বিএনপি’র প্রকৃত শত্রু কে?
প্রতিটি জাতির জীবনে বিভিন্ন সময়ে কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়, যেগুলোর উত্তরও সময়ের সাথে সাথে পরিষ্কার হয়। যেমন একজন সাধারণ মানুষকে যদি এই মুহূর্তে প্রশ্ন করেন যে, তার মনে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নটি এখন কী? আমি শতভাগ নিশ্চিত করেই বলতে পারি যে, তিনি বলবেন, দুর্নীতির দায়ে বেগম জিয়ার কারাদণ্ড পাওয়ায় সবচেয়ে লাভ হলো কার?
এই প্রশ্নটি আরো অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দেয়, যেগুলোর উত্তরও সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট নয় এখনও। বিশেষ করে আগামী নির্বাচনকে ঘিরে পরিস্থিতি কী হবে? বিএনপি কি আদৌ নির্বাচনে আসবে কিনা? নির্বাচনে এলে কী হবে? আর না এলে কী হবে? সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিএনপি’র নির্বাচনী সহায়ক সরকারের কী হবে? বেগম জিয়ার মুক্তি নাকি সহায়ক সরকার? নাকি নির্বাচন? কোনটি নিয়ে বিএনপি এগুবে?
এসব যেমন বিএনপি সমর্থকদের প্রশ্ন তেমনই আওয়ামী শিবিরেও কি স্বস্তি আছে? মনে হয় না। তারাও একাধিক প্রশ্ন নিয়ে ভাবছে যার মধ্যে সবচেয়ে জটিল ও কঠিন প্রশ্নটি হলো, বেগম জিয়ার কারাদণ্ডে কি আওয়ামী লীগের কোনো লাভ হলো? কেউ কেউ বলছেন যে, লাভও হয়নি, ক্ষতিও হয়নি। কিন্তু একজন কট্টর আওয়ামী সমর্থক সেদিন কথায় কথায় বললেন যে, বেগম জিয়ার কারাদণ্ড লাভে আওয়ামী লীগের কোনো লাভতো হয়ইনি, বরং ক্ষতিই বেশি হয়েছে।
স্বাভাবিক ভাবেই তাকে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, তবে লাভ হয়েছে কার? তিনি একেবারে চোখ বন্ধ করে উত্তর দিয়েছিলেন যে, সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছে এদেশের সুশীল সমাজ নামে যে রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমটি আছে তাদের। সেটা কী ভাবে? ভদ্রলোক যে উত্তর দিয়েছিলেন তা পরবর্তী আলোচনায় উল্লেখ করতে চাই। কিন্তু আজকের লেখায় বিএনপি’র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং প্রকৃত শত্রু কে সেটা সন্ধান করতে চাই।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজকের অবস্থাকে আমরা বলতে পারি খানিকটা কঠিন সময় কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এখনকার অবস্থাকে দুঃসময় বলা যাবে না। বাংলাদেশ এর চেয়েও ভয়াবহ রাজনৈতিক অচলাবস্থার কাল পেরিয়ে এসেছে। ধরুন ১৯৭৫ সালের কথা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে।
জেলের ভেতর বন্দী জাতীয় নেতাদের হত্যা করা হয়েছে। খন্দকার মুশতাকের কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। সামরিক আইন জারি হয়েছে। আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব হয় বন্দী না হয় পলাতক- এমতাবস্থায় দলটির রাজনীতি বলতে কিছুই নেই, সামনের দিনগুলি সঙ্কটময়। নেতৃত্বশূন্য রাজনৈতিক দলটি ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়েই এগুচ্ছে কিংবা বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
সেই সময় দেশের বুদ্ধিজীবীকুল চরম নির্লিপ্ততা দেখিয়ে হয় সামরিক সরকারের পায়ের কাছে গিয়ে বসে আছেন নয় প্রাণের মায়া নিয়ে ঘরে বসে আছেন। আজকের পরিস্থিতির সঙ্গে কিন্তু তুলনাও করা যাবে না সেই সময়টা, কারণ আজকে যেমন দুর্নীতির দায়ে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বেগম জিয়ার জন্য সুশীল শিবিরে মাতম উঠেছে নির্বাচন নিয়ে, গণতন্ত্র নিয়ে তখন তারা কিন্তু হয় নিজেদের সন্তানাদি নিয়ে নিরাপদে থাকছেন নয় বিদেশে গিয়ে ভাগ্যান্বেষণে ব্যস্ত।
দীর্ঘ একুশ বছর আওয়ামী লীগকে এরকম ভয়াবহ অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। আজকে জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের জনক বানিয়ে আমরা নতুন ইতিহাস লিখছি, সেই সময় যদি জিয়াউর রহমান রাজনীতিকে উন্মুক্ত না করতেন তাহলে তার টিকে থাকা মুস্কিল হতো, প্রথমে জাগদল ও পরে বিএনপি নামক একটি আওয়ামী লীগ বিরোধী একটি প্ল্যাটফরম তৈরি করার কোনো উপায় তার থাকতো না।
তিনি নিজের রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমকে প্রতিষ্ঠার জন্য এবং যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের এদেশে পুনর্বাসনের জন্যই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং জনগণের সামনে নিজের সদিচ্ছাকে প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে ঘরোয়া রাজনীতির সুযোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সে ইতিহাস বড় নির্মম, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরকম রাজনৈতিক দুঃসময় আর এসেছে কিনা সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। এরশাদের আমলটা ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সময় স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সে অর্থে গোটা আশির দশক ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য আইয়্যামে জাহেলিয়া বা অন্ধকারের যুগ।
কিন্তু সে অন্ধকারের যুগ পেরিয়ে এসেও বাংলাদেশের রাজনীতি ভয়ংকর দূরবস্থায় পতিত হয় ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত। বিশেষ করে রাজনীতিতে যে বিরোধী কন্ঠের সুযোগ সৃষ্টি হওয়া সে জায়গাটি সেই যে হোঁচট খেয়েছে তা আর এখন অবধি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর আগেও বলেছি যে, একুশে টেলিভিশনকে বন্ধ করে দেওয়ার ফলে এদেশের সংবাদ-মাধ্যমে যে ভয় তৈরি হয়েছিল তা এখনও পর্যন্ত কাটিয়ে ওঠা যায়নি।
আজকে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আমরা এটুকু কোনো ভাবেই আশা করি না যে, তারা বিরোধী রাজনৈতিক দলকে কোনো ভাবে সুযোগ দেবে না তাদের রাজনীতি করতে। এটা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়। কিন্তু তাদেরকে একথা বললেই তারা জোর গলায় বলে ওঠেন যে, আপনারা তখন কেন কথা বলেননি যখন আমাদেরকে কখনও সপরিবারে নেতৃত্বশূন্য করে, কখনও গ্রেনেড মেরে নিঃশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল? আপনারা তখন এই প্রশ্ন তোলেননি কেন যে, একটি টেরিস্টেরিয়াল টেলিভিশন চ্যানেল কেন বন্ধ করে দেওয়া হলো? আসলে এসব প্রশ্ন যৌক্তিক কিন্তু সেই যুক্তিতে আওয়ামী লীগও বিএনপি-জামায়াতের দেখানো পথে হাঁটবে সেটা মেনে নেওয়া যায় না।
যাহোক, ফিরে আসা যাক বর্তমানে। বেগম জিয়ার কারাদণ্ড হয়েছে যে মামলায় সে মামলাটি দায়ের করেছিল ১/১১-র সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কী শক্তিশালী সরকার সেটি ছিল তা আমরা সকলেই জানি। যে কোনো সময় যে কোনো সিদ্ধান্ত তারা গ্রহণ করতে পারতো কারণ তাদের কোনো রকম ভোটের চিন্তা বা জনসমর্থনের চিন্তা করতে হতো না।
সেই সরকারের বেশ ক’টি সচিবালয় ছিল। দেশের বিখ্যাত দু’টি সংবাদপত্রের কার্যালয়ও এই সচিবালয় তথা সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্থান হিসেবে পরিচিত ছিল। বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়া এবং এদেশের রাজনৈতিক সিস্টেমকে “দুই বেগমের লড়াই” বলে দেশে-বিদেশে পরিচিতি দিয়ে এদেশকে রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব শূন্য করার যে কৌশল তারা নিয়েছিল তার আওতাতেই বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
একথা স্বীকার্য যে, ২০০৮ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করায় তিনি একটু ‘আপারহ্যান্ডে’ আছেন মামলাগুলো থেকে নিষ্কৃতিলাভে। যদিও আওয়ামী লীগ বলে যে, তারা আইনী প্রক্রিয়াতেই এসব মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন কিন্তু ধরুন উল্টো ঘটনা ঘটলে অর্থাৎ বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কিন্তু শেখ হাসিনাকে আজকে সেসব মামলার চরম মূল্য দিতে হতো। মজার ব্যাপার হলো, বিএনপি চেয়ারপার্সনের আইনজীবীগণ এই মামলাটিকে দীর্ঘায়িত করার কৌশল নিয়েছিলেন এবং বার বার মামলাটিকে হাইকোর্টে নিয়ে কালক্ষেপণ করায় দীর্ঘ ১০ বছর পর বেগম জিয়ার কারাদণ্ড হয়েছে। কিন্তু এতো সময় ক্ষেপণ না করে যদি মামলাটি এর আগেই নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যেতেন তাহলে আজকে নির্বাচনের বছরে এসে দলটিকে এতোটা খারাপ অবস্থায় পড়তে হতো না।
মজার ব্যাপার হলো আজকে যখন আদালত বেগম জিয়াকে দুর্নীতির দায়ে কারাদণ্ড দিয়েছে তখন সেই সুশীল মুখগুলোই প্রশ্ন তুলছেন আদালতের ন্যায় বিচার নিয়ে বা সরকারকে দোষারোপ করছেন রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টির জন্য। কেউ তাদেরকে বিশেষ করে সেই সময়কার সরকার বিশেষ করে কয়েকজন উপদেষ্টা যারা নিয়মিত টেলিভিশনে ও মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে একটি অনির্বাচিত ও সেনা সমর্থিত সরকারের সাফাই গাইতেন এবং রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতেন এ প্রশ্ন করছে না যে, তারাইতো রাজনীতি থেকে রাজনীতিবিদদের মাইনাস করার জন্য মামলা দায়ের থেকে শুরু করে ধরে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার-নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করে গোটা রাজনীতিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছিলেন, তাহলে তারা এখন আদালত বেগম জিয়াকে শাস্তি দেওয়ার পর তারা কেন এতো চিৎকার করছেন?
তাদের সে মুখ আর এখন আছে কিনা? রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাজনীতি করবে, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবে কিন্তু মাঝখানে দাাঁড়িয়ে তারা নিরপেক্ষ সেজে কখনও ক্ষমতাকে নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে নেবেন কিংবা কখনও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রতিপক্ষ একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে কথা বলবেন, সেটা কী করে হয়?
আজকে বিএনপি যে কথাটি বুঝতে পারছে না তাহলো বেগম জিয়ার কারাদণ্ডের জন্য সরকারকে যতোটুকু দায়ী করা যায় তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী হলো সেই সময়কার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও তার কয়েকজন সুনির্দিষ্ট উপদেষ্টা এবং সেই সময়কার কয়েকটি গণমাধ্যম, যারা বেগম জিয়াকে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়ার জন্য কাছা খুলে নেমেছিলেন। দ্বিতীয় যদি কেউ এর জন্য দায়বদ্ধ হন তাহলে বেগম জিয়ার আইনজীবীদের কথাও বলা যায় যারা মামলাটিকে দীর্ঘায়িত করে নির্বাচনের বছরে এনে ঠেকিয়েছেন।
আবারও বলি, সরকারকে দায়ী করা যাবে না তা কিন্তু নয়, কিন্তু আজকে বিএনপি যদি সরকারে থাকতো তাহলেও এর ব্যত্যয় কোনো ঘটনা ঘটতো তা মনে করি না, বরং তারা হয়তো ৭৫-এর পনেরই আগস্ট বা ২০০৪ সালের ২১শে আগস্টের গ্রেনেড আক্রমণের চেয়েও ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনা ঘটিয়ে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগকে নিঃশ্চিহ্ন করে দিতে চাইতো। বেগম জিয়াতো সেই অর্থে ভাগ্যবান যে, তাকে এরকম কোনো ভয়ঙ্কর আঘাত মোকাবিলা করতে হচ্ছে না, আদালতের মতো আইনী প্রক্রিয়াতেই তাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
লক্ষ্য করে দেখবেন যে, এখনও বার বার শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাতে আরো একটি ৭৫ ঘটানোর কথা বলা হয় তাও আবার প্রকাশ্যেই, টেলিভিশন টক শো’তেও। মজার ব্যাপার হলো, বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন যারা আজকে তারাই আবার বেগম জিয়ার পক্ষ নিয়েছেন, একেই কি বলে সর্প হয়ে দংশন আর ওঁঝা হয়ে ঝাড়া? আওয়ামী লীগ সে কারণেই বিএনপি’র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বটে, কিন্তু প্রকৃত শত্রু কি?
ঢাকা ২৭ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার ২০১৮
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম