শিল্পের প্রত্যহে সেলিম আল দীন
ছাত্র হিসেবে শিক্ষক সেলিম আল দীনের সান্নিধ্য লাভ করি ১৯৮৮ সালের ১২ নভেম্বর থেকে। তিনি কেবল ক্লাসের রুমের শিক্ষক ছিলেন তা নয়। ক্লাস শেষে সন্ধ্যায় তাঁর সাথে হাঁটতে হবে। সব সময় পারিনি। মাঝেমধ্যে পালিয়েও থেকেছি। আবার তাঁর সাথে হাঁটিনি কিংবা কখনো কখনো হাঁটতে বাধ্য হইনি এমন দিনের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। সন্ধ্যার সে হাঁটাকে রসিকতা করে তিনি ‘হণ্টন শিল্প’ বলতেন। তাঁর সেই হণ্টন শিল্পের অনুসারীও কম ছিল না। হণ্টন একটি শিল্পই বটে! এখন বুঝি হাঁটার উপকারিতা- শিল্পগুণও।
হাঁটতে হাঁটতে সেলিম আল দীন জাহাঙ্গীরনগরের প্রকৃতি থেকে গ্রহণ করেছেন শিল্পের নিষিক্ত রস। অতঃপর সেই রসই তাঁর নাটকের বিষয়বস্তুর গভীর থেকে গভীরে প্রোথিত ও প্রতিষ্ঠা করেছে শিল্পের প্রাণ। কেবল ক্লাস রুমেই নয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা প্রান্তে তাঁর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হোমার, সফোক্লেস, ভার্জিল, কালিদাস, শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়কে কিছুটা ভিন্ন পরিচয়ে চেনার অবকাশ পেয়েছিলাম।
বলার অপেক্ষা রাখে না সেই অবকাশটুকুই আজ মনে হয় জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ক্লাস রুমের বদ্ধ দরোজায় যে ব্যাখ্যাগুলো হয়তো কোন দিনই আলোচনায় ঠাঁই পেত না বস্তু ও বিশ্বজগতের সেই অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ের আলোচনাগুলো শিক্ষক সেলিম আল দীনের অনুপস্থিতিতে আজ অনেক বিরাট আকারে মনের মধ্যে, উপলব্ধির মধ্যে ভেসে ওঠে- সবকিছু ছাপিয়ে ভেসে ওঠে। সেই সব হাঁটাগুলোয় স্যারের সঙ্গী হতে পেরেছি বলে জেনেছি পাখিরা মরে যাওয়ার আগে লোকচক্ষুর আড়ালে অনেক দূরে কোথাও চলে যায়।
জেনেছি অঘ্রাণে পাখিদের পা সবচেয়ে সুন্দর দেখায়। পৃথিবীর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসেই এসব বিষয়ের ঠাঁই হবে না, কিন্তু সেলিম আল দীন স্যারের সমগ্র সিলেবাস ঠাসা ছিল ভোরের কুয়াশা লেকের পানিতে ফুটে থাকা শাপলাগুলোর ওপর কী নিবিড় মমতা নিয়ে ঝরে পড়ে, মাকড়শার জালে আটকে থাকা কুয়াশার বিন্দুগুলোর ওপর সূর্যালোক আছড়ে পড়লে কী অদ্ভূত অবয়ব ফুটে উঠে, মহুয়া ফুলের মিহি গন্ধ কেমন মাতিয়ে রাখে আরণ্যক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকে! হাঁটতে হাঁটতে সেলিম আল দীন স্যার আমাদেরকে চেনাতেন আকাশের তারা। কী নিশ্চুপ ভঙ্গিতে তারারাও আমাদের সাথে সাথে হাঁটতো! এসব গভীর অনুভূতির বিষয়- আমাদের স্থূল চেতনার জগতে তখন এসব সূক্ষ্ণ বিষয় রেখাপাত করতেও যেন অক্ষম! অথচ এসব অনুভূতিই শব্দ হয়ে উঠতো, বাক্য ও পরিপূর্ণ সংলাপ হয়ে উঠে চরিত্রের মুখে বসে যেত নিবিড়ভাবে- যথার্থ মমতা নিয়ে চরিত্রকে করে তুলতো পরিপূর্ণ এক মানুষরূপে, মানবের আকাক্সক্ষা হয়ে ফুটে উঠতো সেসব বাক্য ও সংলাপ। এসব বাক্য ও সংলাপে সেলিম আল দীন এই জনপদকে মূর্ত করে তুলেছেন- মূর্ত করে তুলেছেন এই জনপদের বিচিত্র জনগোষ্ঠীর জীবনসংগ্রামকে।
সেলিম আল দীন (১৮ আগস্ট ১৯৪৮-১৪ জনিুয়ারি ২০০৮) আমাদের মাঝে শিল্প ও জীবনানুষঙ্গে শারীরিকভাবে বেঁচে ছিলেন মাত্র ছয় দশক। এর মধ্যে নাট্যকার হিসেবে তিন যুগের অধিক নয় কোনো মতে। কিন্তু শিল্পী হিসেবে তিনি অনন্তকাল বাঁচবেন। শিল্পের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই আমরা দেখি সংশ্লিষ্ট শিল্পীদের স্থিতধি ও যথার্থ একটি সমুন্নতির লক্ষ্যে পৌঁছাতে অনেক বিভ্রান্ত সময় পার হতে হয়। সেলিম আল দীনও সেই বিভ্রান্ত সময় পার করেছিলেন নাট্যরচনা কৌশলের ছাঁচ-বদলের নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে।
শুধু নাটক রচনার শৈলীর ক্ষেত্রেই নয়- বাংলা নাটকের জন্ম-পরিচয়ের ইতিহাসের বিভ্রান্তি অপনোদনের ক্ষেত্রেও সেলিম আল দীনের সংগ্রামশীল ভূমিকা আমাদেরকে নিজস্ব শিল্প-ভূগোলে স্থিত করেছে। ফলে, নাট্যশিল্পের জগতে কথিত বিভ্রান্তির কুহক তাকে প্রতারিত করতে পারেনি। তার আগেই তিনি স্থিতধি শিল্পের সন্ধান পেয়েছিলেন। অথবা এমন তো উল্লেখ করা যেতেই পারে, কিত্তনখোলা সময়পর্ব থেকে তিনি যে শিল্পভুবনের সিংহদ্ধারের সন্ধান লাভে সক্ষম হয়েছিলেন সেই পথই তাঁকে কাঙ্খিত স্বর্ণমন্দিরে পৌঁছে দিয়েছিল।
আর সেই স্বর্ণ মন্দিরের কিংবা সেই যক্ষপুরীর তাল তাল স্বর্ণদানা সংগ্রহের মাধ্যমে সেলিম আল দীন তাঁর নাটকগুলোকে করে তুলেছিলেন অপূর্ব বিভাময়ী ও নন্দনসম্পদে ঐশ্বর্যশালিনীরূপে। এ জন্যই আমরা তাঁর সৃষ্টিজগতের বিস্ময়ের সঙ্গে বাঙালির চিরকালীন শিল্পচিন্তার সম্মিলন লক্ষ করি। এই সম্মিলন ঘটানোর প্রক্রিয়ায় তিনি হয়ে ওঠেন এক ধরনের প্রত্ম-পরিব্রাজকও। নিরন্তর প্রত্ম-অভিযানে বাংলার অতীত পটভূমি আর তার বিস্তৃত চিন্তা ক্ষেত্র থেকে সেলিম আল দীন আবিষ্কার করে আমাদের সামনে হাজির করেন আমাদেরই পূর্বপুরুষের জীবনসংগ্রাম ও গোষ্ঠীবদ্ধ যৌথ জীবন-অভিব্যক্তির চিরায়ত ও লোকায়ত ভঙ্গিমার বহুধাবর্ণিল উপাখ্যান।
তাঁর নাটক দর্শন বা পাঠে এসত্য সহজেই উপলব্ধি করা যায়। এক এক নাটকে তাঁর এক এক রকমের প্রত্ন-অভিযান আমরা অনায়াসে লক্ষ করে থাকি। সাদা চোখেই আমরা দেখি তাঁর প্রায় প্রতিটি নাটক কোনো না কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়-বিশেষ তাদের স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জীবনসংগ্রাম, জীবনদর্শন কিংবা জীবনাচারের নৃ-বিশ্বাসগত অভিব্যক্তির প্রকাশক্ষম ঋজুতায় আবির্ভূত। মনে রাখা ভালো, সম্প্রদায় বা কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠী তাঁর নাট্যশরীরের আধার ও আধেয় হলেও জীবনবোধের গভীরতায় সেলিম আল দীনের নাট্যচরিত্ররা আধুনিক জীবনের অভিজ্ঞতায়ও কম জর্জরিত নয়।
সেলিম আল দীনের নাটকে বিধৃত যে কোনো জনগোষ্ঠীর মানুষের অভিব্যক্তি থেকেও স্বদেশ, সমাজ, রাষ্ট্র, মানবিকবোধ প্রভৃতি সর্ম্পকে আমরা আমাদের নাগরিক দৃষ্টি ভঙ্গিজাত আধুনিকতার অভিজ্ঞতাকেও জর্জরিত করে নিতে পারি। নিমজ্জন, স্বর্ণবোয়াল, ঊষাউৎসব, ধাবমান, পুত্র, স্বপ্ন রমণীগণ প্রভৃতি নাটকে বর্ণিত অভিঘাতের ব্যঞ্জনা তীব্রতার সঙ্গে অনুভূত হয়। ফলে, সভ্যতার আয়নার বিপরীতে নিজেদের দাঁড় করিয়ে আমরা মানুষ হিসেবে পুর্নমূল্যায়নটুকুও এক নজরেই করে নিতে পারি। পাশাপাশি, মানব ভ্রূণের অকাল অপচয়, মানবমৃত্যু, বিশ্বভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতির বিপরীতে মানুষ যে কি পরিমাণ অসহায় একাধিক নাটকের বিচিত্র অনুষঙ্গে সে অভিব্যক্তির প্রকাশেও সেলিম আল দীন সর্বদা ছিলেন উচ্চকণ্ঠ।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর বিশ্বপরিস্থিতিতে পাশ্চাত্যের শিল্পসাহিত্যে নানা মতবাদপুষ্ট ও ক্ষণস্থায়ী শিল্প আন্দোলনের বিপরীতে ঔপনিবেশিক মানসিকতা-মুক্ত বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের সৃজনক্ষম শিল্পীদের চেতনায় নাগরিকবোধ ও বিশ্বাসে ‘স্বদেশ’, ‘স্বভূমি’ আর এই স্বভূমিজ বাস্তবতার অন্বেষা ব্যাপকতর জায়গা অর্জন করে নেয়। সেই চেতনার স্বরূপ আমরা ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্তিলাভের মাত্র চার বছরের মধ্যে আবিষ্কারে সক্ষম হই। শিল্পচিন্তায় সেলিম আল দীন বি-ঔপনিবেশবাদীতায় গভীর আস্থাশীল।
হাজার বছরের বাঙালির আত্মপ্রকাশ ভঙ্গির ধারাবাহিকতা পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানজাত উপলব্ধি বোধের আদলে তিনি তাঁর তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ছিলেন। আর এই তত্ত্বের ভিত্তি হলো উপনিবেশ বিরোধী ও মননশীললতায় দেশজ শিল্পাদর্শ অভিমুখী। তাই তিনি বলেন : ‘সাম্প্রতিককালে বাংলা সাহিত্যের একটা ধারায় ঔপনিবেশকালের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে তাত্ত্বিক লড়াইটা চলছে সেটা খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠতো যদি না আমাদের মধ্যে ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতা অভ্রান্ত আসন করে নিতো। আমরাও যে শিল্পের ভেতর গড়ন-গঠন নিয়ে আমাদের মতো করে ভাববো- সে পথটুকুও যেন আমরা নিজেরাই আগলে রেখেছি।’
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনসহ পরবর্তীকালের সকল আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে শিল্পের নানা শাখায় স্বদেশ, স্বভূমি আর এই স্ব-ভূমিজ গভীর চেতনার বিস্তার ঘটতে থাকে। ভাষা আন্দোলন আমাদের উলিখিত চেতনাবোধকে আরো শাণিত করে তোলে। স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বজাতীয় সংস্কার-সংস্কৃতির প্রতি এই চেতনাবোধই উলিখিত প্রত্যয়সমূহের প্রতি অর্থাৎ পূর্বোক্ত স্বদেশ ও স্বভূমির প্রতি আরো গভীরভাবে শিল্পদৃষ্টি ও মানবিক মনন ফেরানোর তাগিদে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি অপশাসনের নয়া ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত অল্পসংখ্যক বাঙালির মতো সেলিম আল দীনও মঞ্চের মাধ্যমে খুঁজলেন সহস্রবর্ষের চিরায়ত বাংলাকে- মাতৃভূমির স্বরূপ অন্বেষণে খুঁজলেন চিরায়িত বাংলার ভূমি এবং ভূমিজ বাস্তবতার প্রকৃত অবয়ব।
আবার এই ভূমিজ বাস্তবতার সঙ্গে বিশ্ববোধের এক অদ্বৈত সর্ম্পকও সৃজন করলেন সেলিম আল দীন তাঁর স্বতন্ত্র ভাষাভঙ্গি, বাক্য ও শব্দন্যাসের ঋজু কুশলতায়। কিন্তু সমকালে এদেশের চলমান নাট্যিক প্রবণতা ছিলো তাঁর চেতনায় লালিত শিল্পবোধের একেবারেই বিপরীতমুখী। তাই সেলিম আল দীন ক্ষোভের সঙ্গে একদা বলেছিলেন : ‘দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমকালীন থিয়েটারের একটা বড় অংশ শিল্পের নিত্যকে আপন ইতিহাসের সহজ পরিক্রমণের ধারায় গ্রহণ করেনি। শিল্প রচনার নিগুঢ় তাগিদের চেয়ে চলমান আহ্বানের দিকে তার উৎকর্ণ যাত্রা, প্রথার ছাঁচে এক প্রশ্নহীন আত্মসমর্পণে আশ্চর্যজনক তৃপ্তি। ফলে, শিকড়ের চেয়ে শাখার দিকে আমাদের মনোযোগ বেশি।’
আজো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকের পানিতে লাল শাপলার ওপর গভীর নিবিড়ভাবে ঝরে পড়ে ভোরের কুয়াশা। লেকের পানিতে ভেসে বেড়ায়- দল বেঁধে আকাশে উড়ে অতিথি পাখির ঝাঁক, মহুয়া ফুলের মিহি গন্ধে আজো মেতে ওঠে আরণ্যক এই ক্যাম্পাস। আর না- ফেরার দেশে সেলিম আল দীন আজ দশ বছর। হোমার, শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথের মতো সেলিম আল দীনও ওঠে আসেন অতীতের গহ্বর থেকে। আমাদের সমকালে আমরা আলোচনা করে বেড়াই সেলিম আল দীনের সোনাই, রবিদাশ, ডালিমন, বনশ্রীবালা, কেরামত, নোলক, সয়ফরচান, আবছার মতো আরো কতো বিচিত্র চরিত্র নিয়ে। এসব চরিত্রের মধ্য দিয়ে মহাপ্রয়াণের দরোজার ওপার থেকে সেলিম আল দীনই বারবার চলে আসেন এই স্বদেশ ও স্বভূমিতে। শিল্পের প্রত্যহে এভাবেই সেলিম আল দীনের সঙ্গী হয়ে উঠি আমরা।
১৪ জানুয়ারি ২০১৮ বাঙালির মহান এই নাট্যকারের ১০ম প্রয়াণ দিবসের প্রাক্কালে একথার পুনরোল্লেখ তো করতেই পারি যে, বাঙালির চিরকালীন শিল্পচিন্তার শেকড়ের প্রতি গভীর মমত্ববোধ নিয়েই নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন তাঁর শিল্পী-জীবন যাপন করেছিলেন। আর সমগ্র জীবনের শিল্প সাধনায় তিনি ঔপনিবেশিক শিল্পচিন্তার বিপরীতে এই স্বদেশ ও স্বভূমিজ শিল্পচিন্তাকে প্রতিষ্ঠিত করায় ব্যাপৃত ছিলেন। ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের মহাপ্রয়াণ ঘটে। তাঁর প্রয়াণ দিবসে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের অসংখ্য সৃষ্টি ও দর্শনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করি।
লেখক : অধ্যাপক, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাবি।
এইচআর/এমএস