মাহির আত্মহত্যা এবং বিপন্ন বিস্ময়
আফ্রিদা তানজীম মাহি। ভেবেছিলাম মাহিকে নিয়ে কিছু লিখবো না। কি হবে লিখে? একের পর এক এইভাবে চলে যাবে আমাদের প্রিয় সন্তানরা, সহকর্মীরা, বন্ধুরা। আমরা লিখবো। আহাজারি করবো। তারপর আমাদের মধ্য থেকেই আবার কেউ তার রক্তের ভিতর বোধ করবেন ‘বিপন্ন বিস্ময়’। অতঃপর আবার তাকে নিয়ে আমরা লিখতে থাকবো। এইভাবে ক্রমশ নিজেরাই চলে যাবো এক আলোহীন-অন্ধকারহীন জগতে। যে জগতে বোধ নেই, ভালোবাসা নেই।
তার মৃত্যুর আগে মাহিকে আমি চিনতাম না। তার মাকেও না। ফেসবুকের নিউজফিডে হঠাৎ দেখতে পাই সংবাদটি। তারপর দেখি মাহির সৃষ্টিকর্ম। ছবি আঁকার অদ্ভুত প্রতিভার অধিকারী মেয়েটি মাত্র বিশ বছর বয়সেই জীবনের প্রতি এতটাই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লো যে উটের গ্রীবার মতো গাঢ় অন্ধকারে সে একা চলে গেল। যে কোন সৃষ্টিশীল মানুষের আত্মহত্যা আমাকে কতগুলো মুখ মনে পড়িয়ে দেয়।
আমার মনে পড়ে আকতার জাহান জলি, নভেরা দীপিতা, সুমনা মেহেরুন, বাশিরা ইসলাম, মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়, মিতা নূর, ডলি ইব্রাহিমের কথা। মনে পড়ে মায়াকোভস্কি, এসেনিন ভ্যান গঘের সৃষ্টিকর্ম। আরও অনেক সৃষ্টিশীল মানুষের কথা মনে পড়ে। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত, অনেকের শুধু নাম শুনেছি। তারপর সবগুলো মুখ মিলে মিশে এক হয়ে এক অভিমানীর মুখে রূপ নেয়। জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে, ‘এত কি অভিমান, ভুল বোঝা বল কত’।
মনে পড়ে তখন নিউ ইস্কাটন রোডের গাউস নগরে থাকতাম। আমার ঘরের জানালা থেকে দেখা যেত মোনা টাওয়ার নামে একটি বারো তলা ভবন। সেই ভবনের সামনে দিয়ে আমার নিত্য চলাফেরা। একদিন বেলা ১১টায় সেখান দিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। দেখি পথের উপর চাপ চাপ রক্ত। মাত্র দশমিনিট আগে সেখান থেকে সরানো হয়েছে এক তরুণীর মৃতদেহ। ২০ বছর বয়সী একটি মেয়ে বারো তলার উপর থেকে লাফিয়ে পড়েছিল তার বাবার সঙ্গে অভিমান করে। চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায় তার দেহ।
বহুদিন পর্যন্ত ঘরের জানালা দিয়ে মোনা টাওয়ারের দিকে চোখ পড়লেই আমি যেন দেখতাম একজন অভিমানী পড়ছে, পড়ছে উচুঁ ভবন থেকে। কি ভাবছে সে ঠিক পতনের মুহূর্তে? আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু আত্মহত্যা করেছিল আঠারো বছর বয়সে। মায়ের শাড়ি গলায় জড়িয়ে। মায়ের উপর অভিমান ছিল তার। আজও স্বপ্নে ফিরে আসে তার মুখ। প্রতিবছর এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষার পর আত্মহত্যা করে বেশ কয়েকজন। আমি তাদের মৃত্যু সংবাদে দেখতে পাই আমার চেয়ে এক বছরের বড় একটি মেয়ের চেহারা। সেও আত্মহত্যা করেছিল এসএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগ পাওয়ার লজ্জায়।
আমার আরও মনে পড়ে সাংবাদিক জয়শ্রী জামানের দুই সন্তানের একসঙ্গে আত্মহত্যার ভয়াবহ ঘটনা। আমি ভয়ে ভয়ে তাকাই যে কোন কিশোর কিশোরীর মুখে। পরিচিত কেউ হতাশার কথা বললেই আমার বুকের ভিতর ভয়ের দামামা বাজে। কেন আত্মহত্যা? কেন অকালে দুনিয়া থেকে চলে যাওয়া? কেন একা ওরা হাঁটে লীথির কিনারে? আত্মহত্যাকে মানসিক ব্যধি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অনেক মনোবিজ্ঞানী ও চিকিৎসক। অনেকে এটিকে জিনগত বৈশিষ্ট্যও বলছেন। বাংলাদেশের নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি একথা বলছে পরিসংখ্যান।
আত্মহত্যাকে বিষণ্নতার একটি উপসর্গ বলেও চিহ্নিত করেছেন মনোবিজ্ঞানীরা। আমাদের চারপাশে অনেকেই এমন ভয়াবহ বিষণ্নতা নিয়ে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। জানি না কে কখন কোন অঘটনে শেষ করে দিবে নিজের জীবন। আত্মহত্যা তো শুধু একজনের মৃত্যু নয়। আত্মহত্যাকারীর আশপাশের স্বজনরাও কিন্তু ভয়াবহ মানসিক আঘাত প্রাপ্ত হন। আত্মহত্যাকারী সন্তানের বাবা-মায়ের বা আত্মহত্যাকারী বাবা-মায়ের সন্তানের পক্ষে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার কাজটি ভয়ানক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ভয়ংকর অপরাধবোধ ও আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকেন তারা। তাদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেওয়ার আশংকা থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার হিসাব অনুযায়ী সারা বিশ্বে প্রতিদিন তিন হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। বছরে প্রায় আট লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। এইসব আত্মহত্যার বেশিরভাগই ঘটে বিষণ্নতার কারণে। বিষণ্নতা একটি মানসিক রোগ। এর আগেও আত্মহত্যা প্রসঙ্গে অনেক লেখায় বলেছি, আবারও বলছি, আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি খুববেশি অবহেলিত।
প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং কলে কারখানায়, অফিসে, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন কাউন্সেলিং সেন্টার। ছাত্র শিক্ষকদের মানসিক সাহায্য, পরামর্শ দেওয়ার জন্য কাউন্সেলিং সেন্টারে প্রশিক্ষিত কর্মী থাকতে হবে। নিয়মিত স্বাস্থ্য চেক আপের পাশাপাশি মানসিকভাবে কেউ কোনো অস্বস্তিতে ভুগছে কিনা সেটিও যদি চেকআপ হয়, পরামর্শ দেওয়া হয় তাহলে অনেক অপমৃত্যু আমরা রোধ করতে পারব।
ছোট খাটো সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে হয়তো কর্মীদের নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। তাই মতিঝিল, কারওয়ান বাজারের মতো বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে সরকারি উদ্যোগে এ ধরনের কাউন্সেলিং কেন্দ্র থাকা প্রয়োজন। শরীরের স্বাস্থ্যের মতো মানসিক স্বাস্থ্যও কিন্তু নিয়মিত চেক আপ করতে হয়। সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শ মানুষকে সাহায্য করতে পারে। সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শ নিয়ে মানুষ বিষণ্নতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
আমাদের প্রতিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র, সরকারি ও বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতালে দরকার বিষণ্নতা বিষয়ক পরামর্শ ও চিকিৎসা কেন্দ্র। এই বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্রচুর চিকিৎসক ও কর্মী প্রয়োজন। পিআইবির উদ্যোগে আয়োজিত একটি কর্মশালায় আমি অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছিলাম কিভাবে নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণ একজন ভিকটিম ও তার পরিবারকে বাঁচাতে পারে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় থেকে। রোধ করতে পারে আত্মহত্যা। দরকার মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক হেলপ লাইন। এই হেলপ লাইনে যদি একজন সম্ভাব্য আত্মহত্যাকারী বা বিপন্ন মানুষ ফোন করে তার দুঃখের কথা বলে বা মানসিক সমস্যার কথা বলে তাহলে সাহায্য পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
অনেক সময় হেলপ লাইনে কথা বলতে বলতে আত্মহত্যার প্রাথমিক ঝোঁকটা কেটে যেতে পারে। বেঁচে যেতে পারে অনেক অমূল্য জীবন। আমি যখনি চিন্তা করছি মাহীর মা আফরোজা মুন্নীর কথা, চিন্তা করছি একজন মায়ের কথা যিনি তার সন্তানের নিথর দেহ নামাচ্ছেন ফাঁসি থেকে, যখনি চিন্তা করছি জয়শ্রী জামানের কথা, আমার বুকের ভিতরটা আতংকে, বেদনায় আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এমন মৃত্যু আর দেখতে চাই না আমরা। অতি দ্রুত চালু হোক হেলপ লাইন। চালু হোক মানসিক সেবা কেন্দ্র। চালু হোক কাউন্সেলিং সেন্টার। আত্মহত্যাকারী নয় আত্মজয়ী ভবিষ্যত প্রজন্মকে দেখতে চাই আমরা।
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস