হাসিনার শাসন মুজিবের ভাষণ
ভাষণে রেকর্ড সৃষ্টিকারী পিতার কন্যা গড়লেন শাসনের রেকর্ড। শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করার মহারাজ-মহানায়ক তিনি জাতির জনক বা বঙ্গবন্ধু হওয়ার আগে থেকেই। সেটা একাত্তরের ৭ই মার্চের ভাষণকে বাদ দিলেও। পাকিস্তান জমানায় তিনি যখন কারো কাছে শুধু মুজিব, কারো কাছে কেবলই শেখ সাহেব তখনও।
পাকিস্তানি খান শাসনামলেও বাঙালি শেখের ভাষণ নিয়ে ছন্দ মেলানো কথামালা ছিল। তাই বঙ্গবন্ধুর শুধু একাত্তরের উত্তাল ৭ই মার্চের ভাষণকেই যতো গুরুত্ব-কৃতিত্ব দিয়ে বাকিগুলোকে তামাদি করা কাঙ্খিত নয়। সেটাতে বরং দীনতা-অজ্ঞতার পরিচয় মেলে। ধরা যাক, তার সেদিনের ভাষণটি জাতিসংঘের ইউনেস্কোর মেমোরি রেজিস্ট্রারে স্থান পায়নি। তাতে কি বঙ্গবন্ধু বা তার ভাষণের শ্রেষ্ঠত্ব ‘নাই’ হয়ে যায়? এতোই ঠুনকো বঙ্গবন্ধু বা তার ভাষণ? ইউনেস্কো আমল বা স্বীকৃতি দেয়াতেই তার ভাষণের গুরুত্ব? নইলে কি বঙ্গবন্ধু অবিস্মরণীয় নন? তার ভাষণ মহামূল্যবান দলিল নয়? বহুমাত্রিকতায় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নয়? না। মোটেই না।
সহজ শব্দ, সরল বাচনভঙ্গি, ব্যতিক্রমী উচ্চারণ, প্রাসঙ্গিক বাক্য দিয়ে বক্তৃতা এখনো দেশে কম হয় না। সেগুলো মানুষকে ছোঁয় না কেন? স্কুলজীবন থেকেই শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ অনবদ্য কাব্যের মতো। তার অলিখিত একেকটি ভাষণ ও এর বর্ণনার লিখিত বিবরণ দেয়া কঠিন কাজ সুলেখকের পক্ষেও। এই রেসকোর্স মাঠ বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭ই মার্চের আগে-পরে দেয়া তার ভাষণের প্রতিটিই ঐতিহাসিক। ভাষণে জাতিকে অভয়মন্ত্রে উজ্জীবিত করার এ শক্তি ঐশ্বরিক দানও। নইলে ভাষা, উচ্চারণ, আবৃত্তি চর্চায় তার চেয়ে ভালো বক্তা গজাচ্ছেন না কেন?
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্তের মুদ্রিত কবিতা আবৃত্তি করেও তো সেই চেষ্টা করা যায়। তাতে কি নিষেধাজ্ঞা আছে? বা বারণ করে রেখেছে কেউ? জাতিকে যুথবদ্ধ, সাহসী করার পাশাপাশি বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম-মুক্তিযুদ্ধ সংঘটনে বঙ্গবন্ধুর কোন ভাষণটির বিশেষত্ব নেই? ব্যাকরণে-উচ্চারণে ভুল হলেও বক্তব্যের তথ্য, গতি, শক্তিতে তার কণ্ঠে উচ্চারিত অনেক শব্দ শুদ্ধতায় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
এরপরও ৭ই মার্চের ভাষণের ঐতিহাসিক মূল্য আলাদা। এর স্থান ইতিহাসের বিশেষ জায়গায়। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে যতো প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কলাম রয়েছে অন্যগুলো নিয়ে তেমন নেই। আর ইউনেস্কোর স্বীকৃতির পর অবস্থা যেদিকে মোড় নিচ্ছে তাতে বঙ্গবন্ধুর জীবনে আর কোনো ভাষণ রয়েছে কি-না, সেটা প্রশ্নের মধ্যে পড়ে যাওয়ার একটা আলামত খেয়াল করার মতো।
এ ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই বেখেয়াল হবেন না শাসনের অনন্য রেকর্ডধারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি একটানা ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড এখন কেবল তারই। আগামী বছর তিনি স্পর্শ করবেন টানা এক দশক ক্ষমতার মাইলফলক। এতোদিন শাসন স্থায়িত্বের এ রেকর্ডধারী ছিলেন শুধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ৯ বছর নামে প্রচারিত হলেও তিনি ক্ষমতায় ছিলেন আট বছর সাত মাস ১৫ দিন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, রাষ্ট্রপ্রধান, রাষ্ট্রপতি নামে টেনেটুনে, ভাগেযোগে, যায় যায় দশায় এ ক্ষমতা ভোগ করেন এরশাদ।
১২ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে নন-স্টপ ক্ষমতার এ রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। টানা নয় বছর দেশ শাসন করে অনন্য রেকর্ড গড়েছেন তিনি। বাকিদের হয় এক মেয়াদ শেষ করে ভোটে ক্ষমতা হারাতে হয়েছে। নইলে আন্দোলনের মুখে। আবার শেষ নিশ্বাসে অর্থাৎ ক্ষমতাচ্যুতির উদাহরণও রয়েছে।
এই আমলের আগে ক্ষমতা না ছেড়েও তিনি আরেকবার ক্ষমতায় ছিলেন। রেকর্ড হিসেবে সেটাও নতুন। শেখ হাসিনাসহ তার সরকার ও দলের আশা, ক্ষমতায় থেকে স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনের। সেই এজেন্ডাতেই ‘সরকারের ধারাবাহিকতা ধাকলে উন্নয়ন বেশি হয়’ তত্ত্বটি বেশ প্রচার হচ্ছে। পঁচাত্তর ট্য্যাজেডিতে ক্ষমতাচ্যুতির ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ প্রথম ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। সেটাই শেখ হাসিনার প্রথম মসনদারোহন।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তাঁর বেঁচে যাওয়া রক্তের উত্তরসূরি শেখ হাসিনার ওই ক্ষমতারোহনও একটি বিস্ময়ভরা রেকর্ড। এক মেয়াদ অপজিশনে থাকার পর আবার ক্ষমতায় আসেন ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচনে। সেই বিশাল জয়ের পর ক্ষমতার স্টাইল বদলের রেকর্ড। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি মসনদে থেকেই বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা রিমেক। টানা দুবার ক্ষমতা কব্জায় রাখার নজির। বিশ্বের দীর্ঘতম নারী শাসকের খেতাবও এখন শেখ হাসিনার ঝুলিতে।
দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশকে তিনি অনেক কিছুর সাক্ষী বানিয়েছেন কল্পনাতীতভাবে। টানা নয় বছরের শাসনে প্রশংসার সঙ্গে সমালোচনার রসায়ন তিনি ঘটিয়ে চলছেন ভিশনারী- কর্মঠভাবে। ডেমকেয়ারে। পেছনে না তাকিয়ে সামনে এগুতে অসীম সাহসী হয়ে। চ্যালেঞ্জ এনজয় তার বৈশিষ্ট্যের মতো।
বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, ফ্লাইওভার নির্মাণসহ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে কে কি বললো? সমালোচনা বা দুর্নীতির অভিযোগে কোনো কাজ থমকে দেননি। গুম, খুন, চাঁদাবাজিসহ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সমালোচনার মধ্যেও প্রচার চলেছে গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নতি জরুরি। সীমিত গণতন্ত্রে বেশি উন্নতির তত্ত্বও বাজার কম পায়নি। তার শাসনকে অনেকের এ কারণেই হয় তো মিরাকল বলতে পছন্দ।
আলামত বলছে ভবিষ্যতেও ক্ষমতার রেকর্ডের আশপাশে আরো নানান রেকর্ড তৈরি হবে তার হাতে। অনেকের মতে, এতো রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে শেখ হাসিনার বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার কারণেই। পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির দুনিয়া কাঁপানো অভিযোগ তিনি সামাল দিয়েছেন ঝড়ের মতো। পরে নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে বাস্তব করতে চলেছেন। হলি আর্টিজানের ঘটনাসহ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সক্ষমতার জানান দিয়েছেন। এ রেকর্ড গড়েছেন আন্দোলন, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের মতো ভয়াবহ সহিংসতা কঠোর হাতে দমন করে।
এর আগে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র দেড় মাসের মাথায় ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাও সামলিয়েছেন সাহসের সঙ্গে বুদ্ধিতে। ওই ঘটনায় প্রাণ হারান ৫৯ জন সেনা অফিসারসহ ৭১ জন সামরিক-বেসামরিক মানুষ। এতে সেনাবাহিনীতে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। শেখ হাসিনার ক্ষমতা যায় যায় বলে রব তোলার চেষ্টাও সফলভাবে মোকাবিলা করেছেন তিনি। যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং প্রতাপশালী আসামীদের ফাঁসিতে ঝুলানোও কাঠিন্যের রেকর্ড।
সন্ত্রাস-দুর্নীতি, লুটপাটসহ নানা সমালোচনা, জটিলতা, অভিযোগের বিপরীতে সাফল্যের হৃষ্টপুষ্ট ঝুড়িতে শেখ হাসিনা এই মূহূর্তে বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর সরকার প্রধান। ক্ষমতার ক্ষণ গণনায় তিনি পেছনে ফেলেছেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলকেও। টানা দুই মেয়াদে নয় বছরসহ মোট ১৩ বছর প্রধানমন্ত্রী থেকেছেন মার্কেল। আর টানা দুই মেয়াদে ৯ বছরসহ ৯৬-২০০১এর ৫ বছর মিলিয়ে শেখ হাসিনার চলছে ১৪ বছর। এটাই সত্য। বাস্তব। তিনিই পারেন, তিনিই পারবেন- এমন একটি ধারণাও বিশ্বাসও জন্ম দিতে পেরেছেন শেখ হাসিনা। নিঃসন্দেহে এটাও তার আরেক রেকর্ড।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/পিআর