বই পার্বণ
শুরু হলো একুশের বইমেলা। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণে এটি আরেক পার্বণ যার জন্য বছর ব্যাপী অপেক্ষায় থাকে সাহিত্য প্রিয় মানুষ। একদম শুরুতে উৎসাহের প্রধান জোগানদার ছিলেন প্রকাশক সম্প্রদায়, এখনও তারাই এই মেলার হাল ধরে আছেন। তবে একটু একটু করে গোটা ব্যাপারটি প্রকাশকদের গণ্ডি ছাড়িয়ে এক সামাজিক অনুভবে পরিণত হয়েছে। এখন এই আত্মশক্তিই এর চালক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর মেলা হয়, তাই মেলায় এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের পদচারণা বেশি থাকলেও বই পড়া, বই দেখা আর বই কেনার মাদকতা এখন সব খানে। প্রতি বছর একটিই সুর- আমরা মিলেছি আজ প্রাণের মেলায়। এই মেলার বাইরেও আজ বইমেলা হয়, রাজধানীর বাইরেও হয়। প্রতিটি জেলা শহরে, আধা-গ্রাম-আধা-শহর গোছের অঞ্চলেও হয়। তবে সব মেলার বড় মেলা বাংলা একাডেমির একুশে গ্রন্থমেলা। আমাদের অনেক উৎসবের বড় উৎসব একুশের বইমেলা।
পহেলা বৈশাখ, একুশের বইমেলা এমনসব উৎসব যেগুলোয় কোনও ধর্মীয় নামগন্ধ থাকেনা। তাই এগুলো সব মানুষের উৎসব। মেলা বলে না ডেকে এই উৎসব হয়ে উঠছে বই পার্বণ। উদার, অসাম্প্রদায়িক এবং একই সাথে ধর্মপ্রাণ বাঙালির প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা মুক্ত বুদ্ধির চর্চা। সেই বুদ্ধির চর্চাই বইমেলাকে লালন করেছে, পালন করে যাবে।
সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি আগেও ছিল, এখন আরও সংগঠিত হয়েছে, এখন জঙ্গি গোষ্ঠি সবাইকে চোখ রাঙায়, এই জঙ্গি গোষ্ঠির হয়ে বইও লেখে নতুনভাবে জন্ম নেওয়া ঘৃণাজীবী সম্প্রদায়, কত বই আটকে দেওয়া হয়, প্রকাশকে জেলে যেতে হয়, মুক্তবুদ্ধির লেখককে মেলা প্রাঙ্গনেই হত্যা করা হয়, রাষ্ট্র জঙ্গির সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে নতি স্বীকার করে পুলিশ দিয়ে বই পরীক্ষা নিরীক্ষা করায়।
মেলা কর্তৃপক্ষও প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ করে। কিন্তু এতোসব প্রতিবন্ধকতা সত্বেও আমাদের সামগ্রিক সামাজিক প্রক্রিয়া-বিক্রিয়ার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন হয়ে আছে এই একুশের বইমেলা। শাসক গোষ্ঠি আর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির এই আধিপত্যবাদী মানসিকতায় বইমেলা আগামী দিনের কি আদল নেবে তা এখনই বলা যাচ্ছেনা।
ললাটে কি আছে তা আর এখন ভাবছিনা। তবে বইয়ের জগত নিয়ে কিছু ভাবনা আছে। বলা হচ্ছে বইমেলার পরিধি যত বাড়ছে, বই পড়ার অভ্যেস ততই অন্তর্হিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সাহিত্য জগতের চরিত্রটা এমন যে, বড়লোকেরা কোনও কালেই তেমন একটা বই কেনেন না। তাদের বাড়িতে বিদেশি বইয়ের সম্ভারই চোখে পড়ে।
মেলার ভিড়ে হানা গিয়ে কেনার আগ্রহ হয় না ওদের। অন্যদিকে, গরিব নিম্নবিত্তের বই কেনার সঙ্গতি নেই। একমাত্র ভরসা মধ্যবিত্ত। কিন্তু নতুন ডিজিটাল মধ্যবিত্তের জীবনে যে মূল্যবোধ সৃষ্টি হচ্ছে, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উপকরণ জমা হচ্ছে তার হৃদয়ে আর চরিত্রে, এতে করে তাদের সন্তানরাও বই পড়ার প্রয়োজন অনুভব করছে কম। বইমেলায়, বইয়ের জগতে তাই বৈদ্যুতিনগ্রন্থের উপস্থিতি বেড়ে চলেছে।
কোন বই ৩০০ কপি বিক্রি হলেই লেখক ও প্রকাশ সন্তুষ্ট। তবে কী, বইমেলায় এই যে এতো এতো মানুষ আসে, তারা কেবল বিনোদনে তাদের অধিকার প্রকাশ করতেই ভিড় করে? বইমেলার আনুষ্ঠানিক ভারী মঞ্চে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পার করে প্রতিদিনই পণ্ডিতজনেরা কঠিন কঠিন বিষয়ে আলোক বিতরণ করেন। কিন্তু গ্রন্থপাঠ বাড়েনা। এসব বক্তৃতা জরুরি, কিন্তু তার চেয়েও জরুরি বই মেলায় আসা, ঘুরাফিরা করার হুজুগ নিছক হুজুগ কিভাবে না থাকে তার ফর্মুলা খোঁজা।
সাহিত্যিকের নামে বইমেলার প্রধান প্রশাসক যদি আমলা মানসিকতার হন, তবে তিনি একথা হেসেই উড়িয়ে দেবেন। তার কাছে বিবেচ্য হবে মেলা করা, পুলিশের-প্রশাসনের আইনকলা পুঙ্খানুপুঙ্খ মেনে চলা ও ক্ষমতার উচ্চস্তরে বিহাররত ব্যক্তি বিশেষের নানা মর্জি ও বায়না মেটানো। তার আরও কিছু কাজ থাকে। সরকারি শর্ত যথাযথ পালিত হচ্ছে কিনা তা নির্ণয় করে কোন বই উঠিয়ে ফেলতে হবে, কোন প্রকাশককে পুলিশি রিমান্ডে পাঠাতে হবে ইত্যাদি। আর এমন প্রশাসনিক চাপে বই মেলা আর মুক্ত বুদ্ধি চর্চার অভয়ারণ্য থাকেনা।
বইয়ের বাণিজ্য অবশ্য বেশ লাভজনক সেটা আবার বোঝা যায়। লেখকরা রয়েলটি পাক বা না পাক বই বাণিজ্য বেশ সম্প্রসারিত হচ্ছে প্রতিবছর। আর তাই গন্ধ শুঁকে বৃহৎ পুঁজির মালিকরাও এখন বইমেলায় উপস্থিত। এক সঙ্গে এত সঙ্গতিসম্পন্ন ক্রয় প্রিয় মানুষ বইমেলায় জড়ো হচ্ছেন, সেই সুযোগটা বাজারের স্বার্থে ব্যবহারের প্রতিজ্ঞা তাদের চোখেমুখে। তাদের দৌলতে বড় বড় বইমেলার অঙ্গ হিসেবে নানা ধরনের সাহিত্য সভাটভা হয়, সাহিত্য পুরস্কার টুরস্কারেও এখন এদেরই ভূমিকা সবার চেয়ে বেশি।
কিন্তু অন্যসব ক্ষেত্রের মতো এখানেও বাজার আছে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকতা নেই। গুটি কয়েক প্রকাশক ছাড়া, বেশিরভাগ প্রকাশকেরই গ্রন্থ সম্পাদক নেই। লেখক কী লিখলেন, তথ্য ও যুক্তি কতদূর ঠিক থাকল সেটি দেখা হয় খুব কম। ভূরি ভূরি বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ভূরি পরিমাণ অখাদ্য। আর অধিকাংশত সেসব নিয়েই বছরে এই বইমেলায় প্রকাশিত হয় চার হাজারের মতো বই। পরিমাণটা অনেক। গুণমানে কয়টি বই পাশের দেশের সাথেই পাল্লা দিতে পারে সে এক বড় প্রশ্ন।
বই প্রকাশ আসলে একটি উৎপাদনমুখী কাজ। বই উৎপাদন বলতে প্রচ্ছদ, বাঁধাই, কাগজ ও ছাপা বুঝি আমরা। কিন্তু পাণ্ডুলিপি থেকে বই হয়ে ওঠার পুরো প্রক্রিয়াটি আসলে বেশ যত্ন দাবি করে। পাণ্ডুলিপি ছাপতে দেওয়ার জন্য ‘তৈরি’ করা, বার বার প্রুফ দেখে বইয়ের টেক্সট বা মূল পাঠ্যকে বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য করা। এখানে লেখকের যেমন ঘাটতি থাকতে পারে, আবার প্রকাশকের কারণেও পাঠবিকৃতি ঢুকে যেতে পারে।
বাংলা বইয়ের জগতে সম্পাদক বলতে ঠিক কী বোঝায় সে ধারণাটাই তৈরি হয়নি। সম্পাদকের এই অভাবের ফলেই অধিকাংশ বাংলা বইয়ের পাঠ থেকে প্রচ্ছদ সবই যেনতেন প্রকারে বাজারজাত হয়। বই একটি পণ্য, উৎকৃষ্ট পণ্য। পণ্যটি সু-উৎপাদিত কিনা সেটাই প্রশ্ন। এই সুনির্মাণে অলংকরণ থেকে সম্পাদনা বই তৈরির সব দিকে খামতি কমবে, যত্ন বাড়বে সেই আশা করছি আগামীর জন্য।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস