ভালোবাসা দিবস, বাঙালি সংস্কৃতির নতুন সংযোজন
পৃথিবীর অন্যান্য দিবসের মতই এ দিবসটিকে নিয়েও আছে নানা মুনির নানা মত। যারা, বছরের বিশেষ কোন দিন কোন দিবস হিসেবে পালন করতে নারাজ, তাদের যুক্তি হল, বছরের এই একটি দিন এই দায়িত্ব পালন করা মানে বাকি দিনগুলোতে কিছু না করার এক ছাড়পত্র। যেমন বছরে এক দিন বাবা দিবস, মা দিবস পালন করে তাদের সাথে সুন্দর সময় কাটিয়ে বাকি দিন গুলোতে কি আমরা বাবা, মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করব না? এই দিন গুলো তৈরি করে কি সেই ধারণা গুলোকেই উস্কানি দেওয়া হচ্ছে না?
ঠিক একই ভাবে ভালোবাসা দিবস পালন করে বছরের বিশেষ দিনে ভালোবাসার মানুষটির প্রতি অনেক ভালোবাসা দেখিয়ে বছরের বাকি দিনগুলোতে কি আর ভালোবাসার প্রকাশ না করলে বা ভালো না বাসলেই চলবে?
এই তর্কগুলো খুব প্রবল ভাবে দেখি আমাদের বাঙালিদের মধ্যে। বিদেশে বসবাস করা বাঙালিদের মধ্যেও এ নিয়ে দ্বিধা বিভক্তি দেখেছি। আসলে এর কারণ ও আছে। আমরা যে চির চেনা বাঙালি সংস্কৃতিতে বড় হয়েছি, এই দিনগুলো সেই সংস্কৃতির অংশ নয়। তাই এই ধারণাগুলো আমাদের কাছে তুলনামূলকভাবে নতুন। নতুন যে কোন কিছুর সাথে খাপ খাওয়াতে সবারই কষ্ট হয়। তাই এই দিবসগুলোকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে আসলে যেটা হয়েছে সেটা এক ধরনের জেনারেশন গ্যাপ বলা যায়।
একেক প্রজন্মর কাছে কিছু দিবস, কিছু উৎসব, রীতিনীতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, পরের প্রজন্মে তা অচল হয়, আবার নতুন কিছু যোগ হয়, জনপ্রিয় হয়। এটাই জগতের নিয়ম। আবার প্রজন্মের কোন সুস্পষ্ট সীমারেখা টানাও খুব কঠিন। আশি বা নব্বইয়ের দশকে প্রকাশ্যে প্রেম করা, এক সাথে প্রেমিক প্রেমিকা ঘোরাফেরা করাই ছিল সামাজিক ভাবে নিন্দনীয় অপরাধ। সেখানে ভালোবাসা দিবস পালনের প্রশ্নই ওঠে না। তার আগের বাঙালি যুবক যুবতীরা এ দিবসের সাথে একেবারেই পরিচিত ছিল না। নব্বইয়ের শেষের দিকেও যে খুব বেশি জনপ্রিয় ছিল তা নয়, অনেকটা লুকিয়ে চুরিয়ে রেখে ঢেকেই পালন করা হত।
যে সংস্কৃতিতে ভালোবাসাবাসিই অপরাধ বলে গণ্য সেখানে ভালোবাসা দিবসের প্রবেশ খুব সহজসাধ্য হওয়ার কথাও নয়। তবুও থেমে থাকেনি তরুণ সমাজ। সামাজিক পরিবর্তনের অপ্রতিরোধ্য স্রোতে প্রকাশ্যে ভালোবাসার সাথে ভালবাসা দিবস পালনও এখন আমাদের সংস্কৃতির অংশ হওয়ার পথে। এই নিয়ে মত বিরোধের আসলে যে কারণগুলো আছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ছেলে মেয়েরা অবাধে প্রেম করবে কিনা সেটা নিয়েই দ্বিধা দ্বন্দ্ব। পশ্চিমা সমাজে এটা যেমন বলতে গেলে মানুষের মৌলিক অধিকার, আমাদের সংস্কৃতিতে তো সেটা না। আসলে মূল সমস্যাটা সেখানেই।
ভালোবাসা দিবস নিয়ে আমাদের মধ্যে কিছু ভ্রান্ত ধারণাও আছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটা অনেকটা তরুণদেরই দিবস, তাদেরই উৎসব। যেন প্রেম, ভালোবাসা মানেই বিয়ের আগের প্রেম। তাই ভালোবাসার সব প্রকাশ শুধু তরুণ তরুণীদের মধ্যেই। অথচ, ভেবে দেখুন বিয়ের আগের যে প্রেম, সেখানে এমনিতেই প্রকাশের কোন অভাব থাকে না, দুটো মানুষ কাছে আসার তীব্র আশা নিয়ে প্রাণপণে নিজের অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করে যায়।
সধারণত বিয়ের পরের জীবনগুলোতেই সেই প্রকাশের ভাটা পড়ে। তাই বিবাহিত দম্পতিদের জন্য বরং এই দিবসগুলো আরও বেশি জরুরি। একে অন্যের জন্য ভালোবাসাকে অভ্যস্ততা, অভ্যাস বা প্রাপ্য কিছু মনে না করে বরং চেষ্টা করে সেটার প্রকাশ করা, নিয়মের বাইরে যেয়ে পুরনো ভালোবাসাটাকে একটু ঝালিয়ে নেওয়া সম্পর্কটাকে আরও সতেজ করে, আকর্ষণীয় করে। তবে, সাবধান। ভালোবাসার প্রকাশটাই যেন মুখ্য না হয়, সেখানে সত্যিকার ভালোবাসা থাকাটা আরও অনেক বেশি জরুরি। আর তার চেয়েও জরুরি বছরের প্রতিটা দিন সেই ভালোবাসাটাকে ধারণ করা, যত্ন করা।
ভালোবাসা দিবসের সাথে আমাদের সংস্কৃতির আরেকটা দ্বন্দ্ব আছে। আমরা যে কোন ধরনের ভালোবাসার প্রকাশকে আদিখ্যেতা মনে করি। এমনকি সন্তান বড় হলে তাকেও মা জড়িয়ে ধরতে, চুমু খেতে সঙ্কোচ বোধ করে। স্বামী স্ত্রী পাশাপাশি বসা, হাতে হাত রাখা এগুলো তো আমাদের দৃষ্টিতে পুরাই আদেখলাপনা। ধরেই নেওয়া হয়, যেসব স্বামী স্ত্রী বাইরে ভাই বোন সম্পর্ক দেখায় না, তাদের কোন সমস্যা আছে, এজন্যই সেগুলো ঢাকতে লোক দেখানো প্রেম প্রীতি। তাই, তরুণ প্রজন্ম ধরে বেঁধে ভালোবাসা দিবসকে আমাদের সংস্কৃতিতে নিয়ে আসলেও সেটা অন্দরমহল টপকে পুরানো যুগের স্বামী স্ত্রীদের মধ্যে কতটুকু যেতে পেরেছে সন্দেহ আছে।
একটি বিরাট অংশ আছে যারা ভালোবাসা দিবসকে ব্যবসা বাণিজ্যের এক অংশ মনে করে। একথা পুরোপুরি অস্বীকার করার উপায় নেই যে এ উপলক্ষ্যে বিক্রি বাটা বেড়ে যায় অনেক। পৃথিবীর সব জায়গাতেই তাই। ক্রিসমাস মনে হয় পশ্চিমের ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে রমরমা সময়। ব্যাবসা বাড়লে ক্ষতি কী? সরাসরি ক্ষতি নেই কোনই। কিন্তু এই দিবস উদযাপন করতে যেয়ে তরুণ তরুণী, যাদের আসলে আয় বলতে কিছুই নেই তারা যদি অবাধ খরচ শুরু করে, সেই খরচ জোগাবে কে?
নিশ্চয়ই তাদের বাবা, মা, অভিভাবক আর না হয় এরা অসদুপায়ে সে টাকা জোগাড় করবে। এসব আচরণ তরুণ সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ঘটাতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে এই পিয়ার প্রেশার বেড়ে গেছে বহুগুণে। প্রিয়জনের উপহারে কতখানি ভালোবাসা জড়িয়ে আছে তার চেয়েও অনেক বেশি মূল্যবান হয়ে গেছে ফেসবুকে সেই উপহারের ছবি দিয়ে লোক দেখানো। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি।
এই ব্যাধিতে শুধু আমাদের দেশের মানুষই আক্রান্ত না, গোটা পৃথিবী আক্রান্ত। ভালোবাসা কোন লোক দেখানোর জিনিস নয়, এটা নিজের প্রাণে অনুভব করার এক উপলব্ধি। উপহারের মান বা দামের সাথে এর আদৌ কোন সম্পর্ক নেই, তবে প্রকাশটা জরুরি বলে মনে করি। প্রেম এক স্বর্গীয় অনুভূতি। এই স্বর্গীয় সুবাস যেন একটি দিনের পরে হারিয়ে না যায়, এর স্থায়ীত্ব হোক আজীবন।
লেখক : ক্যালিফোর্নিয়া প্রবাসী প্রকৌশলী, লেখক।
[email protected]
এইচআর/এমএস