ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

পরিবেশ আর উন্নয়ন কী পরস্পরের শত্রু?

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ১২:৩১ পিএম, ২৯ জানুয়ারি ২০১৮

এক ছেলে পরীক্ষার ফল নিয়ে বাসায় ফিরলো। বাবা বললেন, তোর রোল কত হয়েছে? ছেলে হেসে বললো, তিন। বাবার পাল্টা প্রশ্ন, ছাত্র কয়জন? এবার ছেলে মুখ কাচুমাচু করে বললো, তিন জন। একই অবস্থা হয়েছে বাংলাদেশের। ‘এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স (ইপিআই) ২০১৮’ শীর্ষক এক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৯। সূচকে বিবেচনায় ছিল কয়টি দেশ জানেন? ১৮০টি! পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ একটি দেশ আছে, এটাই আপাতত স্বস্তির। সেই দেশটির নাম বুরুন্ডি, আফ্রিকার গরীব একটি দেশ।

এমনিতে দেশে নানা সমস্যা। বিরোধী মতকে দমন করা হয় নিষ্ঠুরভাবে, মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয় পদে পদে, ব্যাংক খাতে চলছে নৈরাজ্য। কিন্তু তবুও আন্তর্জাতিক কোনো সূচকে বাংলাদেশকে খারাপ করতে দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। দেশের ভেতরে রাজনীতি নিয়ে যতই কামড়াকামড়ি করি না কেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ মানে আমাদের সবার। আন্তর্জাতিক সূচক প্রশ্নে আওয়ামী লীগ-বিএনপির ঊর্ধ্বে থাকে বাংলাদেশ। তাই আন্তর্জাতিক কোনো সূচকে অল্প অর্জনেও তৃপ্তি থাকে অনেক, আবার কোনো খারাপ খবরে মন খারাপ হয় অনেক বেশি।

ইদানিং অবশ্য নানা অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে দারুণ গতিতে। কোনো কোনো বিবেচনায় বাংলাদেশের অগ্রগতি চমকে করে দেয় উন্নত অনেক দেশকেও। একসময় বাংলাদেশকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে, এমন অনেক দেশও এখন বাংলাদেশের প্রশংসা করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। পদ্মা সেতু বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে অনেক টানাপড়েন হলেও এর চেয়ারম্যান বাংলাদেশে এসে প্রশংসার ভাষা হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ প্রশ্নে আমি একটু বেশিই কট্টর। তাই কোনো সূচকে বাংলাদেশ খারাপ করেছে, এমনটা শুনলে প্রথমে অবিশ্বাস করি, মন খারাপ করি। কিন্তু পরিবেশ রক্ষা সূচকে বাংলাদেশ ১৮০ দেশের মধ্যে নিচের দিক থেকে দ্বিতীয় হয়েছে শুনে অবিশ্বাস করিনি। বিশ্বে পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ দেশ আছে, এটা জেনে বুরুন্ডির জন্য করুণা হয়েছে।

পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশের পারফরম্যান্স যে খারাপ এটা বোঝার জন্য বিশাল জরিপ করতে হয় না। আমরা আমাদের চারপাশে তাকালেই টের পাই। সম্প্রতি প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স (ইপিআই) ২০১৮’ শীর্ষক যৌথ গবেষণায় ১০টি বিষয়কে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। বিষয়গুলো হলো: বায়ুর মান, পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন, ক্ষতিকর ভারী ধাতু, জীববৈচিত্র্য ও বাসস্থান, বনায়ন, মৎস্য সম্পদ, জলবায়ু ও জ্বালানি, বায়ুদূষণ, পানিসম্পদ এবং কৃষি।

এবারের তালিকায় বাংলাদেশের গড় স্কোর ২৯ দশমিক ৫৬। ২০১৬ সালের তালিকায় বাংলাদেশের গড় স্কোর ছিল ৪১ দশমিক ৭৭। অর্থাৎ পরিবেশ রক্ষার বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান গত দুই বছরে আরও খারাপ হয়েছে। দুই বছর পরপর এ সূচক প্রকাশিত হয়।০ এর আগে ২০১৬ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ তালিকায় ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৩। আর ২০১৪ সালের তালিকায় ১৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৯। তারমানে পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশের পারফরম্যান্স প্রতিবছরই খারাপ হচ্ছে। বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ, বায়ুর মান উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনায় ব্যর্থতা। পরের দুটি বিষয় হয়তো একটু তাত্ত্বিক। কিন্তু ঢাকার বাতাসের মান যে খারাপ এবং দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে তা প্রতি নিঃশ্বাসে টের পায় নগরবাসী। প্রতিদিন সবুজ কমছে, বাড়ছে দালান-কোঠা, গাড়ি; বাড়ছে ধুলা আর দূষণ।

পরিবেশ রক্ষায় যে আমাদের নজর নেই, তা বোঝাতে খুব বেশিদূর যেতে হবে না। যশোর রোড সম্প্রসারণে বেশকিছু শতবর্ষীসহ অন্তত আড়াই হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সহজ বিকল্প থাকার পরও খালি কিছু টাকা বেশি লাগবে, এই অজুহাতে এই গাছ কাটার নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। পরিবেশবাদীদের তুমুল প্রতিবাদ আর শেষ পর্যন্ত আদালতের হস্তক্ষেপে আপাতত রক্ষা পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত যশোর রোড। আমরা যখন যশোর রোড নিয়ে ব্যস্ত, তখন দেশের অন্তত দুটি জায়গায় গাছ কাটা সারা হয়ে গেছে সবার চোখের আড়ালে।

কুমিল্লা একসময় ছিল ব্যাংক আর ট্যাংকের শহর। ব্যাংক হারিয়ে গেছে। ট্যাংক মানে বড় বড় জলাধারগুলোও আস্তে আস্তে মরে যাচ্ছে বা ভরাট হয়ে যাচ্ছে। শান্ত-ছিমছাম কুমিল্লা শহর এখন ইট-কাঠ কংক্রিটের জঙ্গল। সবুজের দেখা মেলাই ভার। এই ইট-কাঠ কংক্রিটের জঙ্গলে এক টুকরো শ্বাস ফেলার জায়গা ছিল সার্কিট হাউস চত্বরে অল্পকিছু গাছ। কুমিল্লা থেকে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ইনবক্সে ছবি পাঠিয়ে জানালেন, সার্কিট হাউস চত্বরের সেই গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। কারণ আর কিছু না উন্নয়ন। দোতলা সার্কিট হাউস ভেঙ্গে সুরম্য বহুতল ভবন করা হচ্ছে।

উন্নয়ন অবশ্যই লাগবে। কিন্তু উন্নয়ন করতে গেলেই প্রথম কোপটা গাছের ওপর দিতে হবে কেন? গাছের মুখে প্রতিবাদের ভাষা নেই বলে? উন্নয়ন নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, উন্নয়ন লাগবেই। কিন্তু পরিবেশ বাঁচিয়ে উন্নয়ন করতে পারলেই যে সেটা টেকসই হয়, সেটা যেন আমাদের নীতিনির্ধারকদের মাথাতেই থাকে না। কুমিল্লা সার্কিট হাইসের গাছ কাটার সময়েই খবর পেলাম হেমায়েতপুর-মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের উন্নয়নের জন্য প্রায় চার হাজার গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। পরিবেশ আর উন্নয়ন যেন পরস্পরের প্রবল প্রতিপক্ষ। অথচ হওয়ার কথা পরিপূরক।

রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে, জল ঘোলা হয়েছে। সুন্দরবন ঝুঁকির মুখে এই যুক্তিতে পরিবেশবাদীরা অনেক দিন ধরেই এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতা করে আসছেন। কিন্তু সকল কান্না, প্রতিবাদ হারিয়ে গেছে অরণ্যে। বাংলাদেশের পরিবেশবাদীরাই নয় শুধু, ইউনেস্কোও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু কাজ হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করলে ইউনেস্কো খুব ভালো। কিন্তু রামপালের বিরোধিতা করলে খুব খারাপ। ডাবল স্ট্যান্ডার্ড!

কদিন আগে দৈনিক প্রথম আলোতে রোজিনা ইসলামের করা ‘সরকারের নজর বনের জমিতে’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট দেখে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বন বিভাগ এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৬৮৯ দশমিক ৪৯ একর বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে। এক বছরের মধ্যে নতুন করে আরও ১৬ হাজার একর বনভূমি চেয়ে মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য ৪ হাজার ৮৩৫ একর বনভূমিতে আশ্রয়শিবির গড়ে তোলা হয়েছে।’

সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ কিন্তু সরকার সাংবিধানিক এই বাধ্যবাধকতা প্রতিপালন তো করছেই না, বরং করছে উল্টোটা। উন্নয়নের নামে বনভূমি সাবাড় করা হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-এসডিজি পূরণে বনভূমির পরিমাণ দেশের মোট ভূখন্ডের ১৭ দশমিক ৬২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করতে হবে। কিন্তু সরকার হাঁটছে উল্টোপথে।

যেভাবে দেশজুড়ে গাছ কেটে সাবাড় করা হচ্ছে, উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বনভূমি বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে তাতে দুইবছর পর পরিবেশ রক্ষা সূচকে ইনশাল্লাহ আমরা নিচ দিক থেকে প্রথম হতে পারবো আশা করি। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, উন্নয়নের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা বুঝি পরিবেশ। পরিবেশের কথা বললেই কিছু মানুষ প্রশ্ন করে, আপনি কি উন্নয়ন চান না? অবশ্যই চাই। উন্নয়ন যেমন চাই, চাই পরিবেশ সংরক্ষণও। একটা ছাড়া আরেকটি টেকসই হয় না। টেকসই উন্নয়নের জন্য চাই পরিবেশসম্মত উন্নয়ন। দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই এই বিষয়টি বোঝা দরকার। কারণ একবার গাছ কেটে ফেললে আবার সেই অবস্থায় যেতে অনেক সময় লাগবে। তাই গাছ কাটার আগে, বন বরাদ্দ দেয়ার আগে সবগুলো বিকল্প চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে।

২৮ জানুয়ারি, ২০১৮

probash

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন