আশার আলো
দেশের অনেক সমস্যা নিয়ে অনেক সময়ই লিখি। সমালোচনা করার জন্য নয়, বরং মনের কষ্ট থেকে লিখি। আশা করি একদিন সমস্যা গুলোর সমাধান হবে, হতেই হবে। এইবার ভাবলাম, আমি হয়তো বেশি নেতিবাচক ভাবে ভাবছি, চেষ্টা করে দেখি দেশের কোন কোন ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে সেগুলো নিয়ে লিখতে। সত্যি কথা বলতে কী, নিজের চোখে দেশের কিছু কিছু উন্নতিকে কাছ থেকে দেখে আমার মনে হয়েছে আসলেই আশার আলো পুরোপুরি নিভে যায় নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা অনেক উন্নতি করেছি।
বাংলাদেশ গ্রাম প্রধান দেশ। তাই দেশের প্রকৃত অবস্থা যাচাই করতে হলে গ্রামের চিত্রটা জানা দরকার। শুধু শহর ভিত্তিক উন্নতিকে দেখে খুশি হলে, সেটা হবে অনেকটা বাইরের আবরণ দেখে ভুল ধারণা করা। এবার শীতে অনেক দিন পরে গ্রামে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। একাধিক গ্রামে। মফস্বল শহরেও। গ্রাম গুলো দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। না, গ্রামের সৌন্দর্য বা মানুষের আন্তরিকতা বা আতিথেওতায় নয়, সেটা সব সময়ই ছিল।
আমি মুগ্ধ হয়েছি, আশার আলো দেখেছি গ্রামের উন্নয়ন দেখে। গ্রামের মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন, শিক্ষিত। তাদেরকে আর এখন পুরোপুরি অজ্ঞ, মূর্খ বলা যায় না। আমি এক আত্মীয়ের সাথে গিয়েছিলাম যিনি কিছু দান সামগ্রী নিয়ে গিয়েছিল। আমি আশঙ্কায় ছিলাম যে মানুষের ঢল নামবে, অনিয়ন্ত্রিত মানুষ তাদের ভাগ পেতে কামড়া কামড়ি করবে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, মানুষের সংখ্যা খুবই সীমিত এবং নিয়ন্ত্রিত। তারা নিয়ম করে লাইন দিয়ে জিনিস নিচ্ছে। কোন ধাক্কাধাক্কি পর্যন্ত নেই। অত্যন্ত সুশৃঙ্খল জনগোষ্ঠী।
আমি কোন সুস্থ, সবল তরুণকে দান নিতে আসতে দেখি নি। এসেছে বৃদ্ধ, বৃদ্ধা বা মহিলারা। আরেকটি জিনিস খুব আশাপ্রদ লেগেছে, কারোর সাথেই আমি এক পাল বাচ্চা কাচ্চা দেখি নাই, যা আগে খুব সাধারণ দৃশ্য ছিল। বেশির ভাগ পরিবারেই একটি, দুটি শিশু। তার মানে পরিবার পরিকল্পনা কাজ দিচ্ছে। এটা বিরাট একটা আশার ব্যাপার। আমার ধারণা, মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরিতে এবং বিভিন্ন আধুনিক চিন্তা ধারণা, বা জ্ঞান বিস্তারে মোবাইল ফোন এক বিরাট ভূমিকা রাখছে, যেটা আরও অনেক বেশি বাড়ানো যেতে পারে।
আমি মাইলের পর মাইল হেঁটেছি। আমার চোখে অত্যন্ত হত দরিদ্র মানুষ পড়েছে খুব কম, সঠিকভাবে বলতে গেলে মাত্র একজন মহিলাকে দেখেছি। অর্থাৎ, গড়পড়তায় গ্রামের মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো হয়েছে। তাদের সাথে কথা বলে দেখেছি, তারা বলেছে এখন না খেয়ে কোন মানুষই থাকে না। হাল চাষের ক্ষেত্রে লাঙ্গলের ব্যবহার একদম উঠে গেছে। ট্রাক্টর দিয়েই সব জায়গায় চাষ হচ্ছে। আমরা কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যাবহার করছি।
এবার অন্য একটি প্রসঙ্গে আসি। নারীর উন্নয়ন, নিরাপত্তা। দেশের সার্বিক উন্নতি করতে হলে এই অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে অবহেলা করা যাবে না কোনভাবেই। আশার কথা মেয়েরা পড়ছে, স্কুলে যাচ্ছে। মেয়েরা ঘরের বাইরে আসছে, কাজ করছে। একজন গৃহবধূর সাথে কথা হল। তিনি উচ্চশিক্ষিত। স্বামী বিদেশে থাকেন। দুটি সন্তান নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে সংসার চালাচ্ছেন। একা। তিনি জানিয়েছেন, তিনি নিরাপত্তা জনিত কোন সমস্যা মোকাবেলা করেন নি। নিজেই সব রকমের বাজার করেন, দরকার হলে দুরের বাজারে মাসে একবার যান। বাচ্চাদের ডাক্তার দেখানো, পড়ালেখা থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ তত্ত্বাবধায়ন একাই করছেন।
এই স্বাবলম্বী রূপ আমাকে মুগ্ধ করেছে, আরও বেশি ভালো লেগেছে যে তিনি নিজেকে নিরাপদ ভাবছেন এটা দেখে। তবে নিরাশার কথা হল, মেয়েদের এখনো অনেকেরই স্কুলের সীমানা না ডিঙ্গোতেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। বাল্য বিবাহের আইনে যে ফোকর রয়ে গেছে, সেটাকে না বুঝলে কিন্তু এই সর্বনাশ ঠেকানো যাবে না। সতর, আঠারোতে মা হয়ে যাওয়া একটি মেয়ের কাছ থেকে দেশ কী আশা করতে পারে, বা তার পরিবার?
গ্রামে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, শৌচাগার এগুলো অনেক উন্নত হয়েছে। রাস্তা ঘাটও অনেক ভাল হয়েছে। তবে, দেশের প্রধান সড়ক গুলোর অবস্থা নিয়ে আমার অনেক ক্ষোভ, সে প্রসঙ্গে আরেকদিন লেখা যাবে। বলাই বাহুল্য গ্রামের পরিবেশ এখনো অনেক নিষ্কলুষ। বাতাস হাল্কা। নিশ্চিন্তে টিউব অয়েলের জীবাণুমুক্ত পানি খাওয়া যাচ্ছে। সব মিলিয়ে অনেক স্বাস্থ্য সম্মত পরিবেশ।
মফস্বল শহরের অবস্থাও খারাপ না। শহরের সুযোগ সুবিধা আছে, কিন্তু ভিড়, জ্যাম অনেক কম। বাতাস অনেক নির্মল। তরুণ প্রজন্ম অনেক খবর রাখে। দুটো জিনিস ভালো লাগে নি, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর মাদকাসক্তি, এগুলো নিয়েও পরে একদিন আলোচনা করব। মফস্বল শহর গুলোতে ভালো ভালো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি শুরু করা যায় না? মফস্বল গুলো এখনো উচ্চ শিক্ষার জন্য পুরোপুরি বড় শহরগুলোর উপর নির্ভরশীল।
গ্রাম আর মফস্বলের কথা বললাম। এবার কিছু সার্বিক বিষয় নিয়ে বলি, সার্বিক আশার আলো। খুব ভালো লেগেছে ' উবার' আর 'পাঠাও' সার্ভিস। আরও ভালো লেগেছে মানুষ এগুলো ব্যবহার করছে কোন রকম ভয় ছাড়া। এটা খুব ভালো লক্ষণ। মেয়েরা যদি একা একা উবার ব্যবহার করতে পারে সেটা অবশ্যই বড় একটা উন্নতির লক্ষণ। আমি নিজেই ট্যাক্সি করে একা চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার গেছি, একটুও ভয় লাগে নি। তবে আমার স্বপ্ন আরও বড়।
আমি স্বপ্ন দেখি উবারে মহিলা ড্রাইভার থাকবে। আমার খুব ' পাঠাও' এ উঠতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু মহিলা চালক আছে কী? থাকলেও বা আমি কীভাবে শুধু তাদেরকেই ডাকব? আবার মহিলা চালকরা শুধু মহিলা যাত্রী পাবেই বা কীভাবে? আমাদের দেশের প্রচণ্ড জ্যামে 'পাঠাও' এক আশার আলো। মেয়েদের 'পাঠাও' ব্যবহারের ব্যাপারটা মোবাইল ফোন কোম্পানির সাথে কেউ যদি দেখতেন খুব ভালো হতো।
ঢাকায় অনেক বন্ধুর কাছে শুনেছি তারা এখন হেঁটে অনেক দৈনন্দিন কাজ সারেন। জ্যামও এড়ানো গেল, শরীরের ও উপকার হল। ভালো লেগেছে তাদের এই স্বাস্থ্য সচেতনতা। তবে সবার মুখে এক কথা রাস্তা বা ফুটপাথগুলো হাঁটার উপযোগী না। অনেক বেশি মানুষ হাঁটা শুরু করলে আশা করি সরকার এ ব্যাপারে নজর দেবেন। ভালো লেগেছে 'বিকাশের' মাধ্যমে অতি সহজে টাকা পাঠানো। ইন্টারনেটের মাধ্যমে হোটেল, হাসপাতাল সবার সাথে মুহূর্তে যোগাযোগ করা।
অবাক হয়েছি দেখে মেয়েদের পোশাক আশাকে পরিবর্তন। গ্রামেও এখন শাড়ি পরা মেয়ে পাওয়া দুষ্কর। সবাই সালওয়ার কামিজ পরছে। শহরে মেয়েরা পশ্চিমা পোশাকও পরছে অনেকেই। হিজাবের জনপ্রিয়তা বেড়েছে অনেক অনেক বেশি। মেয়েদের পোশাক নিয়ে সমালোচনা করব না, এটা আশার আলো বা দুরাশার অন্ধকার নয়, যেটা আশার আলো সেটা হল মানুষ মেনে নিচ্ছে। পোশাকের জন্য 'কী আজব এক বস্তু দেখছি' ধরনের চাহনি আমার চোখে পড়ে নাই। ঢাকার ভিড় বহুল রাস্তায় একটা মেয়ে জিনস আর শার্ট পরে হেঁটে যাচ্ছে একা নির্ভয়ে, দৃশ্যটি কী কয়েক বছর আগেও ভাবা যেত?
সরকারি অফিসে যেয়ে মানুষকে ধৈর্যের সাথে লাইনে দাঁড়াতে দেখেছি। আমরা সুশৃঙ্খল হচ্ছি, শিক্ষিতের মত আচরণ করছি। এটাও আশার আলো। শহরেও ভিক্ষুকের সংখ্যা কমেছে মনে হয়েছে। আমাকে ভীষণ ভাবে মুগ্ধ করেছে তরুণ প্রজন্মের নতুন সব আইডিয়া, ভালো কিছু করার চেষ্টা। কয়েকজনের সাথেই কথা হয়েছে এ ব্যাপারে, এরা এতো জানে, ওদের স্বপ্নগুলো এতো বড়। সাধারণ চিত্রটা এরকম না হয়তো, তবুও এই মুহূর্তে আমাদের কিছু স্বপ্নবাজ, সৎ এবং পরিশ্রমী তরুণ তরুণী খুব প্রয়োজন। এরাই আমাদের আলোর মশাল জ্বালিয়ে রাখবে আশা করি।
লেখক : প্রবাসী কলামিস্ট, লেখক।
এইচআর/এমএস