সখী ভালোবাসা কারে কয়?
মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব কিন্তু তার আবেগের জন্যেই। আর আবেগের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বিষয়টিই হচ্ছে "ভালোবাসা"। এই ভালোবাসার ব্যাপারটাও বড্ড অদ্ভুত। এর নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা হয় না, আবার না আছে কোনো সীমা। প্রত্যেকটা মানুষের ভালোবাসার ধরন ভিন্ন। বহিঃপ্রকাশের ধরনটাও আলাদা।
কেউ কেউ ভালোবাসায় উন্মাতাল হয়ে ওঠে। কেউবা নিজের আলাদা সত্তাকে অনুভব করে। আর যে কাউকেই ভালোবাসা যায়। সে হতে পারে মা কিংবা বাবা, ভাই কিংবা বোন, বন্ধু, স্বজন অথবা বিশেষ কেউ। তবে একেকজনের জন্যে ভালোবাসাটাও একেকরকমই হয়। চাইলেই কেউ অন্যের স্হান নিতে পারে না।
ভালোবাসা নিয়ে এই যে এতগুলো কথা, তার একটাই কারণ। আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি "বিশ্ব ভালোবাসা দিবস"। মূলত এই দিবসটির প্রাধান্য তরুণদের কাছেই সবচেয়ে বেশি। তো তরুণদের কথাই যখন উঠলো, ভালোবাসা নিয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনার বিষয়টা একটু আলোচনা করা যাক। কালের বিবর্তনে, প্রযুক্তির উন্নতিতে সবকিছুতেই পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। কিন্তু, সেক্ষেত্রে আবেগের পরিবর্তনটা ওভাবে চোখে না পড়লেও একটু সময় নিয়ে ভাবলেই পরিবর্তনের বেশ কয়েকটি পাকাপোক্ত বিষয় পরিলক্ষিত হয়।
আগেকার দিনে যখন মোবাইল ফোন অতটা সহজলভ্য ছিলো না, তখন মনের কথা প্রিয় মানুষটির কাছে পৌঁছে দিতে চিঠিই ছিলো একমাত্র পন্হা। তো মনের সকল সুপ্ত কথা, ভালো লাগা এবং ভালোবাসার সকল আবেগ ঢেলে দিয়ে লেখা চিঠিগুলো প্রিয় মানুষটার কাছে পৌঁছাতেও লেগে যেতো কয়েকটি দিন। কারণ পরিবহন ব্যবস্হাও উন্নত ছিলো না তখন। এর মধ্যে প্রিয়তমার চোখের জল ফুরিয়ে আসতো। হতাশা, বিভ্রান্তি বেড়ে যেতো কয়েক গুণ। অবশেষে "পিতা আমার বিবাহ ঠিক করিয়াছেন। তুমি যত জলদি সম্ভব আমারে আইসা লইয়া যাও" লেখা পত্র যখন প্রেমিকের কাছে পৌঁছাতো এবং সে তার প্রেমিকাকে উদ্ধারে যাত্রা আরম্ভ করতো, প্রেমিকা হয়তো তখন ফুলশয্যা সেরে নতুন সংসারে সব গুছিয়ে নিচ্ছে।
এই ধরনের সমস্যা কিন্তু আজকাল নেই বললেই চলে। প্রেমিকা একটা খুদে বার্তায় মুহূর্তেই জানিয়ে দিতে পারছে আগত বিপদের কথা। ভালোবাসার মানুষটির প্রতিমুহূর্তের খোঁজ রাখাও এখন মোটেই কঠিন কিছু নয়। তবুও, এই সহজলভ্যতার ফলে আবেগের জায়গাটায় বেশ তারতম্যও লক্ষ্যণীয় বটে! কেননা, আগের যুগে আট-দশদিন পর পাওয়া চিঠিটা হাতে পেয়ে যে ব্যাখ্যাতীত সুখানুভূতি হতো, আবার প্রত্যুত্তরে লেখা চিঠিতে যতটা আবেগ মিশ্রিত থাকতো, তা এই যুগের তরুণদের কাছে হয়তো অজানাই রয়ে যাবে!
এখন প্রিয় মানুষটার কথা ভেবে খুব সহজে রাতের পর রাত চোখের জলে বালিশ ভেজাতে হয় না। কারণ চাইলেই ফোনে কথা বলা সম্ভব হচ্ছে। আগেকার দিনের মতো একটুখানি কণ্ঠস্বর শোনার জন্যে ছটফট করতে হয় না। স্হানের দূরত্ব যতই হোক না কেন, প্রযুক্তির উন্নতির ফলে ভিডিও কলেই মানুষটাকে দেখা যায় যখন ইচ্ছে। আর আগের মতো রক্ষণশীল মনোভাব না থাকায় দেখা করাও যায় হরহামেশাই।
সেকালের লাজুক প্রেমিকারা প্রেমিকের মুখ দর্শনেই লজ্জায় লাল হয়ে আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করতো। একালের প্রেমিকারা নির্বিঘ্নে প্রেমিকের হাত ধরে চলাফেরা করে। হুড তোলা রিকশায় সুযোগ পেলেই প্রেমিকের উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শে সাড়া দেয়।
অধিকাংশ আধুনিক কপোত-কপোতীর জন্যে যৌনতার বিষয়টাও খুব স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। রাতের পর রাত কথা বলা যখন সহজ হয়ে উঠেছে, ফোনের দুপ্রান্তেই তখন তীব্র আবেগে শরীরও উষ্ণ হয়ে ওঠে। আবেগের লীলাখেলায় কামবাসনাও হয়ে ওঠে ভালোবাসার অংশ। মোবাইলের খুদে বার্তায় যুক্ত হতে হয় উত্তেজনাকর বিষয়।
ফলাফলস্বরূপ সম্পর্কের দুই-তিন মাসের ভেতরেই এখন শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বছরের পর বছর সংসারের পরও যখন সঙ্গী পরকীয়ায় জড়ায়, সেই ভাবনায় দুই-তিন মাসের প্রেমে শারীরিকভাবে লিপ্ত হওয়া সম্পর্ক কত দিন স্হায়ী হয়, সেটিও এক শঙ্কার বিষয়! কেননা, এ যুগে একসঙ্গে একাধিক সম্পর্ক স্হাপন করা মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়!
তবুও ধর্মীয় মনোভাব, পারিবারিক অনুশাসন, নিজস্ব সংস্কৃতি, সামাজিকতা রক্ষা এবং কিছু রক্ষণশীল পরিবারের প্রভাবে এখনও অনেক সম্পর্ক চোখে পড়ে, যেখানে ভালোবাসার অংশ হিসেবে যৌনতাকে নয়, একে অন্যের সম্মান রক্ষায় বেশি উদগ্রীব থাকে। তারা উত্তেজনা সামলাতে সঙ্গীকে নিয়ে রুমডেটে যায় না। বরং রাতের পর রাত বুকে বালিশ চেপে ফুলশয্যার স্বপ্ন দেখে। প্রিয় মানুষটির হাত ধরতে যেয়ে প্রতিবারই তারা লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। তাদের দৃষ্টিতে কামবাসনার পরিবর্তে থাকে একে অন্যের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস, নির্ভরতা এবং ভালোবাসা।
অত্যাধুনিক সমাজের অনেকেই আজকাল প্রশ্ন করেন, "যৌনতা তো ভালোবাসারই অংশ।” কিন্তু বাঙালি হিসেবে বিয়ের পূর্বে যৌনতা আমাদের সংস্কৃতিকে সমর্থন করে না। আর প্রত্যেকেরই উচিৎ নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও পারিবারিক অনুশাসন মেনে চলা। তারপরও বাকিটা যার যার দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিকতার ব্যাপার।
আসলে ভালোবাসা সম্পূর্ণ মনের ব্যাপার। দুটি অন্তরের মিলনে যেমন ভালোবাসা হয়, নিঃস্বার্থভাবে একপাক্ষিক ভালোবাসাও হয়। ভালোবাসায় যেহেতু কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তাই ভালোবাসা যখন তখন যে কারো সাথেই হতে পারে। শুধুমাত্র বিবেচ্য বিষয় এই যে, যাকে ভালোবাসবেন, তাকে বিনা স্বার্থে ভালোবাসতে হবে। তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে হবে এবং ইচ্ছে-অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হবে। কেননা, জোর করে সব আদায় করা গেলেও ভালোবাসা অর্জন করা যায় না। আর জগতের মধ্যে সেই অনেক বেশি ভাগ্যবান, যে একজন যোগ্য ভালোবাসার মানুষ পায়।
ভালোবাসতে নির্দিষ্ট কোনো দিন-ক্ষণ লাগে না সত্যি। তবুও, ভালোবাসার এই বিশেষ দিনে কাছের মানুষগুলোকে আরেকটু বেশি নিজের ভালোবাসার বিষয়টি উপলব্ধি করাতে চাওয়া কিন্তু মন্দ কিছু নয়। ভালোবাসা দিবসে সকলের প্রতি রইলো অফুরান ভালোবাসা। ভালোবাসার জোয়ারে ভাসুক প্রতিটি হৃদয়-এই প্রত্যাশাই রইলো।
লেখক : শিক্ষার্থী, লেখক।
এইচআর/এমএস