ভিআইপি শ্রেণি আবার কারা?
সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বা সমালোচিত শব্দ "ভিআইপি" এর অর্থ বা সাংবিধানিক কোন অবস্থান আছে কি না সেটি বুঝার জন্য একটু ঘুরাঘুরি করলাম। সরকারের কিছু ওয়েবসাইটেও ঘুরলাম। কিন্তু কোথাও এই জাতীয় কোন শব্দের সাংবিধানিক অর্থ খুঁজে পেলাম না। সবজায়গাতেই লেখা আছে বাংলাদেশের নাম হচ্ছে "গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ"।
আমি সংবিধান বিশেষজ্ঞ নই। তবে যতটুকু নাগরিক জ্ঞান আছে তাতে এটুকু জানি এই রাষ্ট্রটির অফিসিয়াল পরিচয় হচ্ছে "গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ" আর সরকারের নাম হচ্ছে "গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার"। যদি সঠিক বুঝে থাকি তাহলে এখানে "গণ" শব্দটির একটি বিশাল মানে আছে। এই রাষ্ট্রটি জন্ম হয়েছে একটি দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। সংগ্রামের সেই ইতিহাস এক দিনের নয় আর তার সবগুলোতেই অংশ নিয়েছিলো এ অঞ্চলের অতি সাধারণ মানুষ। তথাকথিত ভিআইপি বা সমাজের উঁচু তলার শহুরেরা নয়। প্রতিটা লড়াইয়ের নেতৃত্বেও ছিলো সাধারণ ও সুযোগবঞ্চিত জনতা। সেজন্যই হয়তো এই রাষ্ট্রটির নাম "ভিআইপি প্রজাতন্ত্রী" না হয়ে "গণপ্রজাতন্ত্রী" হয়েছে।
১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কোলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে দেয়া বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণ শুনছিলাম। বক্তৃতা নয় সেটা যেন ছিলো একটি কবিতা। কণ্ঠে ছিলো দৃঢ়তা, শব্দে ছিলো প্রতিজ্ঞা আর বাক্যে ছিলো বাংলাদেশের চিত্র। কেমন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে সেটিও তিনি পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। শত্রু মিত্র সবার জন্যই ছিলো পরিষ্কার বক্তব্য। বক্তব্যের শুরুতেই তিনি বলছেন,স্বাধীনতা পেয়েছি, বড় রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি।
এত রক্ত আর কোন জাত, কোন দেশ দেয়নাই যা আমার বাংলার মানুষ দিয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, আমাদের সে সংগ্রামে বৃদ্ধ থেকে বালক পর্যন্ত সবাই অংশ নিয়েছে। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ বাংলাদেশ কেমন করে চলবে সে বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেছিলেন,"বাংলাদেশ চারটি স্তম্ভের উপর চলবে। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মীয় নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এর মধ্যে কোন কিন্তু ফিন্তু নাই।"
আজকে স্বাধীনতার ৪৬ বছর শেষ করে এসে আমাদের সাধারণ জনগণকে আবার পিছনে ফিরে খুঁজতে হচ্ছে কী ছিলো আমাদের এই রাষ্ট্রের মূলনীতি? কেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আমাদের জাতির পিতা? হায়!! সেই পরিচয় খুঁজতে গিয়ে আজকের পরিচয়ে পাইনা কোন মিল। যে বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু বানাতে চেয়েছিলেন সবার, সে বাংলাদেশে আজকে ভিআইপি বলে জন্ম নিয়েছে আরেকটি নতুন "জাত" যারা সাধারণ মানুষের সাথে চলতে চান না, বসতে চান না। তাদের জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আলাদা রাস্তার, আলাদা অর্থনীতির। তাদের কেবল চাই আর চাই। যত উন্নত সুযোগসুবিধা সবই যেন কেবল সেই ট্যাগ লাগা মানুষদের জন্যই।
জীবন দিয়ে লড়াই করে যারা এই দেশকে স্বাধীন করেছিলো, মুক্ত করেছিলো পাকিস্তানি "ভি আই পি"দের হাত থেকে সেই তারাই আজকে অবহেলিত আর পাকিস্তানি ভি আই পি'র জায়গায় জন্ম নিইয়েছে বাংলাদেশি ভিআইপি শ্রেণি। এদেশের অর্থনীতি এখনও কৃষি নির্ভর। শিপ্লখাতের নেই কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। পোশাক শিল্পের যে উন্নতি তার ভিত শক্ত করে ধরে রেখেছে সস্তা শ্রমের মানুষেরা। কোথায় তাদের নাগরিক মৌলিক অধিকার? হিসাব বহির্ভূত ঘড়ির কাটায় চলে তাদের জীবনের চাকা। অনেকের ঘরেই আছে নানা অভাব অনটন।
সরকারের উন্নয়নের অর্থনীতির বেশিরভাগটাই ভোগ করছে সমাজের এই নব্য শ্রেণিটি। অথচ, ভোটের হিসাবে অবহেলিত জনতার সংখ্যাটাই বেশি। আমাদের সংসদের কাঠামোটি দাঁড়িয়ে আছে এই "অবলা" বা অ-ভি আই পি জনগণের কাঁধে ভর দিয়ে। ঢাকা শহরের নাগরিক জীবনে যে যন্ত্রণা তার মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পরিবহনের সমস্যা এবং যানজটের সমস্যা। এই যানজটের ভোগান্তির ক্ষেত্রে অবশ্য ভি আই পি আর অবলা সব শ্রেণির জনগণই সমান ভুক্তভোগী। হয়তোবা এই সাম্যকে দূর করতেই ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদের মিটিং এ প্রস্তাব এসেছে ভি আই পি'দের জন্য আলাদা লেন তৈরি করার।
প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকা শহরের রাস্তার মাপ যেখানে একই আছে সেখানে আলাদা লেন কেমন করে বানানো যাবে? তার মানে, এই অবলা নাগরিকের জায়গা থেকেই ভাগ বসাতে চাইছেন তারা। এটিকে যদি একটি প্রতীকী হিসেবে ধরে নেই তাহলে খুব সূক্ষ্মভাবে একটি ভয়ঙ্কর মানসিকতার পরিচয় পাবো আমরা। অ্যাম্বুলেন্স বা ফায়ার ব্রিগেডের মত জরুরি সেবায় নিয়োজিত গাড়ির আর ব্যক্তিগত গাড়ি চালানোর মধ্যে যে তফাত আছে সেটাকেও অস্বীকার করতে চাইছেন তারা। উল্টো পথে গাড়ি চালালে জনগণের বিরক্তির উদ্রেক হয়, যানজটের সৃষ্টি হয় তাই মহাত্মনরা নিজেদের জন্য আলাদা লেন চাইছেন।
উল্টো পথে গাড়ি চালানো কী আইনসিদ্ধ কো্ন ব্যাপার? তাহলে কেন আমার মত লাখো ঢাকাবাসী যারা সকালে খেয়ে না খেয়ে পেটের দায়ে রাস্তায় নেমে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে কাজের সন্ধ্যানে তারাও এই সুবিধা পাবে না? ভিআইপিদের কেউ কিন্তু আমার মত চাকরি করেন না। আমার মত তাদেরকে অফিসে দেরি করে গেলে বসের কালো মুখ দেখতে হয় না বা চাকরি চলে যাবার ভয় পেতে হয় না। তাহলে সময়ের দাম ওনাদের চেয়ে আমার কম কিসে?
প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি বা বিদেশী ভিআইপি যারা আসেন তাদের চলাচলের সময়তো রাস্তা আটকে ফাঁকা করে দেয়া হয়। এটা আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী যাদের বেতন হয় আমাদের মত অবলাদের ঘামে ভেজা উপার্জনের টাকা থেকে, যাদের রাখাই হয়েছে আমাদের সেবা নিশ্চিত করার জন্য তাদের জন্য কেন আমার চলাচলের রাস্তাকেও ছেড়ে দিতে হবে? রাষ্ট্রের সংজ্ঞা অনুযায়ীতো ওনাদেরই আমাদের চলাচলকে কেমন করে নির্বিঘ্ন করা যায় সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকার কথা, প্রস্তাব দেবার কথা।
ভিআইপি'দের যন্ত্রণা কেবল এই রাস্তায় নয়। আছে রাজনৈতিক ভি আই পিদের যন্ত্রণাও। রাস্তায় যানবাহনের সংকট, নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা সব মিলিয়ে এসব রাজনৈতিক ভি আই পিদের অবদানকেও মনে রাখবে এই পোড়াকপালি জনতা। তবে এইসব ভিআইপিরা যে হিসাবটাতে বরাবরি ভুল করেন সেটা হচ্ছে দিনশেষে রায় কিন্তু জনতার হাতে। ভিআইপিদের সংখ্যা আর কত? সংসদে যাদের পাঠানো হয় তারা আসেন কাদের দয়ায়? সংসদে বা ক্ষমতা কাঠামোর সুবিধাজনক জায়গায় যারা বসে আজকে ভি আই পি/সি আই পি নানা রঙধনু রঙে নিজেদের দেখতে চাইছেন তাদের সবার ভাগ্য নির্ধারন করে এই "অবলা" নাগরিকেরাই।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কী হয় সেটা যে কেউই চাইলে ইতিহাস জেনে নিতে পারেন। এদেরকে ক্ষেপিয়ে ব্রিটিশরা পারেনি, পাকিস্তানিরা পারেনি আর আপনারাতো বাংলাদেশী। এই বিভাজনের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসাটা আখেড়ে আপনাদের জন্যই প্রয়োজন। আমরা সাধারণ জনগণ কোন টাইটেল চাই না। চাই কেবল একটি নির্বিঘ্ন নিশ্চিত জীবন। চারটা খেয়ে পড়ে নিশ্চিন্তে পরিবার নিয়ে দিন কাটানোর জীবন। আর এই শপথ নিয়েই আজকে আপনারা আছেন সেই সাদা দালানের ভিতরে। দায়িত্বের এতটুকু হেরফের টেনে আনতে পারে মারাত্মক পরিণতি।
শেষ করছি, বঙ্গবন্ধুর ৭২ সালের সেই ভাষণের একটি অংশ দিয়ে যেখানে তিনি পাকিস্তানিদেরকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন,"মনে করেছিলো বন্দুক দিয়ে বাংলাদেশকে দাবায়ে রাখবে। আহাম্মকের দল জানে না, যে জাতি একবার জেগে উঠে, যে জাতি মুক্তি পাগল, যে জাতি স্বাধীনতাকে ভালোবাসে সে জাতিকে বন্দুক কামান দিয়ে দাবায়া রাখা যায় না, আহাম্মকের দল তা জানে না।"
লেখক : কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম