প্রেম করো, প্রেমে পড়ো
সময় বদলেছে, সমাজ বদলায়নি। সমাজ বদলায়নি বলেই এখনও ‘প্রেম’ শব্দটিতে যত আপত্তি। শুধু শব্দ বলছি কেন, ‘প্রেম’ এখানে এখনও রীতিমত অপরাধের মতো, অন্যায়ের মতো, পাপের মত কিছু একটা বলে ধরে নেয়া হয়। কারো সঙ্গে কারো প্রেম আছে, প্রেমের সম্পর্ক আছে, ধরে নেয়া হয় রীতিমত অন্যায় কিছু আছে, দু’জনের মধ্যে। এই মানসিকতা, ভাব ও ভাবনা সমাজের অনেককালের পুরনো চরিত্র।
প্রেম তো ভালোবাসা থেকেই আসে। ভালোবাসা যদি থাকে, ভালো যদি বাসে কেউ কাউকে, মন্দ কি? ভালোবাসার মতো মহৎ মহান আর কিইবা হতে পারে। ভালোবাসতে সততা লাগে, প্রকাশে সাহস প্রয়োজন হয়। সৎভাবে, ভালো কয়জনইবা বাসতে পারে অন্যকে?
প্রেম ও ভালোবাসার সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছেন সম্ভবত দু’জন মনোবিদ। তার একজন সিগমুন্ড ফ্রয়েড, অন্যজন জ্যাক লাঁকান।
লাঁকান বলেছেন, ভালোবাসা হচ্ছে তা-ই, যা তুমি অন্যকে দিতে চাও, অথচ যা তোমার নেই, এবং যা অন্যের প্রয়োজনও নেই। সবটা মিলিয়ে কেমন যেন, অনেকটা গোলকধাঁধার মতো। আসলেই তাই, লাঁকান নিজেও বলেছেন, লাভ ইজ আ ল্যাভেরিন্থ। গোলকধাঁধাই। তারপরও মানুষ মানুষকে ভালোবাসে। প্রেম করে, প্রেমে পড়ে।
‘সফল প্রেম’ ‘ব্যর্থ প্রেম’- খুব শোনা যায় এই দুটো টার্ম। প্রেমের সফলতা, ব্যর্থতা বলে কিছু নেই। প্রেম প্রেমই। প্রণয়, পরিণয়ে পৌঁছুলেই তা সফলতা, অমন ভাবাটা বোকামী। বরং কখনও কখনও কিংবা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিয়ের পর প্রেমের রূপ-রস-গন্ধ আর আগের মতো থাকে না, বদলায়। কাঠামোগত কারণেই বিয়েতে এসে প্রেম অনেক ম্যারম্যারে, নেতিয়ে যায়।
সফল বলে প্রেমের যত ‘হিস্টি’ আর ‘মিথ’ তা বিয়োগাখ্যানই। পশ্চিমের ‘রেমিও এন্ড জুলিয়েট’ থেকে শুধু করে পুবের ‘মধুমালা-মদন কুমার’- সবই।
মনে আছে একবার সেলিম আল দীনের কাছে প্রেম ও কাম দু’টোর ব্যাখ্যা জগতে চেয়েছিলাম, বুঝতে চেয়েছিলাম দু’টোর পার্থক্য ও চরিত্র। বলেছিলেন, কাম হচ্ছে তাৎক্ষণিক উত্তেজনা ও ঝড়। আর প্রেম নিরন্তর। প্রেম ও কাম দু’টোকে অনেকে ভীষণ গুলিয়ে ফেলে। এক করে দেখে।
আদতে দু’টো এক নয় কিন্তু। কামে, প্রেমের উপস্থিতি নাও থাকতে পারে। কাম এক ধরনের দেহজৈবনিকতা। প্রেম ছাড়াও রতিক্রিয়া হতে পারে। পুলক লাভ সম্ভব। সে ভিন্ন হিসেব। ক্লায়েন্ট ও প্রসটিটিউিটের যে কেমেস্ট্রি সেখানে প্রেমের সুযোগ কোথায়? সে তো সেক্সচুয়াল সার্ভিস প্রভাইডারের প্রফেশনালিজমের চূড়ান্ত হিসেবের জায়গা। সেখানে কোন প্রেম নেই, নেহাত যৌন বাণিজ্য- সেক্স ট্রেড সেটি।
সম্পর্ক আছে প্রেম নেই, যে কোনও সম্পর্কের জন্যই নিপীড়ন এবং অসম্মানজনক। শুধু সম্পর্ক থাকার জন্য, রাখার জন্য আছে। ভেতরে নেই কিছু। শুন্য, ফাঁকা। দাম্পত্যের ক্ষেত্রেও এটি খুব ঘটে। অনেক মেয়ে ভালোবাসাহীন, প্রেমহীন সম্পর্কের মধ্যে পড়ে থাকে। ভাবে প্রেম না থাকুক, সংসার তো আছে। ঘরদোর, আসবার, আর পুরুষ মানুষ থাকলেই অনেক মেয়ে সংসার ভেবে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়। যুগ পেরিয়ে যায়, জীবন ফুরোয়।
আজকাল ফেসবুকে ‘সোকলড হ্যাপি কাপল’ খুব দেখা যায়। সারাদিন গায়ে গা লাগিয়ে সেলফি তুলছে, ছবি আপলোড করছে। এরা আসলে ‘ফেসবুক হ্যাপি’। ফেসবুকে ছবি দিয়ে বোঝাতে চায়, ভালো আছি। আসলে ভেতরে ভাল নেই। পারস্পরিক বিশ্বাস নেই, প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই। ভালোবাসাহীন এই দাম্পত্য বড় বিভীষিকাময়। এই একত্রবাস বড় দুঃসহবাস।
আস্থা, বিশ্বাস যে কোন সম্পর্কের মূল। মূল না থাকলে ভালোবাসার চারাগাছটি বাঁচে কি করে? অনেকে মনে করে, পশ্চিমে বোধ হয় লোকে চৌদ্দজনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। এটাই বুঝি ‘লাভ ট্রেন্ড’ সেখানে। খুব ভুল ধারণা, সেখানেও একে অপরকে ভালোবাসে বিশ্বস্ততার সঙ্গে। ‘লাভ ট্রেন্ড’ বলে যা ভাবা হয়, তা আসলে ‘লাভ গেইম’। চৌদ্দজনের সঙ্গে যার সম্পর্ক, সে আসলে কাউকেই ভালোবাসে না।
প্রবল প্রেমের সম্পর্ক, ভালোবাসার সম্পর্কও ভাঙতে পারে। কে জানে কার জীবন। বাইরে থেকে সে জীবনের, সে মানুষের কতটুকুইবা বোঝা যায়, জানা যায়। আর জানার দরকারইবা কি অন্যের। একটি সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর, ‘ব্রেক আপ’ এর পর, অন্য আরেকটি সম্পর্ক খুব নৈতিকভাবে গড়ে উঠতে পারে। এটি কোন অন্যায় নয়। বরং একটি সম্পর্কে থাকার পর অন্য আরও সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা অন্যায় ও অসভ্যতার মধ্যে পড়ে।
আমার কাছে প্রেম মানবিক সম্পর্ক, মানবিকতা। সাহস। সততা। ভালো না বেসে জীবনে কাউকে ভালোবাসি বলিনি। প্রেমবোধ না করে প্রেমের ভান করিনি। প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই, অমন কোন সম্পর্কে দু’দণ্ড থাকতে পারি না। প্রেমে এত দোষ দেখে কেন লোকে, ভালোবাসায় আপত্তি কোথায়? নারী-পুরুষকে, পুরুষ-নারীকে, নারী-নারীকে, পুরুষ-পুরুষকেও ভালোবাসুক। জগতে কেউ কাউকে যদি সত্যিই ভালোবাসে, আমি কোন দোষ দেখি না তাতে।
মানুষ আরও ভালোবাসুক। ভালোবেসে ভেসে যাক, উড়ে যাক, সাত আসমান ঘুরে আসুক। আরও প্রেম করুক, আরও আরও আরও প্রেমে পড়ুক মানুষ, মানুষের।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/পিআর