ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচন : বড় দুই দল যে ইঙ্গিত দিচ্ছে

মাসুদা ভাট্টি | প্রকাশিত: ০২:৩২ পিএম, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮

২০১৮ সালের শুরুতেই যে দেশে নির্বাচনী ঝড় উঠবে সেটা জানা গিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের জনপ্রিয় মেয়র আনিসুল হকের আকস্মিক করুণ মৃত্যুর পর পরই। তিনি অসুস্থ থাকা অবস্থাতেই অনেকে দৌড় ঝাঁপ শুরু করেছিলেন বড় দু’টি দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের কাছে মনোনয়ন লাভের আশায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তখন সমালোচনাও হয়েছিল এ বলে যে, রাজনীতি আসলেই নির্মম, কেউ কোথাও কারো জন্য অপেক্ষা করে না, তা সে যতোই জনপ্রিয় হোক না কেন।

আনিসুল হক চলে গেছেন না ফেরার দেশে, এখন তার শূন্যস্থানে একজন মেয়র নির্বাচন জরুরি এবং তার প্রক্রিয়াতে ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে এবং দেশের রাজনৈতিক পক্ষগুলো তাদের প্রার্থীও ঘোষণা করেছে। যদিও প্রার্থী নিশ্চিত হওয়ার পরেও সঠিক সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ ছিল সবার মনেই।

আজ যখন এ লেখাটি লিখছি তখনই আদালত তিন মাসের জন্য এ নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করেছে। ধরে নিচ্ছি নির্বাচন কমিশন এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে এবং তাতে তারা জয়লাভ করবে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্ন সেখানে নয়, প্রশ্ন হলো এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দেশের বড় দু’টি দল যে প্রার্থী নির্বাচন করেছে তাদেরকে নিয়ে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন যদি জাতীয় নির্বাচনের সামান্য ইঙ্গিতও বহন করে থাকে তাহলেও ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচনে দুই বড় দলের প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্নই উত্থাপন করা যায় এবং একজন নাগরিক হিসেবে সে প্রশ্ন উত্থাপন জরুরিও।

বিএনপি-জামায়াত জোট রাজনৈতিক ভাবে এখন বেশ খারাপ সময় পার করছে। বিশেষ করে এ জোটের ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত শাসনামলে দেশের যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার পরিণতি এখনও এ জোটকে ভোগ করতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে জামায়াতের শীর্ষনেতৃবৃন্দকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে এবং বেশ কয়েকজন নেতৃবৃন্দ বিদেশে অবস্থান করছেন।

যদিও সাংগঠনিকভাবে জামায়াত দুর্বল হয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণনেই। কিন্তু একথাও সত্য যে, জামায়াতের অর্থায়ন যে সবদেশ থেকে আসতো তার মধ্যে সৌদি আরব ও পাকিস্তান উল্লেখযোগ্য ছিল, এ দু’টিদেশের পক্ষ থেকেই এখন জামায়াতের অর্থায়নে ভাটা পড়েছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকেই জানা গেছে। আর বিএনপি’র আজকের দুরবস্থার জন্য মূল দায় ও দায়িত্ব জিয়াউর রহমানের ছেলে তারেক জিয়া আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে বিদেশে একরকম পলাতক জীবন যাপন করছেন। মাঝে মধ্যে তার কিছু মিথ্যা বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তার সমর্থকরা প্রচার করলেও মূলধারার গণমাধ্যমে তিনি প্রায় নিষিদ্ধই হয়ে আছেন।

এমতাবস্থায় বেগম জিয়ার পক্ষে একা বিএনপি’র রাজনীতিকে টেনে নেওয়া কতোটুকু সম্ভবপর হচ্ছে তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা সম্ভব। তবে বিএনপি রাজনীতির সমর্থক বা শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকেই ব্যক্তিগত আলোচনায় একথা জোর দিয়েই বলেন যে, যদি বিএনপি’কে নতুন করে রাজনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থান নিয়ে ফিরে আসতে হয় তাহলে দলটিকে রাজনৈতিক কৌশল বদলাতে হবে। বিশেষ করে জনগণের সামনে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বা প্রোগ্রাম হাজির করতে হবে যাতে জনগণ উদ্বুদ্ধ হতে পারে।

সরকার বিএনপির রাজনীতিতে যতো বাধা দেবে দলটি ততোই জনপ্রিয় হবে কিন্তু সে জনপ্রিয়তা অর্জনে দলটিকে তার অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য অনুতপ্ত হওয়ার উদারতা দেখাতে হবে এবং ভবিষ্যত কর্মপন্থাও জনসম্মুখে হাজির করতে হবে। অনেকেই দলটির এ সুযোগ সৃষ্টির জন্য ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উপ-নির্বাচনকে মোক্ষম সুযোগ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এ নির্বাচনে যদি বিএনপি একজন সাদা ইমেজের প্রার্থীকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের শক্তি ও ক্ষমতা যাচাইয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা নিতো তাহলে বিএনপি এক ঢিলে বহু পাখি শিকার করতে সক্ষম হতো। সেটা কী রকম?

Tabid

যেমন প্রথমেই একজন প্রার্থী নির্বাচনে বিএনপি যদি দীর্ঘদিন বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং পোড় খাওয়া রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বেছে নিতো তাহলে সেটা হতো বিএনপি’র ভেতরকার রাজনীতির জন্য একটি অনন্য উদাহরণ, তাতে আগামী সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি’র প্রার্থী নির্বাচন কেমন হবে তার একটা ধারণা দলটির নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ পেতে পারতো। দ্বিতীয়তঃ একজন পরিষ্কার ইমেজের প্রার্থী নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি জনগণের সামনে এ মেসেজটাই প্রতিষ্ঠিত করতে পারতো যে, অতীতেই যাই-ইহোক না কেন, বিএনপি ভবিষ্যতে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার ঝুঁকি নেবে না, তারা সর্বোতভাবে গ্রহণযোগ্য প্রার্থীকেই আগামী নির্বাচনে প্রাধান্য দেবে।

কিন্তু বিএনপি যে সে পথে মোটেও হাঁটেনি তার প্রমাণ আমরা পেলাম তাবিথ আউয়ালকে ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচনে প্রার্থী করার মধ্য দিয়ে। আনিসুল হকের বিপরীতে যখন তাবিথ আউয়ালকে প্রার্থী করা হয় তখনও অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, আনিসুল হকের মতো একজন হেভিওয়েট প্রার্থীর বিপরীতে তাবিথ আউয়ালের মতো একজন নবীন বিএনপি ও বয়সে তরুণ প্রার্থী নিয়ে বিএনপি কি আসলে শেষাবধি নির্বাচনে বিজয়লাভ করতে পারবে?

সেটা যে পারবে না এমনটা বুঝেই নির্বাচনের দিন বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। কিন্তু তারপর অনেক ঘটনা ঘটেছে এদেশে এবং বিশ্বে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহুদেশের হাজার হাজার ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তির নাম এসেছে করস্বর্গে অর্থ লগ্নির। অনেক দেশেই পানামা এবং প্যারাডাইস পেপার্সে নাম থাকায় রাজনীতিবিদদের পদচ্যুত হতে হয়েছে, ক্ষমতাসীন সরকারকে পড়তে হয়েছে বিপাকে। পাকিস্তানের মতো দেশেও প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে এ কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে। ২০১৭ সাল বিশ্বময় আলোচনায় ছিল এ পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারির ঘটনা।

বাংলাদেশেও এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে কিন্তু তা নিয়ে সরকারের কোনো ব্যাবস্থা গ্রহণের খবর আমরা জানি না। মজার ব্যাপার হলো, বিষয়টা যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো প্রভাবই ফেলতে পারেনি তার প্রমাণ আমরা পাই ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে বিএনপি’র প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে। কারণ এখনও বিএনপি প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম পানামা ও প্যারাডাইস, দুই পেপার্সে প্রকাশিত তালিকাতেই জ্বলজ্বল করছে এবং এখনও দেশের গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবর পুরোনো হয়নি।

এসব উপেক্ষা করেই বিএনপি তাদের প্রার্থী হিসেবে তাবিথ আউয়ালকেই বেছে নিয়েছে। এতে আমাদের কাছে স্পষ্ট হচ্ছে যে, বিএনপি আসলে তাদের ২০০১-২০০৬ সালের শাসনামলের অবস্থান থেকে একচুলও সরেনি। এখনও দুর্নীতির বিষয়টিকে তারা কোনোভাবেই গুরুত্ব দিচ্ছে না।

বিএনপি সমর্থকদের কেউ কেউ বলতে চাইছেন যে, ক্ষমতায় গেলে এরকম একটু-আধটু দুর্নীতি হতেই পারে। সেটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান দুর্নীতি মামলা এবং তারেক জিয়াসহ বেগম জিয়ার আরেক ছেলে মৃত কোকো এবং তার ভাই-বেরাদরদের বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতির মামলা রয়েছে সেগুলো নিয়ে দলটি মোটেও চিন্তিত নয়।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বিএনপি-জামায়াত আমলে বাংলাদেশ পর পর পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়। সেই অবস্থান থেকে দেশকে সরিয়ে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসতে আওয়ামী লীগ সরকারকে নিঃসন্দেহে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, তবুও দেশ সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত হয়েছে বলার মতো কোনো সূচক এখনও আমাদের সামনে নেই। যদিও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলোই বলছে যে, বাংলাদেশে দুর্নীতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব হয়েছে।

এমতাবস্থায় বিএনপি যখন কর ফাঁকিতে এরকম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কাউকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে প্রার্থী করে তখন আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না যে, আগামী নির্বাচনেও দলটি আসলে প্রার্থী নির্ধারণে খুব বড় কোনো চমক আমাদের দেবে না। কিংবা একথাই দলটি প্রমাণ করতে চায় যে, দুর্নীতি বা তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণিত অভিযোগকেও তারা কোনো ভাবে পাত্তা দেয় না, এদেশে তাদের কথাই হয়তো আইন বা তারাই এদেশের আদর্শ। দেখা যাক নির্বাচনে জনগণ কীভাবে বিএনপি’র এ একগুয়েমির জবাব দেয়, নির্বাচন যখনই হোক না কেন।

অপরদিকে আওয়ামী লীগ এর আগে যখন আনিসুল হককে মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়েছিল তখনই আলোচনায় এসেছিল যে, এতো বড় একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল কি এমনকোনো প্রার্থী খুঁজে পেলো না যার কি-না দলীয় রাজনীতির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে, রয়েছে ত্যাগ ও জনপ্রিয়তার উদাহরণ? প্রয়াত আনিসুল হক কখনওই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন বলে প্রমাণ নেই। এবারও প্রার্থী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এমন এক ব্যক্তিকেই বেছে নিয়েছে যার কিনা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে যে দলটি বিরাজনীতিকরণ নিয়ে এতো কথা বলে, সেই দলটিই কেন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পয়েন্টে অ-রাজনৈতিক ব্যক্তিকে খুঁজে এনে প্রার্থী করে? নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ব্যর্থতা এখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, দলটি নির্বাচনে প্রার্থী করার মতো একজন সাদা ইমেজের রাজনৈতিক নেতৃত্ব খুঁজে পায় না ঢাকা শহরে। হয়তো এ ব্যর্থতা আগামী নির্বাচনেও দলটিকে বহন করতে হবে।

তবে একথা সত্য যে, আওয়ামী লীগ প্রার্থী নির্বাচনে চিহ্নিত কোনো দুর্নীতিবাজকে মনোনয়ন দেয়নি, কিংবা সামান্য কালিময় অতীত আছে তাকে প্রার্থী করেনি। সেক্ষেত্রে জনমতের মূল্য খানিকটা হলেও দলটি দিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণায় যে প্রতিটি ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে তার প্রার্থী সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। বিশেষ করে নির্ধারিত প্রার্থী যে আওয়ামী লীগেরই সেটা প্রমাণ করাটাই হবে মূল কাজ, দেখা যাক আওয়ামী লীগ দল হিসেবে সেটা কতোটা দক্ষতার সঙ্গে প্রমাণ করতে পারে। নির্বাচন নিশ্চয়ই হবে, আজ হোক আর কাল হোক, তাই না?

ঢাকা ১৭ জানুয়ারি, বুধবার ২০১৮

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/পিআর