ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলা : অবহেলাহীন নিরাপত্তা চাই
আমার বিষণ্ণ বয়ঃসন্ধিতে যেসব বিষয়ে একটু আনন্দ পেতাম তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল, বই। একুশের বইমেলায় বড় একটা ব্যাগ নিয়ে আমি আর আম্মা যেতাম আর মুষ্টির চাল সংগ্রহের মত এ স্টল থেকে সে স্টল ঘুরে ঘুরে বই কিনতাম। টাকা শেষ হয়ে যেত কিন্তু বই কিনে মন ভরত না। পরে ধার করে কিনতাম। এই সময়টাতে অন্ধের মত হুমায়ূন আহমেদ পড়তে পড়তে মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর লেখার সাথে পরিচয়।
আস্তে আস্তে দেখলাম, ওনার লেখা হুমায়ূন আহমেদের চেয়েও বেশি ভাল লাগছে। কোন এক মেলায় ওনার সাথে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। ওনার লেখা ‘প্রেত’ বইয়ের পাতায় অটোগ্রাফ জুটেছিল যেটা পরবর্তীতে আমার এক স্যার পড়তে গিয়ে ফেরত দেননি। জাফর স্যার কে দেখে মনে হয়েছিল, এমন মানুষকে দেখলেও আলোকিত হওয়া যায়। তার পায়ের কাছে বসে থাকলেও অনেক কিছু শেখা যায়।
প্রথম দেখায় কিছু না জেনেই শ্রদ্ধা আসে। সেই মানুষটিকে আরেকজন মানুষ (?!) আঘাত করেছে, তাও পেছন থেকে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন। আমি ঠিক জানিনা, বাংলাদেশের একটি বিশেষ শ্রেণি ওনার প্রতি এত অশ্রদ্ধা, এত বিদ্বেষ পুষে বাড়ছে কেন?
যখন কোন রোগের প্রকোপ বাড়ে, তখন মেডিকেল বোর্ড গঠন করে আমরা রোগের কারণ অনুসন্ধান করি। এই রোগের আসল কারণ কি? বাংলাদেশে প্রগতিশীল লেখকদের ওপর হামলার ইতিহাস নতুন নয়। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব মতবাদ বিশ্বাস থাকে, যে যার মত করে চর্চা করে নিজস্ব জীবনাচরণ।
তাকে শ্রদ্ধার বা ভদ্রতার দৃষ্টিতে দেখা বা এড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারটিতে যেখানে ব্যত্যয় ঘটে অঘটন কি সেখানেই ঘটে? তাহলে জাফর স্যারের ব্যাপারে রোষ কেন? তার লেখায় উগ্র কিছু তো পড়িনি কখনও। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ বলে, নাকি মুক্তচিন্তা ও তার প্রকাশে যারা কাজ করেন তাদের বেঁচে থাকার অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন বলে এমন আক্রমণ?
আমি খুব সাধারণ মানুষ। কোন উচ্চমার্গের পাঠকও নই। লেখালেখির চেষ্টা করি যার কিছুই হয় না বলে আমার ধারণা। সেই আমার মত মূর্খ লেখক তার সর্বশেষ বইটি যার নামে উৎসর্গ করল তিনি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। আমার দুর্ভাগ্য, তাকে ব্যক্তিগত ভাবে বইটি দিতে মেলায় গিয়ে একটুর জন্য পাইনি। যদিও, তিনি আমার মত মানুষের বই নিজেই কিনতে চেয়েছিলেন।
স্যারকে কি কখনো জানাতে পারব, হাত কাটা রবিন, টুকুনজিল, স্কুলের নাম পথচারী, আর সায়েন্স ফিকশনগুলো কি ওপার মুগ্ধতায় পড়েছি। আমার কৈশোর থেকে আজ পর্যন্ত একাকীত্বগুলো মানবিকতা, দেশপ্রেম, হাস্যরসে পরিপূর্ণ হয়েছে তাঁর লেখনীতে। পরিতৃপ্ত হয়েছে, প্রবন্ধ, ভ্রমণ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা অথবা কোন বিপর্যয়ে পত্রিকায় তার ছোট একটা লেখায়। মাঝে মাঝে ভাবি, কত সৌভাগ্য শাবিপ্রবি’র ছাত্র ছাত্রীদের যারা মুহম্মদ জাফর ইকবালের মত একজন শিক্ষক পেয়েছেন।
এতক্ষণ এত এত মুগ্ধতার কথা বললাম, কারণ, আমি ঠিক বুঝতে পারি না, একজন মুক্তিযোদ্ধা বাবা ও রত্নগর্ভা মায়ের সন্তান, যিনি বিদেশের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের কথা না ভেবে এই দেশে সরকারী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে এলেন, যার কথায় সব সময় আশার কথা আলো’র কথা ভাসে তার প্রতি ঘৃণা, দ্বেষের প্রকৃত কারণ কি?
সরকার হয়তো তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় তদন্ত করবেন। কিন্তু যখন তাঁকে হামলা করার কোন নিউজ লিংকের নিচে, হত্যা সমর্থিত বা অমার্জিত মন্তব্য দেখা যায় তখন কি বুকটা আঁতকে ওঠে না? এই আতঙ্ক কে রোধ করতে পারবেন?
গুপ্ত হত্যা, পেছন থেকে আক্রমণ কারা সমর্থন করেন, কীসের জন্য সমর্থন করেন, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা ও তাদের চিহ্নিত করা জরুরি। শুধু তাই নয়, কারা বা কি আদর্শ তাদের মনে এই অসহিষ্ণুতার বীজ মহীরুহ পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে তার প্রকৃত তদন্ত হওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি।
একজন আক্রমণকারীকে আইনের আওতায় নিলেই সব ফুরায় না। সমাজ, শিক্ষা, জীবনাচরণের সঠিক বিশ্লেষণ, ভাল’ খারাপ’এর নিক্তি আমাদের বোধহয় চোখে আঙুল দিয়ে আবার শেখাতে হবে। কারো মত বা লেখা ভালো না লাগলে তাঁকে দৈহিক ভাবে আক্রমণ করা মানবতা বিবর্জিত এবং মানবতা’র ওপর কিছু হতে পারে না এই সভ্য ও চির সত্য বচন আমাদের মানতেই হবে।
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল আমাদের দেশের সম্পদ। তিনি আমাদের শিশু কিশোরদের মনে বিজ্ঞান নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন। তাঁর উপর হামলা, আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর দেশের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি। আমরা ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর অবহেলাহীন নিরাপত্তা চাই। আমরা এই দেশের নাগরিক। আমরা আমাদের নিরাপত্তা চাই।
লেখক : সঙ্গীত শিল্পী, লেখক।
এইচআর/পিআর