ চিরদিনের হয়ে যাবে। কত স্বপ্ন, কত হাসি-আনন্দ বদলে গেল নিমেষে। হারিয়ে গেছে কতগুলো পরিবার।
দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে নানামুখী কথা হচ্ছে। পাইলট অনীহা নিয়ে ফ্লাই করেছিলেন, বিমানটি ১৭ বছরের পুরোনো ও ত্রুটিযুক্ত; এমন কথাও ভাসছে ফেসবুকে। পাইলটের সাথে ত্রিভুবন বিমানবন্দরের কন্ট্রোল রুমের কথোপকথনের অডিও ভাসছে অন্তর্জালে। ত্রিভুবন কর্তৃপক্ষ দায়ী করছে পাইলটকে। ইউএস বাংলা বলছে, ত্রিভুবন কর্তৃপক্ষ দায়ী। বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন, দায় কার। তবে কথোপকথন শুনে মনে হয়েছে, মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝি ছিল। আর কন্ট্রোল রুমে অপ্রয়োজনীয় বাড়তি কথা শোনা গেছে অনেক। একাধিক পাইলট জানিয়েছেন, এই অভিজ্ঞতা তাদের অনেকেরই। এই এলাকার বিমানবন্দরের কন্ট্রোল রুমে অপ্রয়োজনীয় কথায় কান ঝালাপালা হয়ে যায়। বিমানের ব্ল্যাকবক্স উদ্ধার করা হয়েছে। হয়তো আসল কারণও বেরুবে। কিন্তু সেই কারণ কি ফিরিয়ে দিতে পারবে ৫০টি জীবন?
কাঠমান্ডু দুর্ঘটনা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিমান ট্র্যাজেডি। এর আগে ১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার পথে খারাপ আবহাওয়ায় বিধ্বস্ত হয়েছিল বাংলাদেশষ বিমানের একটি ফ্লাইট। তাতে মারা গিয়েছিলেন ৪৯ জন। বাংলাদেশের প্রথম নারী পাইলট রোখসানা সেই ফ্লাইটের কো পাইলট ছিলেন। তার মৃত্যু তখন কাঁদিয়েছিল গোটা জাতিকে। বেদনায় কী গভীর মিল। কাঠমান্ডু ট্র্যজেডিতেও কো পাইলট ছিলেন একজন নারী পৃথুলা। তিনিও জীবন দিয়েছেন।
এটা ঠিক কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিশ্বের সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ ও বিপদজনক বিমানবন্দরগুলোর একটি। হিমালয় দেখার লোভে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ নেপাল ছুটে যায়। কিন্তু এই বিমানবন্দরে একটাই রানওয়ে। পাহার ঘেরা এই বিমানবন্দরে ল্যান্ডিং ও টেকঅফ দুটিই বিপদজনক। এখানে ৭০টি দুর্ঘটনায় ৬৫০ জন মারা গেছে। মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। বিমান যারা চালান, যারা নিয়ন্ত্রণ করেন; তাদের সবাইকেই ঠান্ডা মাথার ও দক্ষ হতে হবে। বিমান হতে হবে ত্রুটিমুক্ত। বিমানবন্দর হতে হবে নিরাপদ। নইলে এমন দুর্ঘটনা এসে বারবার কাঁদাবে আমাদের সবাইকেই। আকাশ হয়ে উঠুক সবার জন্য নিরাপদ।
সময় সবচেয়ে বড় উপশমকারী। ৮৪এর দুর্ঘটনার বেদনা যেমন আমরা ভুলে গেছি। হয়তো কাঠমান্ডু ট্র্যজেডিও একদিন ভুলে যাবো। কিন্তু যারা স্বজন হারিয়েছে, বন্ধু হারিয়েছে; তারা এই বেদনা, এই হাহাকার বয়ে বেড়াবেন অনেকদিন। বাংলাদেশের ২৫ জনসহ যে ৫০ জন মারা গেছে, তারা সবাই এখন আমাদের স্বজন, সবার জন্য প্রার্থনা। আকাশে যারা হারিয়ে গেলে, আকাশের ওপারে তারা ভালো থেকো।
১৩ মার্চ, ২০১৮
এইচআর/জেআইএম