নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে দেশের স্বাস্থ্যখাত
২০১৭ সালের আগস্টের শেষভাগ হতে আমরা আচমকা এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেলাম। এটা একদমই অনাকাঙ্খিত ছিলো আমাদের জন্য। দলে দলে পাশের দেশ মিয়ানমার হতে উদ্বাস্তু লোকজন আসা শুরু করলো। মানবিক বিবেচনায় তাদেরকে আমরা আশ্রয় দিতে বাধ্য হলাম। স্বাভাবিকভাবেই তাদের খাবার-দাবার থেকে শুরু করে বাসস্থান, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ইত্যাদিও নিশ্চিত করতে হলো আমাদের। এর ফলে আমাদের অর্থনীতি যেমন চাপের মুখে পড়লো তেমনিভাবে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেও তা দারুণ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিলো।
আমরা জানি, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় ৬০ ভাগই শিশু। সে হিসাবে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে বলে ধারণা করা যায়। যেখানে আমাদের দেশে প্রায় সকল শিশুই জন্মের পর থেকেই সিডিউল অনুযায়ী টিকা পেয়ে থাকে সেখানে রোহিঙ্গা শিশুরা তা পায় না। ফলে এসব শিশুরা আমাদের দেশে আসার পরে সংক্রামক রোগ বিস্তারের বেশ একটা ভালো সুযোগ সৃষ্টি হয়ে গেলো। হুপিংকাশি, যক্ষা, হাম, পোলিও এসব রোগ নির্মূলে যেখানে আমরা পুরোপুরি সফল ছিলাম সেখানে এ অসহায় শিশুগুলো আসার পরে তা আবার ছড়ানোর ঝুঁকি তৈরি হয়ে গেলো।
রোহিঙ্গাদের ভেতরে প্রায় ৫০ হাজারে উপরে রোহিঙ্গা নারী গর্ভবতী ছিলেন। ফলে এ দেশে আসার পরে অনেক নতুন শিশুর জন্ম হয়েছেও রোহিঙ্গা শিবিরে। এসব শিশুকে টিকাদান থেকে শুরু করে তাদের সুস্থতার জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে স্থাপিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে দিনরাত পরিশ্রম করতে হচ্ছে। পুষ্টিকর খাবারের অভাবে শিশুরা অপুষ্টিজনিত সমস্যার শিকারও হচ্ছে। ইউনিসেফের তথ্যমতে, নভেম্বর অবধি প্রায় ১৭ হাজার রোহিঙ্গা শিশু মারাত্মক তীব্র অপুষ্টির শিকার হয়েছে। আবার ৪৫ হাজার ৮৫৬ টি শিশু মাঝারি মানের অপুষ্টিতে ভুগছিলো। বড়দের পাশাপশি শিশুদের দেহেও এইডসের জীবানু পাওয়া গেছে।
সুপেয় পানির অভাবে ডায়রিয়া, কলেরা রোগ ছড়ানোর সমূহ সম্ভাবনাও ছিলো। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের স্বাস্থ্য সেক্টর হঠাৎ একটা চাপের মুখে পড়ে গেলো। বলা যায়, এ অবধি আমাদের স্বাস্থ্য সেক্টর সে চাপ বেশ ভালোভাবেই মোকাবেলা করতে পেরেছে। কিন্তু যতদিন না রোহিঙ্গাদেরকে তাদের দেশ নিরাপদে ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে ততদিন আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপরে এ চাপ এবং ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। ফলে সবসময়ই আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে।
দুই.
নভেম্বর, ২০১৭ তে প্রকাশিত বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপ-২০১৬ অনুসারে যে তথ্য আমাদের হাতে এসেছে তা বেশ আশংকাজনক। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে , দেশে সিজারিয়ান প্রসবের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, দেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সম্পাদিত প্রসবের হার ৩১ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোনো দেশের মোট সিরাজিয়ান প্রসবের হার ১০ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে থাকার কথা থাকলেও আমাদের দেশে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে সে হার ৮৩%। ল্যাটিন আমেরিকার এক গবেষণার বরাত দিয়ে জরিপে বলা হয়, সিজারিয়ান প্রসব বৃদ্ধির ফলে মাতৃত্ব জনিত অসুস্থতা এবং মাতৃমৃত্যু বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও সিজারিয়ানের পর রক্তক্ষরণ ও অ্যানেসথেশিয়া জনিত জটিলতার কারণে স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে মৃত্যু হার ৩ গুণ বেশি। (সূত্র: জাগো নিউজ, ২২ নভেম্বর, ২০১৭)
২০১০ সালেও কিন্তু অবস্থা এমন ছিলো না। ঐ জরিপ বলছে ২০১০ এ এ হার ছিলো মাত্র ১২ শতাংশ; যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত হারের মধ্যেই। কিন্তু গত ৬ বছরের ব্যবধানে সে হার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এ অবস্থা যদি চলতে থাকে তা আমাদের মা ও শিশু স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। ভবিষ্যতে হয়ত তাকে চরম ঝুঁকির মধ্যেও ফেলে দিবে।
তাই সময় এসেছে এখন কিভাবে হাসপাতালগুলোতে স্বাভাবিক জন্মদানকে উৎসাহিত ও নিশ্চিত করা যায় তা নিয়ে ভাববার। এজন্য সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোতে রক্ষিত প্রসবের তালিকা মাসভিত্তিক নেয়া এবং তা যাচাইবাছাই করে করণীয় নির্ধারণ করা। যেসব ক্লিনিক বা হাসপাতাল অযৌক্তিকভাবে সিজারিয়ান অপারেশন করবে তাদের বিরুদ্ধে তালিকা ধরে ধরে ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে শিশু ও মায়ের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আমাদের অর্জিত সাফল্য আগামীতে ম্লান ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে পারে।
তিন.
গত প্রায় ২৮ বছরে আমাদের দেশ নতুন করে প্রায় সাতটি রোগের আবির্ভাব হয়েছে।এর মধ্যে এডিস মশা দিয়ে ছড়িয়েছে তিনটি রোগ। প্রথম ডেঙ্গু (১৯৯৯) , চিকুনগুনিয়া (২০০৮), জিকা (২০১৪) শনাক্ত হয়। এ তিনটির সাথে আরো চারটি যুক্ত হয়ে মোট সাতটি নতুন রোগ শনাক্ত হয়েছে। বাকি চারটি হলো এইচআইভি/এইডস, নিপাহ, বার্ড ফ্লু বা এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ও সোয়াইন ফ্লু। (সূত্রঃ প্রথম আলো, ২১ জুলাই, ২০১৭)
ঢাকাতে এ বছর চিকুনগুনিয়া তো রীতিমতো মহামারী আকারে দেখা দিয়েছিলো। তার আগের বেশ ক’বছর থেকে বর্ষাকালে এবং তার পরে ডেঙ্গু রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব আমরা দেখতে পেয়েছি। এইচআইভি/এইডস এখন নানা বৈশ্বিক কারণে ধীরে ধীরে আমাদের জনগোষ্ঠিতেও ছড়াচ্ছে। বিশেষ করে মাদকাসক্ত ব্যক্তি যারা একই সুচ বা সিরিঞ্জের মাধ্যমে দেহে মাদক গ্রহণ করে থাকে তাদের মধ্যে এ রোগের সংক্রমণ বেশি হচ্ছে। মাদক নির্মূল, মশার অবাসস্থল ধ্বংসে তাই যথাযথ এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ উক্ত রোগগুলো সংক্রামক। এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির দেহে সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই উৎস্য নির্মূল করতে না পারলে এসব রোগ থেকে রেহাই পাওয়া সত্যিই কঠিন হয়ে পড়বে।
অন্যদিকে, অসংক্রামক রোগের প্রকোপও আমাদের দেশে ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। নন কমিউনিকেবল ডিজিজেস রিস্ক ফ্যাক্টর সার্ভে, বাংলাদেশ ২০১০ বলছে, আমাদের দেশে বয়স্ক মানুষের মধ্যে প্রায় ৪৪.৮% মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ জনে একজনের হৃদরোগের সমস্যা রয়েছে। অথচ, হৃদরোগজনিত মৃত্যুর ৮০ শতাংশ কমানো সম্ভব সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমে। অন্যদিকে আমাদের দেশে স্ট্রোক, কিডনি রোগ এবং ক্যান্সারের পরিমাণও ধীরে ধীরে বাড়ছে।
এ ব্যাপারে এখন থেকেই তাই সরকারের পাশাপাশি নানা ধরনের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, এনজিও, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকেও যথাযথ উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন, খাদ্যাভাস প্রণালি, ধূমপান পরিহার, নিয়মিত ব্যায়াম, শারীরিক পরিশ্রম, পরিবেশন সংরক্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে অসংক্রামক রোগের প্রকোপ খুব সহজেই কমানো সম্ভব। আর সেক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প কিছু আছে কি?
সবকিছুর মূলে রয়েছে মানুষের সুস্থতা। সুস্থ মানুষ দেশের সম্পদ। তাই সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে যেমন কর্মক্ষম মানুষের সেবা পাওয়া সহজেই সম্ভব হয় তেমনিভাবে অর্থনীতিতেও তা ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। রোগ হলে চিকিৎসা করব- এ ধারণা থেকে বের হয়ে বরং আসছে বছর থেকে প্রতিরোধের দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরো গভীরভাবে মনোযোগী হবে- সে আশা আমরা তাই করতেই পারি।
লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক।
এইচআর/এমএস