সফলতার সুফলটা সবার, ব্যর্থতার দায়ভারটা নিজের
মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলোর কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের আবাসিক ছাত্রী ছিলাম। কোনো কারণে মন খারাপ হলেই হলের ভেতরে বেগম রোকেয়ার ভাস্কর্যের নিচে বসে থাকতাম। মনে হতো বেগম রোকেয়া আমার আশ্রয়, যার নিচে বসে শান্তি খুঁজতাম, কিছু সময়ের জন্য হলেও অন্যরকম একটা শান্তি খুঁজে পেতাম।
এর কোনো আধ্যাত্মিক কারণ নেই, বিষয়টা ছিল একেবারেই মনস্তাস্তিক। এমনটা যে শুধু আমার বেলায় হতো তা নয়। অনেককেই বলতে শুনেছি যাই রোকেয়ার পাদদেশে বসে থাকি গিয়ে, মনটা ভালো নেই। নারীর সংগ্রাম কিংবা নারী অধিকারের কথা বলতে গেলে বেগম রোকেয়ার কথা চলেই আসে।
আজ থেকে ১০০ বছরেরও বেশি সময় আগে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া নারীদের জন্য যে চিন্তাটা করেছিলেন এখন আমাদের যারা নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেন সেসব নারীরা বেগম রোকেয়ার সেই আদর্শ কতটুক লালন করেন? সে প্রশ্ন থেকেই যায় যখন আজও একজন নারী বলেন, একজন নারীর ওঠে আসার পেছনে সবচেয়ে বড় বাধা অন্য একজন নারী। কথাটি কি সত্য না একেবারেই মিথ্যা?
এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক থাকতে পারে এবং আছেও। আমি বলব, এ বাক্যটি যতটা না অভিযোগের তার চাইতে বেশি অভিমানের। একজন নারী যখন স্বাবলম্বী হবার জন্য লড়াই করতে নামেন তখন তার চিন্তা-ভাবনাতে সেটা থাকে যে, একজন পুরুষের কাছ থেকে সহযোগিতা নাও পেতে পারেন। তাই একজন পুরুষ যখন তাকে হেয় করে, সাহায্য করতে অনুৎসাহিত থাকে তখন কিন্তু লড়াই করতে আসা সেই মেয়েটির এতটা লাগে না।
আবার তিনি যখন এমন আচরণ একজন সিনিয়র বা প্রতিষ্ঠিত অন্য একজন নারীর কাছে পান তখন তার মনে এক ধরনের অভিমান থেকেই হয়ত কথাগুলো বলে ফেলেন যে, নারীর এগিয়ে যাবার পথে সবচেয়ে বড় বাধা অন্য একজন নারী। অপরদিকে প্রতিষ্ঠিত নারীটি যখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে নিজের একটা জায়গা ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন সেই নারীটি হয়ত তার সেক্টরে নতুন একজন নারীর এগিয়ে আসায় নিজের অবস্থানটি নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন।
অনেকাংশে সেই ভয় থেকেই হয়ত কোনো কোনো নারীর মধ্যে এ ধরনের আচরণ দেখা যায়। যে কারণে তারা নতুনদের ওঠে আসার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে চান না কিংবা নানাভাবে বাধা দেবার চেষ্টা করেন। তিনি হয়ত চান না নিজের জায়টি অন্যকে দিতে, যেটি নিজে সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি হয়ত চান সবাই তাকে নিয়েই হৈচৈ করবে, মিডিয়া কাভারেজ দেবে, নারী উদ্যোক্তা বা সফল নারী হিসেবে অ্যাওয়ার্ডটি তার কাছেই থাকবে বরাবরের মতো।
এ ধরনের মানসিকতার নারীর সংখ্যা যদি ১ ভাগও হয় তবুও এ সমাজকে পরিবর্তনে নিজেকে বদলাতে হবে। নিজের প্রয়োজনে, ভবিষ্যতে নিজের কন্যা সন্তানের স্বার্থেই। বেগম রোকেয়ার আদর্শ থেকে বের হয়ে কখনই নারী জাগরণ বা নারীর উন্নয়ন সম্ভব নয়। যে কারণে এখন যেসব নারীরা নারীদের নিয়ে কাজ করেন, কথা বলেন তাদের উদ্দেশ্য ও আদর্শ আজ নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
আমরা প্রতি বছর ৮ মার্চকে কেন্দ্র করে নারীর অধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে নানা সভা, সমাবেশ, সেমিনারে সোচ্চার হই। পরবর্তীতে সেই আলোচনাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই কেবল গোলটেবিলের আলোচ্য বিষয় আর মিনারেল ওয়াটার পানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়।
তবে হীনমন্যতা বাদ দিয়ে সব নারী যদি আজ এক হই তবে পুরুষের বাধা নারীরা অতিক্রম অবশ্যই করবে। আর এ বাধা অতিক্রমের প্রথম ধাপ হচ্ছে পরিবার। পরিবারের শাশুড়িরা যদি সচেতন হোন তবে তার ঘরে পুত্রবধূর নির্যাতন হবে না। আবার অন্যদিকে ঘরের মা যদি ঠিক থাকেন তবে তিনি তার কন্যা সন্তানকে কিছুতেই দেবেন না শশুর বাড়ির নির্যাতন সহ্য করতে। মানিয়ে নাও, সম্মান যাবে সে ধারণা থেকে মায়েরা বেরিয়ে আসতে না পারার কারণেই এখনও ঘরে ঘরে নারী হত্যা, নির্যাতন ও আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েই যাচ্ছে দিনকে দিন।
তাই শুধু সেমিনার নয়, নারীদের তাদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন করতে ঘরে ঘরে মায়েদের কাছে বার্তাটি পৌঁছাতে হবে সবার আগে। ঘরের নারীদের মধ্যে এখনও সংবাদপত্র কিংবা টিভি সংবাদের চাইতে নাটক, সিনেমা বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দর্শক বেশি। তাই পত্রিকার ভেতরের কোনো পাতার কয়েকটি লাইনে সেসব সেমিনারের একটি সংবাদ কিংবা টিভির খবরের কোনো এক ফাঁকে ৪০ সেকেন্ডের একটি সংবাদ চোখ এড়িয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
তাই নারী অধিকারের ব্যাপারে ঘরের নারীদের সচেতন করতে প্রয়োজন নানা অনুষ্ঠানের। নাটক, সিনেমাগুলোতেও নারীদের অধিকারগুলো তুলে ধরতে হবে। তাই এ আন্দোলনটা হতে হবে অনেক ব্যাপক আকারে। সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোগে এক সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে। নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠায় এ আলোচনাগুলো প্রসঙ্গক্রমে উঠেই আসে। তবে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা না হয় অন্যদিন হবে।
আজ একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আমি আমার সংগ্রামের কথাটিই বলতে চেয়েছি। তাও সংবাদ মাধ্যমের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ নেয়ার মতো দুঃসাহস আমি দেখিয়ে ফেলেছিলাম ২০১০ সালে। যেখানে এ সেক্টরের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরাও উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে আর যার ফলস্বরূপ কিছুদিন পরেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। উদ্যোগ নিলে পেইন নিতেই হবে এমন ধারণা পাকাপোক্তই ছিল মনে এবং সফলতার লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথটা এতটা মসৃণ হবে সেটাও প্রত্যাশা করিনি।
তবে ৮ বছরের পথ চলার সফলতা, ব্যর্থতার মাপকাঠিতে যখন নিজেকে বসিয়েছি তখন প্রতিবারই মনে হয়েছে সফলতার সুফলটা সবার। আর ব্যর্থতা ও সংগ্রামের পথটা একেবারেই একার, নিজের। এখানে কেউ আসে না ভাগ বসাতে। শুরুতে নানান আশঙ্কা, সংশয়, বাধা বিপত্তি কাটিয়ে আমার মাসিক লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ‘লুক’ এক বছরের মাথায়ই আলোর পথে পা বাড়াল। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়াজাল থেকে আমিও বেরিয়ে আসতে পারিনি। আমাদের দেশের পুরুষরা এখনও একজন নারীর অধীনে কাজ করাটা মেনে নিতে পারেন না।
আর সেই মেনে না নেয়ার অপারগতাটাকে প্রয়োগ করেন ভিন্ন কৌশলে। বিষয়টি বলতে গেলে অনেকটা এ রকম যে, আমার প্রতিষ্ঠান অথচ আমাকে সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা সব সময়ই ছিল গুটি কয়েক কর্মীর উদ্দেশ্য। বড় বড় ইভেন্ট থেকে আমাকে সরিয়ে রাখা হতো। এমনকি কখনও কখনও ইনভাইটেশন কার্ডটি আমার হাত পর্যন্ত পৌঁছানো হতো না। যেহেতু পূর্বে আমার কাজ ছিল মেইনস্ট্রিম সংবাদ মাধ্যমে। ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল সংবাদ মাধ্যমের জগৎটা তখনও ছিল আমার কাছে অনেকটা অচেনা। তাই এ সেক্টরে কাজে অভিজ্ঞ তেমন কয়েকজনকে নিয়োগ করতে হয়েছিল।
যারা সব সময় চেষ্টা করে গেছে আমাকে দূরে রেখে নিজেদের পরিচিতিটা বাড়ানোর। বাইরে তারা একদিকে প্রতিষ্ঠা করেছে আমি এসব সামাজিকতা অপছন্দ করি অথবা এতটা সোশ্যাল না। আমি এসব কিছু বুঝেও পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে গেছি যাতে আমার পত্রিকাটিকে দ্রুত ব্রেক ইভেনে নিয়ে আসতে পারি। এমনিতেও ব্যক্তিগত প্রচারণায় আমি সব সময়ই থাকতাম কিছুটা আড়ালে।
একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে আমি কর্মীদের কাজের সুন্দর পরিবেশ, যথোপযুক্ত সম্মানী ও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পরও অনিয়মিত অফিস করাটা তারা ফ্যাশনে পরিণত করে নিয়েছিল। আমাকে বলা হতো বাইরে অনেক কাজ করতে হয়েছে। এবং স্টাফদের সেভাবে কাজ করতে বাধ্য করা হতো। কেউ সম্পাদকের কাছে অভিযোগ করতে পারে সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হলে আমাকে এসে বোঝানো হতো, সে অযোগ্য কর্মী তাকে যেন বাদ দেয়া হয়।
এছাড়াও প্রযোজনের তুলনায় বেশি কর্মী নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে আমাকে বাধ্য করা হয়েছিল। আমি আগেও বলেছি লাইফস্টাইল সংবাদ মাধ্যমের জগৎটা আমার কাছে তখনও এতটা পরিচিত না থাকায় এবং প্রতিষ্ঠান চালানোর পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় আমাকে তাদের ওপর বিশ্বাস ও নির্ভর করতে হয়েছিল অনেকাংশে। আর সে সুযোগটা তারা নিয়েছে।
এসব কিছু বুঝেও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করে গেছি সবার আগে প্রতিষ্ঠানটিকে সফল করার। এরই মধ্যে ‘লুক’ দেশের প্রথম সারির ম্যাগাজিনের জায়গায় স্থান পেয়ে যায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। কিন্তু এগিয়ে যাবার পথে হুট করেই ছন্দপতন ঘটে যখন আর্থিক সাহায্যদাতা প্রতিষ্ঠানটি সরে দাঁড়ায়। যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে ব্রেক ইভেনে নেবার জন্য মিনিমাম তিনটি বছর সময় দিতে হয় সেটি আমি তাদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। হঠাৎ মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থায় আমি সব কর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রতিষ্ঠানটি কিভাবে টিকিয়ে রাখা যায় এবং এ ব্যাপারে সবার মতামত নিই।
তারা আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে কোনভাবেই যেন বন্ধ করা না হয় অন্তত তাদের দিকে চেয়ে হলেও। সেজন্য আমাকে অনুরোধ করা হয়। এবং সবাই মিলে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন তারা। কিন্তু ঠিক তখনই একেক জনের একেক রকম উদ্দেশ্য আমার কাছে পরিষ্কার হতে থাকে। আমি বুঝতে পারলাম তাদের গুটি কয়েকের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল আমার ম্যাগাজিনের অংশীদার হওয়া এবং এক পর্যায়ে আমার তিল তিল করে গড়ে তোলা নিজের সন্তানের মতো পত্রিকাটিকে তারা আমার কাছ থেকে কিভাবে ছিনিয়ে নেয়া যায় সে চেষ্টা চালাতে থাকে গোপনে।
বিষয়টি জানার পর আমি শুধু ভেবেছি পত্রিকা বের না হলেও একে আমি কিছুতেই অন্যের কাছে দিতে পারব না। শুরু হয় আমার একার লড়াই। লড়াইটা যে শুধু কাজের তা নয়। মূল চাপটা আসে আর্থিকভাবে। নিয়মিত স্টাফ সেলারি, পূর্বের প্রিন্টিংয়ের কিছু বকেয়া অর্থ পরিশোধের চাপ আমাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। সময়মতো বিজ্ঞাপনের টাকা সংগ্রহ করতে যখন হিমশিম খাচ্ছিল আমার মার্কেটিং তখন আস্তে আস্তে কর্মীদের বেতন-ভাতা অনিয়মিত হবার এ সব চাপ মানসিকভাবে আমাকে নিতে হচ্ছিল।
আমি এ সব অর্থ পরিশোধের জন্য কয়েকটি ব্যাংকে লোনের জন্য দৌড়াদৌড়ি করলেও কেউ লোন দিতে রাজি হয়নি। কোনো সংবাদ প্রতিষ্ঠানকে লোন দেয়া হয় না বলে ব্যাংকগুলো থেকে আমাকে জানানো হয়। অথচ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংকগুলো সচরাচরই সহজ শর্তে লোন দেয়ার কথা বলে। এখানে ব্যর্থ হয়ে আমি দেখা করলাম দেশের নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করা প্রথম সারির একটি সংগঠনের প্রধানের সঙ্গে। তিনিও আমাকে সহায়তার তেমন কোনো আশ্বাস দিতে পারেননি। বুঝতে পারলাম সংবাদ মাধ্যমের মতো একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগে আগ্রহী নয় কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
অথচ সবকিছুর সফলতা টাকার অঙ্কে আসে না সেটা আমি বুঝতে পারলেও শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা সেটা বুঝতে পারেননি। কিন্তু আমি যেখানেই গিয়েছি সবারই প্রশংসা ছিল পত্রিকাটি নিয়ে। যেন তাদের কাছে নিয়মিত পাঠাই সেটাও বলতেন কেউ কেউ। কেউ কেউ ভারতের ‘সানন্দা’র সঙ্গেও তুলনা করতেন। কিন্তু ম্যাগাজিনটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার মতো আশ্বাস কেউ দিতে পারেননি। দুই একজন যারা এগিয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যেও ছিল ভিন্ন উদ্দেশ্য। অতঃপর আমাকে সরে আসতে হয়েছে।
বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে ভারতের ‘সানন্দা’ ম্যাগাজিনের মতো ম্যাগাজিন নাই। কিন্তু আমরা হয়তো জানি না এ ধরনের কোয়ালিটির একটা ম্যাগাজিন করতে গেলে এর পেছনে কি পরিমাণ ইনভেস্টমেন্ট দরকার হয়। এর প্রতিটি পৃষ্ঠায় আলাদা আলাদা কাজ করতে হয়। বেশিরভাগ ইনভেস্টাররা মনে করেন মাসিক একটা ম্যাগাজিনের পেছনে কেন এত খরচ করতে হবে? যে কারণে ম্যাগাজিনে ইনভেস্টে প্রথম দিকে তারা এগিয়ে আসলেও কোনো ইনভেস্টারই এক বছরের বেশি আর্থিক সাপোর্ট দিতে চান না। এটাকে মনে করে থাকেন খুবই ছোট একটা জায়গা।
আজ ভারতের ‘সানন্দা’ ম্যাগাজিনের নাম বাংলাদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই জানেন। এমনকি একটা সময় শিক্ষিত নারীরা নিজেদের ড্রয়িং রুমে ‘সানন্দা’ রাখাটাকে গৌরবের মনে করেন। যদি ম্যাগাজিন ক্ষুদ্র জায়গা হতো তবে তারা এ পজিশনে আসতে পারতো না। এমনকি ভারতের চাইতেও ‘সানন্দা’র পাঠক সংখ্যা বাংলাদেশে বেশি । তাই আমাদের চিন্তা-ভাবনার দৈনতার কারণেও একটা ম্যাগাজিন টিকে থাকতে পারে না। যদি না সেই ম্যাগাজিনের সম্পাদক নিজেই ইনভেস্টর হন। এখানেও একটা চিন্তা আমাদের দেশে যারা ম্যাগাজিনগুলোতে কাজ করেন তাদের অস্তি মজ্জায় মিশে আছে।
তারা মনে করেন, নারী সম্পাদক মানেই অনেক টাকার মালিক হবেন। তার নিজের ইমেজ বৃদ্ধি করতে ম্যাগাজিনটিকে টিকিয়ে রাখবেন। তাই আমাদের দেশের ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল পত্রিকার জায়গায় প্রফেশালিজম আজও তৈরি হয়নি। আমার যেহেতু একজন সৌখিন এডিটর হবার কোনো ইচ্ছে ছিল না শুধুমাত্র নিজের প্রফেশনের জায়গা থেকেই আমি কাজটি করতে চেয়েছি সে কারণে কর্মীদের তথাকথিত সম্পাদকের ভাবমূর্তি আমার মধ্যেও তারা না পেয়ে কিছুটা হতাশ থাকতো। তাদের চিন্তা ভাবনাটাই এমন ছিল যে, সম্পাদক যখন একজন নারী তিনি হবেন অনেক টাকার মালিক, তিনি তার অন্য বিজনেস সামলাতে ব্যস্ত থাকবেন, খুব সুন্দর করে পরিপাটি হয়ে মাঝে মাঝে অফিসে আসবেন এবং সাইন করে চলে যাবেন।
ইনভেস্টারের অভাব, প্রফেশনালিজমের অভাবের পাশাপাশি বাংলাদেশে একটি ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠিত হতে না পারার আরও একটি কারণ হচ্ছে বিজ্ঞাপন দাতা প্রতিষ্ঠাগুলোর মানসিকতা। দু’একটি প্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে বেশিরভাগই তাদের বিজ্ঞাপনের রেট রেখে দিয়েছে আজ থেকে দশ পনেরো বছর আগের সে রেটেই এবং সময়মতো বিজ্ঞাপনের টাকা কালেকশন করতে না পারাটাও একটা অন্তরায় বটে। কিন্তু গত বছরগুলোতো সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে স্টাফদের সম্মানী দ্বিগুণেরও বেশি করতে হচ্ছে। তাই আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্যটি বজায় রাখাটা একটু কঠিন হয়ে দাঁড়ায় এক্ষেত্রে।
তবে এখনও আমি পুরোপুরি হতাশ নই। আগের মতো না হলেও ‘লুক’ কিন্তু বন্ধ হয়ে যায়নি। তবে গত কয়েক বছরে সফলতার পথে হাঁটতে না পারলেও আমি শিখেছি কিছুটা। একটি প্রতিষ্ঠান চালানোর পুরো অভিজ্ঞতাই এখন আমার আছে আর আমি শুধু সে সাহসটুকু রেখেই এটি বের করে যাচ্ছি, সুন্দর সকালের প্রত্যাশায়। যে যুদ্ধটা কেবলই আমার একার। যখন পরিবার থেকেও চাপ আসে এটাকে বন্ধ করে দেবার তখন কিছুটা ভেঙে পড়লেও আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা থাকে। আর সে প্রতিজ্ঞা ও সাহসটুকুই রেখে যাই আবারও সফলতার পথে হাঁটার প্রত্যাশায়।
এমআরএম/পিআর