দুবাই এবং বাংলাদেশি কমিউনিটি
লন্ডন-নিউইয়র্ক-ব্রাসেলসসহ পৃথিবীর বেশ বড় বড় শহরে দেখা যায় গৃহহীন মানুষের ফুটপাতে বসে থাকা। দুটো কয়েনের (খুচরো পয়সা) জন্যে পথচারীদের দৃষ্টি কাড়া। না, তার কিছুই দেখা যায় না দুবাইতে। সে হিসেবে দুবাই একটা পরিচ্ছন্ন শহর। ২২ দিন দেশে থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি আলো ঝলমল রাত কিংবা রৌদ্র উজ্জ্বল দিনগুলো কাটিয়েছি দুবাইতে। মাত্র তিনরাতের দুবাই আমাকে দেখিয়েছে যেন একটা পূর্ণ বাঙালি কমিউনিটি।
২) এর আগেও বার তিনেক দুবাইতে গিয়েছি। সপ্তাহদিন থেকেও মানুষের দীর্ঘশ্বাস যে দেখিনি, তা নয়। খাটছে মানুষ। অফিসের ছোট চাকরি, দোকানের সেইলসম্যান,কন্সট্রাকশনের শ্রমিক প্রভৃতিতে আমাদের মানুষের একটা বড় অংশ কাজ করছে। তখনও দেখেছি, কাজ অনুযায়ী শ্রমের মূল্যটা অপ্রতুল। এখনও এটা আছে। এ অপ্রতুলতা নিয়েই এরা বাংলাদেশে একটা সুন্দর সুখী পরিবার চালাচ্ছে এ সুদূর দুবাই থেকে। গভীর রাতে দেখা করতে ফোন দেয় কলেজ জীবনের এক বন্ধু, আমি বলি ‘ঘুমিয়ে গেছি’। পরদিন সকালে হোটেল লবিতে দেখি ব্যবসায়ী বন্ধু মুকিত অপেক্ষায়।
এইতো দুবাই- মুখে হাসি আর প্রাণখোলা আতিথেয়তা। তাদের এ অনাবিল প্রশান্তি দেখে আমি বার বার নিজেকে প্রশ্ন করেছি, বাইরে থেকে বেড়াতে আসা স্বজন-সজ্জনদের নিয়ে ব্রিটেনের কিংবা ঢাকার মানুষগুলো কি এ প্রাণখোলা হাসি হাসতে পারে। দুবাই’র প্রবাসী তরুণ-যুবক বাঙালিদের মধ্যে যে দেশাত্ববোধ পরিলক্ষিত হয়, তা শুধু নিখাদ বাঙালিদের মধ্যেই খোঁজে পেয়েছি জীবনের বাঁকে বাঁকে। ব্রিটেন আমেরিকা কিংবা পশ্চিমা দেশে যেসব অভিবাসীরা থাকেন, তাদের কাছে বাংলাদেশ এখন হলিডে’র জায়গা। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের মানুষগুলোর কাছে বাংলাদেশ তাদেরই দেশ।
পৃথিবীর সকল জায়গায়ই খেটে খাওয়া মানুষের একটা অংশ আছে। এ খেটেখাওয়া মানুষগুলোই দিচ্ছে বাংলাদেশকে অনেক কিছু। লন্ডন-আমেরিকার মানুষগুলোর অধিকাংশই তাদের পরিবার নিয়ে নির্বিঘ্নে দিন কাটায়, বাংলাদেশের বাতাস তাদের গায়ে খুব একটা দোলা দেয় না। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের রোদে পাথর হওয়া মানুষগুলোই বাংলাদেশের প্রাণ। এদের উপার্জিত অর্থে বাংলাদেশ ফুলে-ফেফে উঠছে, অথচ বিমানবন্দরে এ খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে হেনস্থার শিকার হতে হয়। বাংলাদেশের কোন স্বজন যখন দুবাই,সারজা কিংবা আজমানে পা দেন, তখন তারা যেন ব্যস্ত হয়ে উঠেন। কাজের ফাঁকে, ব্যস্ত শ্রমঘণ্টায়ও সময় বের করে কোথায় কীভাবে দুবাই দেখাবেন, তা-ই হয়ে উঠে তাদের যেন প্রধান কাজ।
দুবাইতে পা দিয়েই পেয়েছি ছড়াকার লুৎফুর রহমানকে। বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকায় ছড়া লিখে এবং একাত্তর টিভি’র দুবাই প্রতিনিধি হিসেবে ইতোমধ্যে যার পরিচিতি ব্যাপক, দুবাইসহ বাংলাদেশে। দুবাই’র একটা অফিসে চাকরি করা লুৎফুর আমার অনুজ, সে এলো তারই সহকর্মী একাত্তর টিভি’র ক্যামেরার মানুষ জাভেদ, একটা প্রতিষ্ঠানের সহকারী একাউন্টেন্ট হিসেবে কর্মরত এবং ৫২বাংলা টিভির ক্যামেরার মানুষ সাংবাদিক আমিনুল, তরুণী শিক্ষক তিসা সেন আর তিসার পিতা-মাতাসহ দুটো গাড়ি নিয়ে। কবি-সাংবাদিক আনওয়ারুল ইসলাম অভি আমার আরেক অনুজ আসবেন লন্ডন থেকে। আমরা দলবেঁধে অপেক্ষা করলাম তাঁর জন্যে, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইটের জন্যে। তারপর ‘ডেরা দুবাই’র এক ‘কেএফসি’র ফ্রাইড চিকেন খেতে খেতে মধ্যরাত গড়িয়ে গেলো, হোটেলের রুমে সকাল চারটায় আমরাই তাদের বলি ‘ঘুমোতে যাও’।
লাখো বাঙালির পদভারে দুবাই বাঙালিদের একটা নিজস্ব স্থান। পারফিউম ব্যবসায় জায়গা করে নিয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। অনেক অনেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী আছেন, যারা নিজেদের কোম্পানির পারফিউম তৈরি করে জমকালো শো-রুমে লাখো-কোটি দিহরামের বাণিজ্য করছেন। এদেরই একজন এন আর বি ব্যাংকের পরিচালক আলহাজ আব্দুল করিম। আলহাজ করিমদের সংখ্যা হাতেগোনা নয়। আল হারামাইনের মতো মধ্যপ্রাচ্য খ্যাত কোম্পানির মালিক মাহতাবুর রহমান যদিও একজন। তবে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা মোটেও কম নয় দুবাই কিংবা আরব আমিরাতে, অগণন। মাহতাবুর রহমান একমাত্র বংলাদেশী ব্যবসায়ী, যার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিশাল সাইন দুবাইর বিলাসী এলাকায় আলো ছড়ায়।
৩) লন্ডন থেকে প্রচারিত একটা অনলাইন টিভি চ্যানেলের (৫২বাংলা টিভি) লগো উন্মোচনের অনুষ্ঠানে অংশীদার হয়েছিলাম। দুবাই’র একটা অভিজাত হোটেলে ছিলো অনুষ্ঠান। অনলাইন টিভি চ্যানেল কোন নতুন কনসেপ্টও না, আবার এটা কোন আহামরি বিনিয়োগও না। লন্ডনে আরও দু’একটা অনলাইন চ্যানেল হয়েছে। এগুলো মূলত ফেসবুক আর ইউটিউব কেন্দ্রিক। সুতরাং খুব স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতেই পারে, সেগুলোর আবার প্রয়োজনই বা কি? ছয়টি টিভি চ্যানেলের সবকটাই হিমশিম খাচ্ছে, ব্যবসা বাগিয়ে নিতে নাভিশ্বাস উঠছে তাদের। একটা টিভি চ্যানেল ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।
সত্যি কথা হলো, লন্ডনে বাংলা ভাষী এ টিভি চ্যানেলগুলো কত শত লোকই বা দেখে। এ একটা প্রশ্ন আছে জনমনে। তবুও দেখা গেছে প্রযুক্তিকে ব্যবহার ব্যবসায়িরা যখনই বড় বিনিয়োগ নিয়ে এসেছেন গণমাধ্যমে, তখন এই ব্রিটেনে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রিন্ট মিডিয়াগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। আবার অন্যদিকে ছোট আকারের বিনিয়োগ নিয়ে এসে অনলাইন পোর্টালগুলো বাংলা প্রিন্ট মিডিয়াগুলোকে আরও বিপাকে ফেলেছে।
এরপরও বলতে হয়, বড় ধরনের বিনিয়োগের পরও টিভিগুলো ব্যবসা-সফল হয়ে উঠতে পারছে না। যদিও লন্ডনের একটা চ্যানেল ব্যবসা সফল বলে মনে করেন কেউ কেউ। এরই মাঝে অন্তত আরও চার-পাচটি অনলাইন টিভি চ্যানেল আত্মপ্রকাশ করেছে। মূলত ফেসবুকে শেয়ারের উপরই নির্ভর করে এই টিভি চ্যানেলগুলোর ব্যাপ্তি। কিন্তু অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, এখন এখানকার টিভি চ্যানেলগুলোর অনেক অনুষ্ঠানই তারা এখন লাইভ করছে, ফেসবুকে এবং এসকল অনুষ্ঠাগুলো দর্শক প্রিয়তাও পাচ্ছে।
৫২বাংলা টিভি’র একটা ভালো দর্শক গ্রুপ আছে দুবাইতে। কেননা সেখানে এই টিভি’র একটা ভালো টিম কাজ করে। এই টিমই আয়োজন করেছে এই লগো উন্মোচন পর্ব। সন্ধ্যা ৭ ঘঠিকার সময় অনুষ্ঠান শুরু হবার কথা থাকলেও শুরু হয় রাত ন’টায়। যদিও নির্ধারিত(ইনভাইটেড অনলি) দর্শকদের প্রায় সবাই-ই উপস্থিত হয়েছিলেন এতে। এয়ারলাইন্সের চাকরিজীবী, প্রকৌশলী,বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, বাংলাদেশী বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও কাগজের সাংবাদিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের উপস্থিতিতে একটা সমৃদ্ধ অনুষ্ঠান ছিলো এটা। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীরা উপস্থিত ছিলেন এ অনুষ্ঠানটিতে। একজন সফল নারী ব্যবসায়ী গুলসান আরা তাঁর বুটিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এই অনুষ্ঠানটির সিংহভাগ স্পন্সর করেছিলেন। ঐ ব্যবসায়ী লন্ডন ভিত্তিক একটি শিল্প-সাহিত্যের সংগঠন সংহতির আমিরাত শাখার সভাপতিও। স্বাভাবিকভাইে তিনি সংস্কৃতি বান্ধব।
দুবাই‘র পাশঘেঁষে থাকা আজমান একটা ছোট্ট শহর। সেখানে সাগরের তীর ঘেষে তাঁর একটা পরিপাটি বাড়ি। এই বাড়িরই আঙ্গিনায় ৯ ফেব্রুয়ারি আয়োজন করা হয় ছড়াকার-সাংবাদিক লুৎফুর রহমানের ৮টি ছড়াগ্রন্থের ওপর আলোচনা। এ আলোচনায় শিল্প-সাহিত্যের মানুষেরা উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন সংস্কৃতি কর্মীরা। নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে এ অনুষ্ঠানটিও শুরু হয়। সেখানে দেখা হয় আল হারামাইন পারফিউম এবং বাংলাদেশের এন আর বি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মাহতাবুর রহমানের সাথে। দুবাই’র প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও চাকুরীজীবীদের ব্যাপক উপস্থিতি সেখানে থাকলেও আনওয়ারুল ইসলাম অভিসহ আমাদের আলোচনায় তারা ছিলেন যেন শুদ্ধ শ্রোতা।
ছড়াগ্রন্থের ওপর আলোচনা শেষে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এর আগের দিন একইভাবে ৫২বাংলার অনুষ্ঠানেও হয়েছে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সংস্কৃতি কর্মী সাইদা দিবা, আবৃত্তি শিল্পী মাকসুদা খানম, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ইয়াছমিন কালাম, নৃত্যশিল্পী তিশা সেনসহ একঝাঁক সংস্কৃতি কর্মীরা মাতিয়ে রাখে দুবাই’র বিভিন্ন অনুষ্ঠান। নিঃসন্দেহে এ অনুষ্ঠানগুলো লন্ডন-ম্যানচেষ্টারের কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের চেয়ে কম নয়।
৪) আগেই বলেছি দুবাই একটা পরিচ্ছন্ন শহর। রাতের দুবাই চমৎকার। রাস্তাঘাটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা মনে হয়েছে ইংল্যান্ডের শহরগুলোর মতোই, কোন কোন ক্ষেত্রে আরও নিরাপদ। দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে অনেক নতুন নতুন আইন এনেছে সরকার। বিদেশীদের আকৃষ্ট করতেই মূলত সরকারের এসব সংস্কার দুবাইকে নিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর এক শ্রেষ্ঠ পর্যটন নগরীতে। তাইতো আমিরাত এয়ারলাইন্স এর ফ্লাইটের দুই তৃতীয়াংশ আসনই থাকে শ্বেতাঙ্গ মানুষদের দখলে।
স্বাভাবিকভাবেই তাই দুবাই হয়ে উঠছে বাংলাদেশী মানুষদেরও এক প্রধান শহর হিসেবে। অনেক কাঠ-খড় পোড়াচ্ছে বাঙালিরা, কিন্তু এই কাঠ-খড় পুড়িয়ে একটা ভিত্তি স্থাপন করেছে বাংলাদেশী একটা জনগুষ্ঠিগোষ্ঠী। বৈভবে সমৃদ্ধ অনেক অনেক ব্যবসায়ীদের পরবর্তী প্রজন্ম ব্রিটেন আমেরিকায় বেড়ে উঠা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের মতোই ভুলে যাচ্ছে বাংলা। ইংরেজি-প্রধান একটা প্রজন্ম এখানে বেড়ে উঠছে, ভুলে যাচ্ছে শিকড়ের মূল পাঠ। সন্দেহ নেই এরা চাকরির ক্ষেত্রেও জায়গা করে নিচ্ছে। সংখ্যায় এরা যদিও লঘিষ্ট, কিন্তু তবুও এদের পিতা-মাতাদের একটা হাহুতাশ আছে তাদের এই বেড়ে উঠা প্রজন্ম নিয়ে।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী কলামিস্ট।
এইচআর/পিআর