রসিক দেখে প্রেম করিও
সংসারী এক ভদ্রলোক। সন্তানের পিতা। ঘরে স্ত্রী রয়েছেন। এরই মধ্যে অফিসে সহকর্মী হিসেবে পেলেন এক আকর্ষণীয় তরুণীকে। মাত্র চাকরিতে ঢুকেছেন এই তরুণী। এখনো বিয়ে করেননি। ভদ্রলোক(!) হঠাৎ করেই একেবারে অগাধ জলে পড়লেন। তরুণীরও জলে ডুবতে আপত্তি নেই, কারণ ভদ্রলোকটিকে বেশ উচ্চ পদস্থই বলা যায়। তিনি এতই প্রেমে ভেসে গেলেন যে, স্ত্রী ও সন্তানদের ছেড়ে তরুণীকে বিয়ে করলেন।
ভালো কথা। আসল গল্প শুরু হলো এর পর। কয়েক বছরের মধ্যে ওই তরুণী আরও কয়েকটি লোকের সঙ্গে প্রেম প্রেম খেলা খেলে শেষ পর্যন্ত এক ধনী ব্যক্তির হাত ধরে বিদেশে পাড়ি জমালেন। প্রবল আত্ম মর্যাদাবোধ সম্পন্ন সাবেক স্ত্রী আর বিপথু স্বামীকে গ্রহণ করেননি। সন্তানরাও বাবাকে বেশ ঘৃণাই করে কারণ তাদের সংকটে ফেলে পিতা অনায়াসে চলে গিয়েছিলেন। প্রায় বৃদ্ধ লোকটি এখন একা। দীর্ঘশ্বাসই বিশ্বস্ত সঙ্গী।
আরেকটি গল্প। নিতান্ত কম বয়সে এক প্রবাসীর সঙ্গে বিয়ে। তারপর থেকেই শ্বশুরবাড়িতে আছেন কিন্তু স্বামীর দেখা পান বছরে বা দুই বছরে মাত্র এক মাস। সন্তানও হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিবেশী এক যুবকের সঙ্গে প্রেম। প্রেম এত তীব্র যে গয়নাগাটি ও নগদ টাকা নিয়ে একসময় ঘরও ছাড়লেন। তারপরের পরিণতি তো অনেকেই আন্দাজ করে ফেলেছেন নিশ্চয়ই। টাকাপয়সা, গয়না নিয়ে যুবকটি চম্পট দিয়েছে। শুধু তাই নয়, নারীটিকে পাচারও করে দিয়েছে সীমান্তের ওপারে।
বিদেশের পতিতালয়ে দিনকাটানো নারীটির হতাশ দীর্ঘশ্বাস পড়ে শুধু সন্তানদের কথা ভেবে। আগেই বলেছি গল্পগুলো প্রেমের নয় বরং প্রতারণার। আর এই প্রতারণাগুলো ঘটেছে প্রেমের ছদ্মবেশে। আবার ভালোবেসে, প্রতারিত হয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। প্রতারিত না হয়েও হয়তো অভিমানেও অনেকে আত্মহত্যা করছেন। কোনটাই কাম্য নয়।
ভালোবাসা, প্রেম মানুষের মহত্তম অর্জন। কিন্তু ভালোবাসা কখনও অন্যকে আঘাত করার, প্রতারণা করার জন্য নয়। এজন্য প্রেমের ছদ্মবেশের প্রতি সতর্ক থাকাটা জরুরি। আজকাল সাইবার প্রেম সবচেয়ে জমজমাট। সেই সঙ্গে প্রতারণার খেলা আরও বেশি জমেছে।
কে কার ইনবক্সে কী লিখেছে সেসবের স্ক্রিন শট ভাইরাল হচ্ছে দ্রুত। ভালোবাসার ভিত্তিভূমি হচ্ছে আস্থা। কিন্তু সেই আস্থার ভিত্তিটাই নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। সাইবার প্রেমে প্রতারণা অনেক অনেক বেশি। কারণ হলো মুখোমুখি যখন দেখা হয়, কথা হয় কোন মানুষের সঙ্গে তখন পরস্পরের কথাবার্তা, ভাবে ভঙ্গিতে আসল নকলের ফারাক কিছুটা হলেও করা যায়।
ফেসবুকে, ম্যাসেঞ্জারে প্রেম করতে গিয়ে আসল নকল বোঝা ভারি মুশকিল। অনেক সময় মানুষটা নারী না পুরুষ তাও বোঝা ভার। সাইবার যুগের আগে ছিল টেলিফোনে প্রেমের যুগ, তার আগে ছিল পত্রমিতালির যুগ। টেলিফোনে কণ্ঠ শুনে তবু ভালো-মন্দ কিছু বোঝা যেত। তবে চোখের দৃষ্টি বোঝা যেত না বলে প্রতারণাও চলতো দেদার।
আর চিঠিতে চলতো বিস্তর ঠকবাজি। একজনের চিঠি অন্যে লিখে দেওয়ার ঘটনা ঘটতো আকচার। দিন যাচ্ছে, প্রতারণার খেলা আরও জমছে। এখনকার সবচেয়ে জমাট খেলা হলো অন্তরঙ্গ সময়ের দৃশ্য গোপনে ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়া। ব্ল্যাকমেইল, প্রেমিকাকে ডেকে নিয়ে গণধর্ষণ, প্রেমিককে লুটপাট এসব তো এখন ডালভাত। সত্যিকারের প্রেম তো এখন বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি। প্রকৃত প্রেম শব্দটি বলতে চাচ্ছি না। কারণ প্রেম হলো প্রেম। তার আর প্রকৃত-অপ্রকৃত কি? বরং হতে পারে প্রেম ও অপ্রেম।
আজকাল অপ্রেমই বাজার দখল করে আছে। প্রেমের মুখোশ পরে অপ্রেম রাজত্ব করছে। কিন্তু তাই বলে প্রেম কি নেই? অবশ্যই আছে। এখনও একের জন্য অন্যের স্বার্থত্যাগ রয়েছে। এখনও চিরদিন বিশ্বস্ত থেকে প্রেমকে বুকে ধারণ করছেন অনেকে।
এখনও প্রিয়জনকে কাছে না পাওয়ায় অন্তরে দুখের নদী লালন করে চলেছেন প্রেমীরা। তবে এটা ঠিক যে প্রেম যত নিভৃত ততোই তা খাঁটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ ফুটা কলসি বাজে বেশি একথা তো চিরকালীন। প্রকাশ্যে যে প্রেমের প্রদর্শনী যত বেশি তার মেকি হওয়ার আশংকা তত বেশি। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।
আমার কাছে প্রেমের প্রকাশ্য প্রদর্শনীকে খুব রুচিকর বলে মনে হয় না। প্রেমের মতো মহৎ অনুভূতির জন্য নিভৃতি, আব্রু, লজ্জাশীলতার প্রয়োজন অন্তত কিছুটা হলেও। আর প্রেমকে সময়ের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেওয়া জরুরি।
বানের জলের মতো যে প্রেম আসে তা দুদিন পর চলে যায়। রেখে যায় কিছু ক্লেদাক্ত স্মৃতি। আর সময়ের কষ্টিপাথরে যে প্রেম ও প্রেমী উত্তীর্ণ তা চিরকালীন। তা আজীবন এমনকি মৃত্যুতেও অমলিন। তা ‘ন হন্যতে’। শরীর বিগত হলেও এই প্রেম মরে না বা তাকে হনন করা যায় না।
তাই বলি, ওরে মন, রসিক দেখে প্রেম করিও।
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/জেআইএম