শীতের গল্প
রংপুর। কুয়াশা নামছে। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই তীব্র শীত ঘনিয়ে আসছে। আসিরন বেওয়ার ভাঙা ঘরে তীব্র দাপটে খেলা করছে উত্তুরে হাওয়া। ছেঁড়া কাঁথা গায়ে জড়িয়ে শীতে কাঁপছেন বৃদ্ধা। এমনি এক তীব্র শীতেই মৃত্যু হয়েছিল তার হতদরিদ্র স্বামীর। শীতে গায়ে দেওয়ার মতো লেপ কম্বল কিছুই জোটাতে পারেনি মৃত্যুপথযাত্রী সেই লোকটি। আসিরন ভাবছেন তাকেও কি এই শীতেই দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে যেতে হবে?
এই দৃশ্য শুধু রংপুরের নয়। শৈত্য প্রবাহে রাজশাহী, দিনাজপুরসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ কাঁপছে। বলতে গেলে পুরো বাংলাদেশেই দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠি শীতে কাতর। এর বিপরীত চিত্রের দিকে একটু তাকানো যাক। গুলশানের একটি নামী কফিশপে ধূমায়িত কফির কাপ হাতে নিয়ে আসিরন বেওয়ার নাতনির বয়সী এক তরুণী তার বন্ধুকে বলছেন, ‘আই এনজয় উইন্টার।’
থার্টিফার্স্ট নাইটে ঢাকার আকাশ আলো হয়ে গিয়েছিল আতশ বাজিতে। যে পরিমাণ অর্থ এই রঙের খেলায় ব্যয় হয়েছে তা দিয়ে ঢাকা শহরের সব ছিন্নমূল মানুষের শীতবস্ত্রের ব্যবস্থা করা যেত। ‘কারও পৌষমাস কারও সর্বনাশ’। এবছর সেই প্রচলিত প্রবাদটি অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। পৌষমাসেই তীব্র শীত জাঁকিয়ে বসেছে দেশে। মধ্য ও উচ্চবিত্তের মানুষ অবশ্য শীত উপভোগই করেন। আলমারিতে তুলে রাখা বিদেশ থেকে আনা ওভারকোট আর গরম কাপড়চোপর পরার এই তো সময়।
দেশের শপিংমলগুলোতে বাহারী শীত-পোশাকের ছড়াছড়ি। ফুটপাতেও রয়েছে অঢেল গরম কাপড়। গার্মেন্টস শিল্পের কল্যাণে দেশে অতি স্বল্পমূল্যেই শীতপোশাক পাওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা হলো ওই সামান্য মূল্যটুকুও অসামান্য হয়ে ওঠে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির কাছে। আমাদের দেশে শীত মূলত উৎসবেরই ঋতু। পৌষ-পার্বণ, পিঠা উৎসব, বিভিন্ন রকম মেলা, যাত্রার আসর এসব শীতেই জমে ওঠে। আর শীত মানেই তো বিয়ের মৌসুম।
ঢাকায় কমিউনিটি সেন্টার, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ক্লাব, ফেস্টিভ্যাল লাউঞ্জ, কনভেনশন সেন্টার সব জায়গাতেই বিয়ের বাদ্য বাজছে। লাখ টাকা দামের শাড়ি, লেহেঙ্গার চোখ ধাঁধানো জৌলুস। নামী দামী বিউটি পার্লার থেকে ব্রাইডাল মেকআপ নিতেও খরচ হচ্ছে লাখ টাকা। লাখের নিচে কোন কথাই নেই।
আর খাবার দাবারের ঘটাও কম নয়। আজকাল আর সাধারণ পোলাও বিরিয়ানিতে নিমন্ত্রণকারী ও নিমন্ত্রিত কারুরই মন ভরে না। এক্সেপশনাল আইটেম না হলে ভালো লাগে না। রোস্ট, গ্রিল, ফ্রাই, কাবাব সব রকমের খানা খাদ্য চাই। এনগেজমেন্ট থেকেই শুরু হয় উৎসব। ছোটবেলায় দেখেছি পানচিনি, গায়ে হলুদে মিষ্টি আর পরোটা-মাংসই ছিল খাদ্য। গায়ে হলুদ হতোও বিকেলে। এখন তো বিয়ের প্রতিটি অনুষ্ঠানেই পোলাও বিরিয়ানি আর স্টেজ সাজানোর সমারোহ চলে। একেকটি বিয়ের (হলুদসহ) ইন্টিরিয়রে যে খরচ হয় তাতে দরিদ্র পরিবারগুলোর সারাজীবনের খাওয়াপরা চলে যাবে।
আমাদের লাইফস্টাইলের চটক বাড়ছে। হানিমুনে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক যাচ্ছেন মধ্যবিত্ত পরিবারের নববিবাহিতরাও। আর উচ্চবিত্তরা তো ইউরোপে হানিমুন করতে হরহামেশাই যান। আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে পা রেখেছি। কিন্তু সম্পদের সুষম বন্টন হচ্ছে কি? যে দেশে এখন বিয়ে-শাদিতে কোটি টাকা খরচ কোন খবরই নয়, যে দেশে লাখটাকার ব্রাইডাল প্যাকেজ একটি চালু বিষয়, যে দেশে কয়েক কোটি টাকার গাড়িও হরহামেশাই চোখে পড়ছে সেখানে এখনও কেন অনাহারে, শীতে কেঁপে মানুষের মৃত্যু হয়?
বাজারে যখন মটরশুঁটির কেজি দুশো টাকা এবং সেই সবজিও কেনার লোকের অভাব নেই সেখানে এখনও কেন খোলা আকাশের নিচে ঘুমায় ছিন্নমূল মানুষ? শীতের সবজির দাম এক সপ্তাহ আগেও ছিল আকাশ ছোঁয়া। কিন্তু সেই সবজির দাম কি পৌঁছেছে কৃষকের হাতে? সম্পদের সুষম বন্টনের অভাবেই আমাদের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মানুষ উন্নয়নের সুফল ভোগ করতে পারছে না।
শীত এলেই ‘কম্বল বিতরণ’ এর স্টান্টবাজি দেখা যায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংস্থার ব্যানারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ‘বিতরণ’ টিভি ক্যামেরা যতক্ষণ থাকে ততোক্ষণই চলে। অনেকক্ষেত্রে দেখা গেছে নিজস্ব ক্যামেরায় ছবি ও ভিডিও ধারণ করে ফুটেজ ও প্রেসরিলিজ বিভিন্ন মিডিয়ায় পাঠানো হয়। কম্বল বিতরণ এখানে মূল উদ্দেশ্য নয়, মূল উদ্দেশ্য হলো নিজেদের প্রচার বাড়ানো।
বনভোজনের নামেও শীতে চলে কিছু চাঁদাবাজি, চলে অপচয়ের ধুম। অথচ যদি এসব আনন্দ ফুর্তি একটু কমিয়ে সে টাকাটা দরিদ্র মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নে ব্যয় করা যেত তাহলে এতদিনে অভাব এই দেশ থেকে বিদায় নিত। সব দান ও উন্নয়নকাজের জন্য সরকারের দিকেই হা করে তাকিয়ে তাকতে হবে কেন? ব্যক্তিগত বিলাসিতা কিছুটা কমিয়ে কি দানের খাতাটা খোলা যায় না?
আমি মানুষের উৎসব, উদযাপন, আনন্দ, ফুর্তির বিরোধী নই। এসবই জীবনের অংশ। কিন্তু এসবের নামে অতিরিক্ত অর্থ অপচয়, বিলাসিতার প্রতিযোগিতা, আড়ম্বরের বাড়াবাড়ি, ভণ্ডামি এসব আমার ভালো লাগে না। ভালো লাগতো যদি আমাদের দেশে এখনও দারিদ্রসীমার নিচে মানুষের অস্তিত্ব না থাকতো।
এখনও প্রান্তিক অবস্থানে অসহায় মানুষরা আছে। তাই কোন অনুষ্ঠানে যখন অর্থের, বিলাসিতার, জাঁকজমকের বাহুল্য দেখি তখন অবধারিতভাবে চোখে ভেসে ওঠে শীতার্ত আকাশের নিচে শুয়ে থাকা ছিন্নমূল শিশু ও বৃদ্ধের মুখ, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অভুক্ত মানুষের চেহারা। তখন আর উৎসব অনুষ্ঠানে বিলাসিতার প্রতিযোগিতা সহ্য হয় না, একেবারে সহ্য হয় না।
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম