ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

হেফাজতের কালো ছায়া তাবলীগে

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ১২:১৯ পিএম, ২২ জানুয়ারি ২০১৮

চৌদ্দগ্রামের মুন্সীরহাটে মেষতলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ফজলুল হক তাবলীগ জামাতের অনুসারী ছিলেন। তিনি আমাকে খুক স্নেহ করতেন। তার প্রভাবে তখন তাবলীগের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার পাল্লায় পড়ে ১৯৮৪ সালে একবার টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায়ও এসেছিলাম। তবে ইজতেমা আমার কাছে যতটা না ধর্মীয় সমাবেশ ছিল, তারচেয়ে বেশি ছিল পিকনিক। বয়স কম হওয়ায় আমাকে তেমন কাজ করতে হতো না। আমি দিনভর ইজতেমা ময়দান ঘুরে বেড়াতাম। আর লোকজন হারিয়ে গেলে তাদের সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতাম।

এক ফাঁকে একদিন কাছ থেকে বিমান দেখতে বিমানবন্দরেও এসেছিলাম। তবে বিশ্ব ইজতেমায় একটা জিনিস আমাকে খুব টেনেছিল- সৌহার্দ্য। কারো প্রতি কারো বিদ্বেষ নেই। সবাই সবাইকে সাহায্য করছে। সম্প্রীতির এক দারুণ ক্ষেত্র। তাবলীগ জামাত মূলত মানুষকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেয়। তাদের কাজে খারাপ কিছু পাইনি। তবে একটা ব্যাপারে খটকা তখনও ছিল, এখনও আছে। ইসলামের দাওয়াত দিতে তাবলীগের অনুসারীদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আল্লাহর পথে বেরিয়ে পড়তে হয়।

৪০ দিনে হয় এক চিল্লা, ৮০ দিনে দুই চিল্লা, ১২০ দিনে তিন চিল্লা। এই চিল্লার সময়টা তারা বাড়িঘর, সংসার ছেড়ে চলে যান। এখন তবু মোবাইল আছে, চাইলে যোগাযোগ রাখা যায়। কিন্তু আগে একটা মানুষ ১২০ দিনের জন্য সংসার ছেড়ে, স্ত্রী-সন্তান ভুলে ঘুরে ঘুরে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছে, ধর্মীয় বিবেচনায় এটা কতটা ভালো বা মন্দ জানি না। আমার ভালো লাগেনি, লাগে না। কদিন আগে আমার আগের বাড়িওয়ালা তিন চিল্লা দিতে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। তাবলীগ জামাত সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবীদের আন্দোলন। চিল্লার সময় সবাইকে নিজ নিজ খরচ বহন করতে হয়। তবুও তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন।

১৯৮৪ সালের পর তাবলীগের হয়ে ইজতেমায় যাওয়া হয়নি। তবে সাংবাদিকতা শুরুর পর একাধিকবার পেশাগত কাজে তুরাগ তীরে গেছি। সবার স্বেচ্ছাশ্রমে হয় বিশাল এই আয়োজন। আস্তে আস্তে ইজতেমার কলেবর বেড়েছে। হজের পর ইসলাম ধর্মালম্বীদের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমাবেশ এটি। এখন যারা যান তারা তো বটেই, স্যাটেলাইট টেলিভিশনে আখেরি মোনাজাত সরাসরি সম্প্রচারের সুবাদে কোটি মানুষ তাতে অংশ নেয়। বাড়তে বাড়তে এখন এতটাই বড় হয়ে গেছে ইজতেমা, একবারে আর তা করা যায় না। তাই প্রতিবছর দুই দফায় ইজতেমা হয়। তাতে ৬৪ জেলার মানুষ দুই ভাগে অংশ নেন। এবার ঢাকায় হয়েছে ইজতেমার ৫৩তম আয়োজন।

১৯২০ সালে সালে ভারতের নয়াদিল্লীর মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভীর (রহঃ)এর হাত ধরে গড়ে ওঠা এই ইসলামী আন্দোলন এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। তবে এবার বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে যা হলো, তা আগে কখনো হয়নি। তাবলীগ জামাতের আমির মাওিলানা সাদ কাান্ধলভী বাংলাদেশে এসেও ইজতেমা ময়দানে যেতে পারেননি। যেতে পারেননি মূলত হেফাজতে ইমসলামীর অনুসারীদের বাধার কারণে। হেফাজতের কালো থাবা বিস্তৃত হয়েছে ইজতেমা ময়দানেও।

মাওলানা কান্ধলভীর বেশকিছু বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সবগুলো আমি জানি না। পত্র-পত্রিকায় যা দেখেছি, তার কয়েকটি বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত আছে আমারও। কিন্তু ভিন্নমত আছে বলেই, আমি তাকে বক্তব্য দিতে দেবো না, এমনটা আমি কখনো মনে করি না। বরং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ধারণাটাই হলো, তোমার মতের সঙ্গে আমার ভিন্নমত আছে। কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় প্রয়োজনে আমি জীবন দেবো। কিন্তু আমাদের এখানে এখন সবকিছু উল্টো। কারো কোনো কথা পছন্দ না হলেই আমরা দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

প্রথমে গালাগাল, প্রয়োজনে চাপাতি নিয়ে হামলা। মাওলানা সাদ কান্ধলভী গত বেশ কয়েকবছর ধরেই বিশ্ব তাবলীগ জামাতের আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৮৯ সাল থেকে তিনি বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিচ্ছেন। ১৯৯৬ সাল থেকে বয়ান করছেন। গত দুই বছর ধরে আমবয়ানের পাশাপাশি আখেরি মোনাজাতও পরিচালনা করছেন। কিন্তু এবার তার আসার পথেই বাধা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল একটি পক্ষ। তার আসার দিন ৭ ঘণ্টা বিমানবন্দর সড়ক অবরোধ করে গোটা ঢাকাকেই জিম্মি করে ফেলে মাওলানা সাদের বিরোধীরা।

এই বিরোধীরা কারা? হেফাজতে ইসলামীর অনুসারীরা। আগের মত এবারও তারা সংঘবদ্ধতার শক্তিতে দাবি আদায় করতে চাইলো এবং করলোও। মাওলানা সাদ বাংলাদেশে আসতে পারলেও ইজতেমা ময়দানে যেতে পারেননি। তাকে ফিরে যিতে হয়েছে। কেন তিনি পারেননি? তার মূল অপরাধটা হলো, হেফাজতে ইসলামের আমির মাওলানা শাহ আহমেদ শফি তাকে অপছন্দ করেন। ব্যস, আর কোনো কারণের দরকার নেই। বাংলাদেশে তেঁতুল হুজুর নামে পরিচিতি আল্লামা শফি তাকে অপছন্দ করেন, তাই তাকে ঢুকতে দেয়া হবে না, ঢুকলেও ইজতেমা ময়দানে যেতে দেয়া হবে না, হয়ওনি।

তাহলে বাংলাদেশে কি এখন আল্লামা শফির ইচ্ছাই শেষ কথা? ২০১৩ সালের ৫ মে মধ্যরাতে মতিঝিল থেকে বিতাড়িত হয়েছিল আল্লামা শফির অনুসারীরা। কিন্তু এরপর থেকেই গোপনে চলে সমঝোতার চেষ্টা। তাদের অধিকাংশ দাবিই মেনে নেয়া হয়েছে। গতবছরই পাঠ্যপুস্তক বদলে ফেলা হয়েছে হেফাজতের ইচ্ছামত। এ নিয়ে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হলেও কাজ হয়নি। এ বছরও পাঠ্যপুস্তকে বহাল আছে হেফাজতের চাওয়া। তাদের দাবি মেনে হাইকোর্টের সামনে থেকে নারী ভাস্কর্য অপসারণ করা হয়েছে।

যে হেফাজত সরকার পতনের আকাঙ্খা নিয়ে ঢাকা এসেছিল, তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে প্রধানমন্ত্রীরও। মাওলানা সাদ কান্ধলভী ইস্যুতে আবারও আমরা দেখলাম আল্লামা শফি তথা হেফাজতের ক্ষমতা, প্রভাব। আপনার সঙ্গে যদি অনেক লোক থাকে, ন্যায় হোক, অন্যায় হোক যে কোনো দাবি আদায় করতে পারবেন আপনি। আল্লামা শফির নিয়ন্ত্রণে আছে সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন কওমী মাদ্রাসা। এই মাদ্রাসার কয়েক লাখ শিক্ষার্থী আল্লামা শফির কথায় চলে। ব্যস, এখন আপনি যেভাবে বলবেন দেশ সেভাবেই চলবে।

আগেই বলেছি ১৯২০ সালে মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভীর হাত ধরে তাবলীগ জামাতের যাত্রা শুরু। মাওলানা ইলিয়াসের মৃত্যুর পর তার ছেলে মাওলানা ইউসুফ তাবলীগের নেতৃত্বে আসেন। তার মৃত্যুর পর তাবলীগ জামাতের আমির হন তার ছেলে মাওলানা সাদ কান্ধলভী। এখানেই আমার প্রবল আপত্তি। বিতর্ক থেকে দূরে থাকতে তাবলীগ জামাতে কখনো রাজনীতি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়না। কিন্তু এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মত তাবলীগ জামাতও পারিবারিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।

মাওলানা ইলিয়াসের পর তার ছেলে মাওলানা ইউসুফ, তারপর তার ছেলে মাওলানা কান্ধলভী! এরপর নিশ্চয়ই সাদ কান্ধলভীর ছেলে আমির হবেন? এইটুকু আপত্তি ছাড়া মাওলানা সাদের ব্যাপারে আমার আর কোনো আপত্তি নেই। তবে তার নানা বক্তব্য নিয়ে দ্বিমত আছে। ইতিমধ্যে তিনি তার বক্তব্য নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। এমনকি হেফাজতে ইসলামীর মূল কেন্দ্র ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসাও সাদ কান্ধলভীর দুঃখপ্রকাশ গ্রহণ করেছে। কিন্তু মেনে নেননি আল্লামা শফি।

শিয়া-সুন্নীর প্রবল বিরোধ ছাড়াও ইসলামে নানান তরিকা আােছ। একপক্ষ দাঁড়িয়ে মিলাদ পড়ে তো আরেকপক্ষ বসে। একপক্ষ মাজারে যায় তো, আরেকপক্ষ যায় না। একপক্ষের সঙ্গে আরেকপক্ষের প্রবল বিরোধ, মতে চরম অমিল। কিন্তু সবাই যদি ভিন্নমতকে দমন করেেত নামে, তাহলে নিজেদের মারামরিতেই ধ্বংস হয়ে যাবে ইসলাম। তাই ইসলামের স্বার্থেই ছোটখাটো বিরোধ ভুলে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

বিশ্বজুড়ে এখন যেভাবে ইসমলামকে হেয় করার চেষ্টা হয়, জঙ্গীবাদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে যেভাকে ইসলামকে ধ্বংস করার চেষ্টা হচ্ছে, তাকে এই বড় শত্রুদের কবল থেকে ইসলাম রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু হজের পর ইসলামের সবচেয়ে বড় সমাবেশেও বিভক্তির বিষ আনলেন আল্লামা শফির অনুসারীরা। তাতে কি ইসলামের লাভ হলো না ক্ষতি? ইতিমধ্যেই মাওলানা সাদের সমর্থকরা, বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় সরিয়ে নেয়ার হুমকি দিয়েছে। সেটা যদি হয়, তাতে কার লাভ?

সাদ কান্ধলভীর যে বক্তব্য নিয়ে আল্লামী শফির আপত্তি, সেটাতে আমারও আপত্তি। মাওলানা সাদ বলেছেন, যারা কোরান পড়িয়ে টাকা নেবে, ব্যাভিচারকারিণীরাও তাদের আগে বেহেশতে যাবে। তার এই বক্তব্য যদি অনুসরণ করা হয়, তাহলে একদিন বিশ্বে আর কোরান পড়ানোর বা শেখানোর লোক পাওয়া যাবে না। আর কোরান শিখিয়ে যদি অর্থ নিতে না পারেন, তাহলে তিনি চলবেন কিভাবে? খাবেন কি? আর তার এই বক্তব্যের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের স্বার্থের তীব্র সংঘাত রয়েছে। কারণ হেফাজতে ইসলামের অধিকাংশ অনুসারী মাদ্রাসা-মক্তবে কোরান পড়িয়েই জীবিকা নির্বাহ করেন।

তাই মাওলানা সাদের কথা মানলে তাদের সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে। আমি মনে করি, কোরান পড়িয়ে টাকা নিলে কোনো অসুবিধা নেই। তবে বিষয়টাকে যেন বাণিজ্য বানিয়ে ফেলা না হয়। এখন যেভাবে মাওলানারা আগাম লাখ লাখ টাকা নিয়ে হেলিকপ্টারে ওয়াজ করতে যান, আমার শঙ্কাটা সে কারণেই। তবে মাওলানা সাদ ভুল বলেছেন বলেই তাকে বাংলাদেশে আসতে দেয়া যাবে না, কথা বলতে দেয়া যাবে না, এটা হতে পারে না। মাওলানা সাদ ইতিমধ্যে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তারপরও আল্লামা শফির কোনো ভিন্নমত থাকলে তিনি তা বলতে পারেন। কিন্তু আরেকজনের বলার স্বাধীনতা হরণ করে নয়। খালি কিছু মাদ্রাসা ছাত্র নিয়ন্ত্রণে আছে বলেই, আল্লামা শফি যা বলেন, তাই মানতে হবে, এমন কোনো কথা নেই।

inner

২০ জানুয়ারি, ২০১৮

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন