মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি এখনও যেভাবে তৎপর
একটি ভিডিও আপনারা অনেকেই দেখেছেন। লন্ডনের বাংলাদেশ দূতাবাসে একদল লোক চড়াও হয়েছিল। তারা দূতাবাসের ভেতরে ঢোকার আগেই বাইরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ছবি চরম ভাবে অবমাননা করেছে। মূলত এটাই ছিল তাদের মোটিভ। তারা এই উদ্দেশ্য নিয়েই সেখানে গিয়েছিল। তাদের দাবি ছিল- তারা দূতাবাসে স্মারক লিপি দেবে। ইউরোপ-আমেরিকায় বিক্ষোভ করতে চাইলে পুলিশের পারমিশন নিয়ে তা করতে হয়। তারাও পুলিশের পারমিশন নিয়ে বিক্ষোভ করেছে।
এই পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলি, আমেরিকায় এমন বিক্ষোভ করলে আগে থেকেই সেখানে পুলিশ হাজির থাকে। ফলে, দুই পক্ষ মুখোমুখি হলেই গ্রেফতার শুরু করে। ইংল্যান্ডে এখনো বেশি সভ্যতা দেখায় পুলিশ বিভাগ। তারা হাতে অস্ত্রও রাখে না। সেদিনও এমনটিই ঘটেছিল। অনেক সময় দেখা যায়, আক্রান্ত হয়ে না ডাকা পর্যন্ত অনেক সময় পুলিশ আসে না। দূতাবাসে সেটাই হয়েছে। এই হীন কাজ যারা করেছে এরা কারা?
আমরা জানি, বিলাতে জঙ্গীবাদী মাস্তানরা এই সময়ে বেশ শক্তিশালী।তারা না না লেবাসে সেখানে আছে। রয়েছে মুখোশ পরে। বিভিন্ন চ্যারিটি সংগঠনের নামে তারা
টিভি-তে চাঁদা চেয়ে হাজার হাজার পাউণ্ড তুলছে প্রতি সপ্তাহে। এদের অধিকাংশ ডোনার সহজ সরল মানুষ। যারা খুব স হজে বেহেশতে যাওয়ার কোশেস করেন।
কেউ কেউ মদের ব্যবসা করলেও, সেই অর্থ ধর্মীয় তমদ্দুনের কাজে বিলিয়ে দিতে কসুর করেন না।
একটা বিষয় খুব স্পষ্ট বলা দরকার, যারা আওয়ামী লীগ কিংবা বঙ্গবন্ধু বিরোধী, এদের বাপ-দাদা একসময় হয় মুসলিম লীগার, না হয় মওদুদীপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন। তারা মনে প্রাণে বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেন নি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মওলানা মওদুদী বৃটিশ থেকে পাক-ভারতের মুক্তিকে মেনে নেন নি। এই পরম্পরায় তার দল জামায়াত পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামও মেনে নেয় নি। এসব কথা আমাদের সকলের জানা আছে।
এই আওলাদে রাজাকার প্রজন্ম এখন বেশ বড় আকার ধারণ করেছে। তারা দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের হাতে কোটি কোটি টাকা আছে। আমরা জানি জাতির জনককে হত্যার পরদিনই সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কেন দিয়েছিল? সৌদিদের বাঙালি জাতির প্রতি এমন ঈর্ষা কেন ছিল? এর নেপথ্যে ছিল সেই পাকি মওদুদীবাদ।
এরা মুজিবকে অস্বীকার করে। এরা বাংলাদেশকে অস্বীকার করে। তাদের জানা দরকার, যদি একজন শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক না দিতেন- তাহলে আজ যারা বৃটিশ কিংবা আমেরিকান পাসপোর্ট বহন করে, তারা সেদেশে যেতেই পারতো না। আমাদের মনে আছে, ১৯৬০-১৯৬৮ সময়ে যারা বৃটিশ ভাউচারে বিলাত এসেছিলেন- তাদের পাসপোর্ট ভ্যারিফাই হয়ে আসতে হতো রাওয়ালপিন্ডি থেকে। আমার জানা মতে বেশ কিছু সিলেটি পাসপোর্ট সময় মতো না পাওয়ার কারণে ইংল্যান্ড যেতে পারেন নি ৬০ দশকে।
এসব কথা কি এই প্রজন্ম মনে রাখছে? কেন রাখছে না ? আমরা কি এতোই নিমকহারাম? লন্ডন দূতাবাসে যারা স্মারক দিতে গিয়েছিল- তারা বেতরে ঢুকে জাতির জনকের ছবি অবমাননা কেন করেছে? তারা তো জেনে শুনে এই কাজটি করতেই গিয়েছিল। তাই নয় কি? যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তিনি বলেছেন তারা তা, তারেক রহমানের নির্দেশে করেছেন।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তারেক রহমান ইংল্যান্ডে থেকে এর আগে জাতির জনক সম্পর্কে যে বাজে মন্তব্য করেছিলেন- তা কি আমরা ভুলে গেছি? আমরা মনে রেখেছি, ২০১৫ সালে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা ছিল তারেকের বক্তব্য প্রচার ও প্রকাশ করা যাবে না।
এ বিষয়ে একটি রিট করা হয়েছিল। রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেছিলেন অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, সাহারা খাতুন এমপি, এস এম মুনীর, শ ম রেজাউল করিম ও সানজিদা খানম এমপি। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ রায়। শুনানির একপর্যায়ে আদালত, যারা এমন নিউজ করেছিলেন সেই- দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকা, অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিবাদী করতে বলেছিলেন।
'বঙ্গবন্ধুকে রাজাকার ও শখের বন্দি বললেন তারেক' শিরোনামে গত ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে এ রিট আবেদন করা হয়। আবেদনে বলা হয়েছিল, আইনের দৃষ্টিতে তারেক রহমান একজন পলাতক আসামি। একজন পলাতক আসামির বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রচার বা প্রকাশ হতে পারে না। আবেদনে আরো বলা হয়, তারেক রহমান পলাতক আসামি হিসেবে সংবিধান লঙ্ঘন করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অপরাধমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন।
এ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি দেশের ১৬ কোটি মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করছেন এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছেন, যা দণ্ডনীয় অপরাধ। রিট আবেদনে আরো বলা হয়, পলাতক এই আসামির বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচারের মাধ্যমে তাঁকে এ জাতীয় বক্তব্য দিতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। গণমাধ্যম পুনঃ উৎপাদন না করলে এর পুনরাবৃত্তির সুযোগ থাকবে না। রিট আবেদনের এ বক্তব্য গতকাল আদালতে উপস্থাপন করেন অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম। এরপর একে একে অন্যান্য আইনজীবী শুনানি করেন।
শুনানীতে বিশিষ্ট আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন সংবিধানের চতুর্থ তফসিল ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করে বলেন, 'তারেক রহমান সংবিধান ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লঙ্ঘন করেছেন।' তিনি বলেন, 'আমি গিয়েছি ইন্দোনেশিয়ায়, সেখানে জাতির পিতার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না। ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায়। তারপরও ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর বিরুদ্ধে সেখানে কেউ বক্তব্য দেয় না। বিশ্বের কোথাও কেউ জাতির পিতার অবমাননা করে না। অথচ তারেক রহমান একজন পলাতক আসামি থাকাবস্থায় আমাদের জাতির পিতার বিরুদ্ধে একের পর এক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।'
শ ম রেজাউল করিম সংবিধানের ৭(ক) ও ৩৯ অনুচ্ছেদ পাঠ করে বলেন, তারেক রহমান জাতির পিতা, স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তা সংবিধানের লঙ্ঘন। তিনি বলেন, "আমাদের সুপ্রিম কোর্ট বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক ও স্বাধীনতার ঘোষক বলে রায় দিয়েছেন। এর পরও বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তি করে বিভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছেন তারেক রহমান। বঙ্গবন্ধুকে 'পাক বন্ধু' বলছেন। তারেক রহমানের এ বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে আদালত অবমাননা।"
তারেক সব কাজ খুব কৌশলে করে যাচ্ছেন। আমরা জানি তারেক রহমানের পিতা মুক্তিযুদ্ধকালীন মেজর পদবীতে ছিলেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না।তিনি নিজে জীবদ্দশায় নিজেকে কখনও 'স্বাধীনতার ঘোষক' দাবি করেন নি। তাহলে আজ তাকে এত মহান করে দেখাবার চেষ্টা কারা করছে? এটা তারাই করছে যারা মুজিবের ডাকে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি।
লন্ডনে যারা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে এদের দেশে-বিদেশে বিচারের আওতায় আনা হোক। ভিডিও ফুটেজ দেখে এদের চিহ্নিত করা হোক। তাদের বাপ-দাদার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করলে অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে। তারা এই কাজটি করে মূলত রাষ্ট্রব্যবস্থার আইন বিভাগকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। যা গোটা জাতিসত্তার জন্য অবমাননাকর।
নিউইয়র্ক, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
লেখক : নিউইয়ক প্রবাসী সাংবাদিক, কবি, কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/এমএস