‘আমরা অত্যাচারীদের ভালোবাসি!’
প্রায় পরিবারেই এমন ছেলে মেয়ে থাকে, খুব ভালো, সবার কথা শোনে। বাসায় আলুটা মরিচটা যখন যা লাগে সে পড়ার বই ঠেলে ছোটে। ইলেকট্রিক মিস্ত্রী কি মাঝরাতে বাবার শ্বাসটান, রহিম চাচাকে বাসে তুলে দিয়ে আসা- সবকিছুতেই সেই ভালো ছেলে বা মেয়ে চার হাত পায়ে দৌড়াচ্ছে। মা মাথায় হাত বুলিয়ে আদর দেন বা বেশি শান্তি পেলে “জানের আসান দিলি মা ” বলে দোয়া দেন। কিন্তু দিন শেষে মাছের মুড়ো, সুন্দর জামা, পকেটমানি, স্মার্ট ফোন, চড়া টিউশনের কোচিং বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো থেকে শুরু করে তোয়াজ তমিজ করা হবে কিন্তু বাসার অন্য বেত্তমিজ সন্তানটাকেই।
-ও তো একটু অন্যরকম, না দিলে তো বিগড়ে যাবে! কি জানি কি করে বসে! এবার এই মেটাফোরটাকে আজকের রাজনীতির পরিভাষায় আঁকি। সেই ভালো ছেলেটাই হলো ছাত্র সংহতি বা ছাত্র ইউনিয়ন, সাদা কথায় বাম-প্রগতিশীল বা বাম রাজনীতি যারা করেন। আর সেই বেত্তমিজ তেল চকচকে সন্তান কারা তা আর ব্যাখ্যার বোধহয় প্রয়োজন নাই। আমি অবশ্যই শুধু ২০১৮র ২৩ জানুয়ারির ঘটে যাওয়া ঢাবির উপাচার্যের কার্যালয়ে ঘটে যাওয়া লংকাকান্ডে এই উপসংহার টানিনি বা স্বাধিকার আন্দোলনে আজকের প্রধান দলগুলোর ভূমিকা ভুলে যাইনি। কিন্তু, পরিসংখ্যানে ২৩শ জানুয়ারি নতুন যুক্ত এক তারিখ মাত্র।
পত্রিকামতে সেদিন আহত হলো সাধারণ ছাত্রছাত্রী ৪০ জন। অপরদিকে আক্রমণকারী ছাত্রলীগের দাবিতে তাদের পক্ষের আহত শিক্ষার্থী ১০ জন। প্রক্টরের দাবি ছাত্রলীগ ভিসিকে উদ্ধার করেননি। যদিও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের (২৫ জানুয়ারির পত্রিকা সূত্রে) বলেছেন ভিসির আহ্বানেই ছাত্রলীগ ভিসি স্যারকে উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে প্রক্টর স্যারের মন্তব্যে “মন খারাপ" ছাত্রলীগের বক্তব্য হচ্ছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা প্রায় সবাই ছাত্র সংগঠনের ছিল। অথচ তাদের সাধারণ শিক্ষার্থী বলা হচ্ছে। তো ছাত্রলীগে কি শিক্ষার্থী নেই? তারা আগে ঢাবির শিক্ষার্থী, পরে ছাত্রলীগ। দেড়যুগ আগের ইতিহাসে ২০০২ এর ২৩ জুলাই শামসুন্নাহার ছাত্রী হলে পুলিশি বর্বরতায় আহত, থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া ছাত্রী ছিল অনেক বেশি। রাজনৈতিক পরিচয়ে হলে বসবাসকারী বহিরাগতদের হল থেকে উচ্ছেদের এই ন্যক্কারজনক ঘ্টনায় তৎকালীন উপাচার্য ও প্রক্টরের পতন হয়েছিল, ছাত্রদল দেশজুড়ে গণধিক্কৃত হয়েছিল।
২০০৫ এ চারুকলার শিক্ষার্থী রোকেয়া হলের আবাসিক ছাত্রী হ্যাপী নিহত হবার ঘটনায় প্রক্টরের পদত্যাগ চাওয়ায় আহত হয়েছিল ১০০ সাধারণ ছাত্র ছাত্রী। তৎকালীন উপাচার্য এস এম এ ফায়েজকে উদ্ধারের জন্য ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরাও সেদিন ২৩ জানুয়ারির মতই একই কাণ্ড ঘটিয়েছিল। সে সময়ে অবশ্য উপাচার্যকে ঘেরাওয়ের পেছনে ছাত্রলীগের সমর্থন ছিল, এখন যেমন ছাত্রদলের ভূমিকার কথা উঠেছে। আজকের ছাত্রলীগের স্থানে সেদিন ছিল ছাত্রদল। ২০০৫ এ সেদিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে ভিসি এসএমএ ফয়েজ ও প্রক্টর একেএ ফিরোজকে সেদিন ছাড়িয়ে নিয়ে যায় ছাত্রদলের নেতারা।
২৩ জানুয়ারির ঘ্টনায় ছাত্রলীগের নারী ক্যাডারদেরও ভূমিকা দেখা গেছে । ২০০৫ এ সেদিন আন্দোলনরত নারী শিক্ষার্থীরাও রেহাই পায়নি ছাত্রদলের পুরুষ ক্যাডারদের হাতে। আজকের ছাত্রলীগের নেতাদের বিরূদ্ধে ছিল যৌন নিপীড়নের অভিযোগ, সেদিনও ছাত্রদলের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে নারীদের শ্লীলতহানিরও। এ ঘটনায় তৎকালীন ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে হামলার তথ্য প্রমাণ থাকলেও সেসব তৎকালীন বিএনপি সরকার আমলে নেয়নি। এবং আরো ভীতিকর হল- আন্দোলনকারী নারীদের ওপর সেদিন যারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদেরকে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলো তাদের কেউ কেউ পরবর্তীতে দলীয় লাঠিয়াল পদে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের পুরস্কার হিসেবে চারুকলাতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন।
একই ধারাবাহিকতায় আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে উদ্ধার করার জন্য আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের ঝাঁপিয়ে পড়াই প্রমাণ দিচ্ছে এক যুগ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি আলাদাভাবে কোন শিক্ষা দেয় না। এই ঘটনা এই জানান দেয় যে, সরকারি দলের মাস্তানি কমেনি, বেড়েছি। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসিকে রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের কাঁধ থেকে নামেনি। আজ থেকে ১২ বছর আগে এ দায়িত্ব ছিলো ছাত্রদলের ওপর। আজ সেই দায়িত্বে রয়েছে ছাত্রলীগ। এদিকে ২০১৫ এর পহেলা বৈশাখে জঘন্যতম নারী নিপীড়নের ঘ্টনায় একা এগিয়ে মোকাবেলা করে হাত ভেঙেছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের লিটন নন্দী। প্রায় ২ বছর পর সেইদিন ভিসির কার্যালয়ে যেন তার উপরে পহেলা বৈশাখে উৎপীড়নের বাধা দেবার সব সুদে আসলে শোধ দেবার জন্য সব ফুঁসে উঠেছিল। উপর্যুপরি রডের আঘাতে লিটনের পিঠ সেদিন ছিল ক্ষত-বিক্ষত।
এবং এই যে রাজতন্ত্রে চলমান দুইদল পাল্লার এদিক ওদিক স্থান বদল করে ভূমিকা অমর অব্যয় অক্ষয় রেখেছেন, এই খেলায় জনগণের আনুগত্যই হচ্ছে সবচেয়ে দর্শনীয় । সর্বসাধারণের সকল দাবি দাওয়ায় রাস্তায় নামা, মার খাওয়ার দায়ভার বরাবরই বামেদের, কিন্তু দৈ যাবে নেপো`র পাতে। মেয়র ইলেকশনেও যেমন ভোট নেই জুনায়েদ সাকীর, তেমন আজ প্রায় ৩ যুগ পর ডাকসু নির্বাচন হলেও কোনদিনই ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ভেঙে বামদল জয়যুক্ত হবেন না। এমনকি পহেলা বৈশাখের ঘ্টনা মাথায় রেখেও কিন্তু নারী শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে বামদলকে ভোট দিয়ে এগিয়েও দেবে না। না কোনদিন ডাকসুতে তা হয়েছে, না ইওকসুতে (বুয়েট) হয়েছে।
কারণ, আমরা মেসোকিস্ট, আত্মনিগ্রহকামী বা মর্ষকামী। আমরা অত্যাচারীদের ভালোবাসি। বন্দুকবাজ পাড়ার মস্তান ছেলেটার প্রতি ডিমান্ডিং মেয়েরা যেমন গোপন দুর্দমনীয় প্রেম লালন করে, সেই কঠিন প্রেমে আমরা আবদ্ধ হয়ে গেছি। বামদল হলো পাড়ার সেই ভালো ছেলে, যাকে দিয়ে সব কাজ করিয়ে নিতে হয়। প্রেম দিতে হয় আর গলায় মালা দিতে হয় বখাটে বন্দুকবাজকেই। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। সেই বীর মানেই হয়তো অস্ত্রবাজ। জ্ঞান আর দর্শন পুঁজি করে যুক্তি বুদ্ধি আর মানবতার দাবিতে আন্দোলন করে চলা “হারমোনিয়াম পার্টি”দের তাই কেবল ব্যবহৃতই হতে হয়।
প্রখ্যাত একজন সাহিত্যিকের সাম্প্রতিক লেখনীতে খুব উপযুক্ত কিছু লাইন ছিল, “পাবলিক একদিক থেকে আবার দারুণ সেয়ানা।
নিজেদের আন্দোলন নিজেরা না করে বাম-প্রগতিশীলদের দিয়ে করায়। মুষ্টিমেয় দেশপ্রেমিকদের দিয়ে করায়। দেশপ্রেমিকরা মার খায়, রক্তাক্ত হয়, পচে মরে জেলখানায়, গালভরা শহীদ নাম নিয়ে আত্মদান করে। আর ভোটের সময় পাবলিক গণশত্রুদের দেওয়া শাড়ি-লুঙ্গি পরে, পান-বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে দল বেঁধে ভোট দিয়ে আসে নৌকা বা ধানের শীষে।
দেশে পুঁজিবাদ। কিন্তু পাবলিক আছে সামন্তযুগের দাসত্ব নিয়ে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি বলে কিছু নেই পাবলিকের মনে। আছে মুজিব পরিবার এবং জিয়া পরিবার। পাবলিক ঐ দুই পরিবারকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দিয়েছে নিজেদের মাথা, বুক, গিলা, কলিজা- সবকিছু। মেরুদণ্ড তো নাই-ই।
“মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।”
কিন্তু এই পাবলিক তো মানুষ নয়। শুধুই পাবলিক।”
লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম