এ খবর সত্যি হোক
দীর্ঘসময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু ছেলে-মেয়েদের কষ্ট এবং দুঃখ লাঘবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার দাবি বেশ জোরেশোরেই উঠছে। এমন কী সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মহামান্য রাষ্ট্রপতিও এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসিও এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিভিন্ন সময়ে অনুরোধ করেছে। কিন্তু তা বাস্তবায়নে তেমন কোন উদ্যোগ এ অবধি চোখে পড়েনি। বরং বলা যায়, সকল বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ করে পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ ব্যাপারে সবসময় অনীহা প্রকাশ করে এসেছে। ফলে এ ব্যাপোরে কাজের কাজ এতদিনে কিছুই হয় নি।
তবে, গত ১৬ জানুয়ারি, ২০১৮ দেশের সকল পত্রিকায় প্রকাশিত একটা খবরে আবারও মনে আশার সঞ্চার হয়েছে। এমন খবরে আমি দারুণ খুশির জোয়ারে ভেসেছি। খবরটা হচ্ছে, আগামীবার অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা যেন গুচ্ছ বা সমন্বিত পদ্ধতিতে নেয়া যায় সে ব্যাপারে কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ তৈরির লক্ষ্যে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিকে আগামী এক মাসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দেয়ার সময়সীমাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
আশা করা যায়, যদি কমিটির সুপারিশ মেনে সকল বিশ্ববিদ্যালয় এ ব্যাপারে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করে তাহলে আসছে শিক্ষাবর্ষ থেকেই গুচ্ছভিত্তিক এ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে তেমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এমন পরীক্ষা পদ্ধতি হলে আর্থিক অপচয়, যাতায়াত, থাকা খাওয়ার ভোগান্তি শেষ হবে। তাছাড়া নতুন এক ক্যান্সার যেটা সমাজে ভয়াবহ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে সেটা হচ্ছে “প্রশ্নফাঁস” তাও বন্ধ করা সম্ভবপর হবে। এবং সেই সাথে এর উদ্যোক্তা কোচিং সেন্টারগুলোর বেপরোয়া ব্যবসাও বন্ধ করা যাবে বলে ধারণা করা যায়।
উল্লেখ্য, এ বছরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। এটা এক অশনি সংকেত। দীর্ঘসময় ধরে চলে আসা এ ক্যান্সারের বিরুদ্ধে তাই কঠোর হতে হবে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে একে ঝেটিয়ে বিদায় করা সম্ভবপর হবে বলে অনেকের মতো আমিও মনে করি। এ বছর যখন পত্রিকায় দেখেছি যে যানজটের কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ভর্তিচ্ছু ছেলে-মেয়ে ভর্তি পরীক্ষাই দিতে পারেনি তখন একদম অবাক হইনি। কারণ প্রচলিত ভর্তি পরীক্ষা চলতে থাকলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
ছেলেমেয়েদের অনেকেই পরীক্ষা না দিতে পেরে কান্নায় ভেঙে পড়েছে। যারা প্রকাশ্যে কাঁদেনি তারা কি খুশি খুশি মনে বাড়ি ফিরেছে? না সেটা নয়। তাদের অন্তরের কষ্ট তারা অন্তরেই চেপে গেছে। কারণ তারা জানে এমন অমানবিক পদ্ধতি যখন যুগের পর যুগ ধরে চলতে থাকে, পরিবর্তনের দাবি উঠলও যখন তা আমলে নেয়া হয় না তখন চুপ করে যাওয়া ছাড়া আর কিই বা করার থাকে!
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ছেলেমেয়েদের এমন স্বপ্নভঙ্গের দায়ভার আমরা কাকে দিব? নিয়তি নাকি ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি? যদি পরীক্ষা পদ্ধতি দায়ী হয় তাহলে তা পরিবর্তন করে যুগোপযোগী করতে কেন সময়ক্ষেপণ করতে হবে সেটা আমার কাছে আজ অবধি বোধগম্য নয়। আর যদি নিয়তিই এর জন্য দায়ী হয়ে থাকে তাহলে এমন সিস্টেম অনন্তকাল ধরে চলতে থাকুক। কারণ নিয়তি পরিবর্তনের ক্ষমতা তো মানুষের হাতে নেই। কুম্ভকর্ণের ঘুম না ভাঙলে তার দায় তাই কারো নয়। না কুম্ভকর্ণের, না নিয়তি, না জনতার। সেক্ষেত্রে আসুন সবাই সমস্বরে বলি “জয়তু চলমান ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি”। যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক।
শিক্ষকরা জাতির বিবেক। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকেরা জাতির ক্রান্তিকালে নানাবিধ দিকনির্দেশনা, উপদেশ, পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের ভোগান্তি হচ্ছে সেটা তারা বুঝতে পারছেন না– এটা মানতে অন্তর সায় দেয় না। আবার বুঝতে পারার পরে তা লাঘবে তারা উদ্যোগী হবেন না সেটা ভাবতেও অসহায় লাগে।
আমিও পেশায় শিক্ষক। মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা করি। ফলে যৌক্তিক এমন দাবি যখন পত্রিকায় দেখি শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনীহার কারণে বাস্তবায়ন কর সম্ভবপর হচ্ছে না তখন নিজের কাছে নিজেকে অসহায় লাগে। নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছ মনে হয়। মেডিকেল কলেজগুলো (সরকারি এবং বেসরকারি একসাথে) যদি সফলতার সাথে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন পারবে না সেটা আমার মোটা মাথায় একদমই ঢুকতে চায় না। বরং টেকনিক্যাল সমস্যা যদি কিছু থেকেও থাকে সেগুলোকে তো আরো উন্নততর প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সহজেই উতরে যেতে পারে।
কারণ প্রযুক্তিবিদ তো বিশ্ববিদ্যালয়েই সৃষ্টি হয়ে থাকে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা না হওয়াটা তাই একটু কঠোরভাবে বললে বলা যায় জাতিগতভাবে আমাদের ভেতরে যে ঔপনিবেশিক মানসিকতা বিরাজমান- তারই ফল। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে হাবভাব দেখলে মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত এ বিষয়টাতে ঔপনিবেশিক ধ্যান ও ধারণা লালন করেন বলেই এমন একটা জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয় তাদের কাছে গুরুত্বহীন হিসেবেই থেকেই যাচ্ছে। স্বয়ং মহামান্য রাষ্ট্রপতির ইচ্ছাও শেষ অবধি ধোপে টিকছে না।
পরিশেষে, একটা কথাই শুধু মনে হয় সিস্টেম যদি যুগোপযোগী না হয়; যদি তা গতানুগতিক মানসিকতাকেই লালন করে তাহলে সবার আগে দরকার মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতার যদি উন্নতি না হয় তাহলে পদ্ধতির উন্নতি করা কষ্টসাধ্য হবে-এটাই স্বাভাবিক। এ বছর থেকেই সমন্বিত বা গুচ্ছ যাই বলি না কেন- সেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করি। আর তাহলে সেটাই হবে এ বছরে জাতীয় জীবনে এক অন্যরকম প্রাপ্তি এবং তা অবশ্যই অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপারও হবে। সে আনন্দ উদযাপনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে আমার তাই ভালোই লাগছে।
লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক। সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।
এইচআর/এমএস