ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আশা রাখি ২০১৮ ভালো যাবে

শান্তা মারিয়া | প্রকাশিত: ০৪:২৪ এএম, ০২ জানুয়ারি ২০১৮

নারীর জন্য সহিংসতায় পূর্ণ ছিল ২০১৭। কয়েকটি বীভৎসতম নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়েছে এ বছর। ফিরে দেখতে গেলে রীতিমতো শিউড়েই উঠতে হয়। এ বছর বনানীতে রেইনট্রি হোটেলে ঘটেছে এমন এক ঘটনা যার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ ও তার বন্ধু নাঈম আশরাফ দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে জন্মদিন অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যায় এবং ধর্ষণ ও নির্যাতন করে।

ঘটনাটি জনমনে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। ধর্ষণ এদেশে নতুন কোন বিষয় নয়। কিন্তু এই দুই দুর্বৃত্ত ধনী যা করেছে সেটা হলো তারা আইনকে টাকার জোরে কিনে নিয়ে সেটা নিয়ে আবার আস্ফালনও করেছে। তারা ভিকটিমদের প্রকাশ্যেই বলেছে তারা ধর্ষণ করেছে এবং চাইলে খুনও করে ফেলতে পারে। খুন বা ধর্ষণ করলেও তাদের নাকি আইন স্পর্শই করতে পারবে না। তারা সমাজের রীতিনীতির ও আইন-কানুনের কোন তোয়াক্কাই করে না। দুর্বৃত্ত ধনীদের এই আস্ফালনই জনমনে ক্ষোভের ও প্রতিবাদের জন্ম দেয়।

২০১৭ সালের এপ্রিলে ঘটে আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা। গাজীপুরের শ্রীপুরে দরিদ্র দিনমজুর পিতা হযরত আলি তার আট বছরের শিশু কন্যা আয়শাকে নিয়ে চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। আয়শাকে উত্ত্যক্ত করতো বখাটেরা। অনেকবার প্রতিবাদ জানিয়েও কোন লাভ হয়নি। এক পর্যায়ে নির্যাতনের শিকার হয় আয়শা। হযরত আলির গরুকেও ধরে নিয়ে যায় প্রভাবশালী বখাটেরা। অন্যায়ের প্রতিকার নেই, নেই কোন বিচার। পালিত কন্যা আয়শাকে নিয়ে তাই এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন হযরত আলি। বাবা-মেয়ের এই আত্মহত্যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই সমাজে ভালো মানুষরা কতটা অসহায়।

জুলাই মাসে বগুড়ায় এসএসসি পাশ এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি তুফান সরকার। শুধু তাই নয়, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভিকটিম এবং তার মাকে নির্যাতন ও তাদের মাথা ন্যাড়া করে দেয় তুফান সরকারের আত্মীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর। মা মেয়েকে নির্যাতন ও তাদের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার এই ঘটনাটিও তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। কারণ এখানেও ভিকটিম ছিল দরিদ্র ও অসহায়। প্রভাবশালীর ক্ষমতার দাপটে বোঝা যায় ‘এ যুগে চোরই গৃহস্থের হাত চেপে ধরে’।

জুলাই মাসে ঘটে আরেকটি ন্যক্কারজনক ঘটনা। টিভি চ্যানেল নিউজ ২৪ এর শব্দ প্রকৌশলী আরমান হোসেন সুমনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনেন তার সৎকন্যা। জানা যায়, আরমান হোসেন বিগত কয়েক বছর ধরে তার সৎকন্যাকে ধর্ষণ, নির্যাতন ও ব্লাকমেইল করে আসছিল। এই নরপশু ঘটনা স্বীকারও করে। এই ঘটনা প্রকাশের পরপরই আরো কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যেখানে সৎবাবা তার কন্যাকে ধর্ষণ করে। বাবা-মা শিশুকে নিরাপত্তা দেয়। সেখানে যদি বাবার কাছেই মেয়ে নিরাপদ না বোধ করে তাহলে কোথায় যাবে সে।

৩০ জুলাই বাড্ডায় তানহা নামে চার বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণের পর গলা টিপে হত্যা করে প্রতিবেশি শিপন। এই মর্মান্তিক ঘটনা জনমনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং শিশুদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি নতুনভাবে সামনে নিয়ে আসে। সে সময় ব্র্যাকসহ বেশ কয়েকটি সংস্থার জরিপে উঠে আসে ভয়াবহ তথ্য। দেখা যায় আট মাসের শিশু ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটছে। যে সমাজে শিশুরা এমন ভয়ংকর ঝুঁকির মুখে সে সমাজ কি সভ্য বলে পরিচয় দেওয়ার অধিকার রাখে!

তবে মর্মান্তিক ও ভয়ংকর ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তোলে রূপা গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাটি। বিদায়ী বছরে ২৫ আগস্ট ঘটে এই মর্মান্তিক ঘটনা। বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে ছোঁয়া পরিবহণের শ্রমিকরা ঢাকার আইডিয়াল ল’ কলেজের ছাত্রী এবং কর্মজীবী জাকিয়া সুলতানা রূপাকে গণধর্ষণ ও হত্যা করে মৃতদেহ মধুপুরের জঙ্গলে ফেলে দেয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে দেশজুড়ে মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়। প্রয়োজন এ ধরনের অপরাধগুলো দ্রুত বিচারের আওতায় আনা। বাসে, ট্রেনে, ঘরে, অফিসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বত্র নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। একজন কর্মজীবী নারী যদি নিরাপদে যাতায়াত করতে না পারেন তাহলে কিভাবে তিনি অর্থনীতিতে অবদান রাখবেন? ধর্ষণের ভয় নিয়ে পথ চলছে আজ এদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠি।

দীর্ঘ কয়েক বছরের প্রেম। প্রেমিকা বিয়ের জন্য চাপ দিলে তাকে হত্যার পরিকল্পনা। শেষ পর্যন্ত তাকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া। সেখানে গিয়ে তাকে হত্যা করা। তার মৃতদেহ সাত টুকরা করে ড্রামে ভরে রাখা। এ বছর বরগুনায় আলমগীর নামে এক নরপিশাচ এইভাবেই হত্যা করে মালা আক্তার নামে এক কলেজছাত্রীকে।

বছরের শেষ মাসে ১৬ ডিসেম্বর ঘটে আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা। বাড়ির ভিতর ঢুকে সুনামগঞ্জের দিরাইতে এসএসসি পরীক্ষার্থী সুমাইয়াকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে বখাটে ইয়াহিয়া সর্দার। এই বখাটে ইয়াহিয়া অনেক দিন ধরেই সুমাইয়াকে উত্ত্যক্ত ও হয়রানি করছিল। এ নিয়ে সালিশ বিচার হয়েছে। র্যাবের কাছেও অভিযোগ গেছে। তারপরও কোন ফল হয়নি। জীবন দিতে হয়েছে নিরপরাধ মেয়েটিকে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বখাটেরা রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য। আমাদের প্রশ্ন হলো যখন উত্ত্যক্তকরণের অভিযোগ উঠলো তখনি কেন বখাটে ইয়াহিয়াকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি? তখনি কেন তাকে আইনি প্রক্রিয়ার আওতায় আনা হলো না? যদি উত্ত্যক্তকরণের অভিযোগের ভিত্তিতে ইয়াহিয়াকে গ্রেপ্তার করা হতো এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হতো তাহলে মেয়েটির প্রাণ রক্ষা পেত।

বখাটেদের হামলায় বাংলাদেশে অসংখ্য নারীর শিক্ষাজীবন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেকে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। অনেকে শিকার হচ্ছে হামলার। এর আগে বখাটের আক্রমণে প্রাণ দিয়েছে ঢাকা উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রিশা। প্রাণ দিয়েছে স্কুলছাত্রী নিতু মণ্ডল। গুরুতর আহত হয়েছে কলেজছাত্রী খাদিজা। বখাটের হামলার প্রতিবাদ করায় দুই পা হাঁটু থেকে কেটে ফেলা হয়েছে স্কুলছাত্রী ইয়াসমিনের দিনমজুর পিতার।

বখাটেদের আক্রমণের ঘটনাগুলোর যদি দ্রুত ও কঠোর বিচার হতো তাহলে কিন্তু এ ধরণের অপরাধ দমন করা সম্ভব হতো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রিশাহত্যা মামলাটির সুরাহা এখনও হয়নি। দিনের পর দিন মামলার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। অপরাধীরা পার পেয়ে যায় বা বিচার বিলম্বিত হয় বলেই এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকে। কোন বখাটের বিরুদ্ধে উত্ত্যক্তকরণের অভিযোগ উঠলে পুলিশের কর্তব্য হলো দ্রুত তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।

কয়েকজন বখাটের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হলে অন্যরা ভয় পাবে এবং অপরাধে বিরত থাকবে। বছরের শেষদিকে ঘটে আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা। চট্টগ্রামের পটিয়াতে এক বাড়িতে চার নারী ধর্ষণের ঘটনা জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। প্রবাসী তিন ভাইয়ের স্ত্রী ও তাদের এক বোনকে বাড়িতে ঢুকে ধর্ষণ করে ডাকাতদল। তাদের মধ্যে একজন নারী ছয়মাসের অন্তঃস্বত্তা ছিলেন। এ ঘটনায় মামলা নিতে গড়িমসি করায় পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠে অবহেলার অভিযোগ। এছাড়া বছর জুড়ে প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়েছে কোন না কোন নারীকে ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের খবর।

২০১৭ সালটিতে নারী নির্যাতনের যে তাণ্ডব দেখা গেছে আশা করি ২০১৮ সালে তেমনটা হবে না। আশাকরি বছরটি ভালো যাবে। নারী ও শিশুর জন্য নিরাপদ হবে। হোক না হোক, আশা করতে তো দোষ নেই।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন