হেরেও জিতলো আওয়ামী লীগ
ফলাফল নিয়ে আলোচনায় আসছি পরে। আগে একটি প্রশ্ন, রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেমন হয়েছে? এই প্রশ্নের এক কথায় উত্তর, চমৎকার। বাংলাদেশের বাস্তবতায় একটি নির্বাচন যতটা ভালো হওয়া সম্ভব, ততটাই ভালো হয়েছে- সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য। নির্বাচনের আগেও কাদা ছোড়াছুড়ি ছিল না। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের বড় কোনো অভিযোগ ছিল না। নির্বাচনের পরেও কেউ বড় কোনো অভিযোগ করেনি। বিজিত প্রার্থী বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কেউই নির্বাচন বর্জন বা ফলাফল প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেননি। এমনকি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও রংপুর নির্বাচনকে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ বলে মত দিয়েছেন।
তার মানে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন তাদের মান একটি উচ্চতর স্কেলে বেঁধে নিয়েছে। তাদের কাছে এখন সবার প্রত্যাশা আগের চেয়ে অনেক বাড়বে। তবে এটা নিছক ড্রেস রিহার্সাল, প্রথম সাময়িক পরীক্ষা। সামনে ঢাকা উত্তরসহ আরো কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন আছে। সেগুলো হলো দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা। আমার ধারণা দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায়ও নির্বাচন কমিশন জিপিএ-৫ পেয়ে পাশ করবে। কিন্তু তাদের বার্ষিক পরীক্ষা হবে আগামী জাতীয় নির্বাচন। সেটা কেমন হবে, সেটাই প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর কারো জানা থাকলে তো সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। তবে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন যে ভালো হবে এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থীই যে জিতবে, এটা আগেই বোঝা গিয়েছিল। ওবায়দুল কাদের আগেই বলে দিয়েছেন, ‘রংপুর নির্বাচনে কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না’। তার মানে নির্বাচনের ভালো-মন্দত্ব নির্বাচন কমিশনের ইচ্ছার ওপর নয়, নির্ভর করে সরকারি দলের চাওয়া না চাওয়ার ওপর। সরকার যদি হস্তক্ষেপ করতো, তাহলে নির্বাচন নিশ্চয়ই এত ভালো হতো না।
এই যে বললাম, রংপুর সিটি করপোরেশন ভালো হবে এটাও অনুমিত ছিল; ফলাফল কী হবে তাও জানা ছিল। তার মানে কিন্তু এই নয় যে নির্বাচনের ফলাফল সাজানো বা পূর্ব নির্ধারিত। মানুষ যাকে ইচ্ছা তাকেই ভোট দিতে পেরেছে। জনগণের রায়েই মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তফা। তাহলে ফলাফল অনুমিত ছিল কেন? বরাবরই রংপুর জাতীয় পার্টির ঘাঁটি। কিন্তু এটাই ফলাফল অনুমানের একমাত্র কারণ নয়। রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচন মানে ৫ বছর আগেও তো রংপুর জাতীয় পার্টির ঘাঁটিই ছিল। তখন কিন্তু আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী, এবার যিনি প্রায় এক লাখ ভোটে হেরেছেন, সেই সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুই জিতেছিলেন। তখন কি জাতীয় পার্টির ভোটাররা ঝন্টুকে ভোট দিয়েছিলেন? অনেকে বলছেন, গতবছর জাতীয় পার্টিতে অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল। এবার জয়ী হওয়া মোস্তফা তখন বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। ব্যাপার সেটাও নয়।
এবারও জাতীয় পার্টিতে অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল। এবার বিদ্রোহী ছিলেন এরশাদের আপন ভাতিজা। তারপরও জাতীয় পার্টির প্রার্থী বিপুল ভোটে জিতেছেন। অনেকে বলছেন, এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয়েছে। আর রংপুরের লোকজন অন্ধের মত লাঙ্গল মার্কায় ভোট দিয়েছেন। এই যুক্তিও ততটা খাটে না। কারণ রংপুরে জাতীয় পার্টির একক আধিপত্যে ধস নেমেছে অনেক আগেই। এমনকি এবার ৪৪টি কাউন্সিলরের মধ্যে জাতীয় পার্টি পেয়েছে মাত্র দুটি। তাহলে মেয়র পদে এমন ভূমিধস জয়ের কারণ কী? নির্বাচন ফলাফল ঘোষণার পর স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাতীয় পার্টি নেতা মশিউর রহমান রাঙা বলেছেন, ‘নির্বাচনে শেখ হাসিনা বা নৌকার পরাজয় হয়নি। হেরেছেন ব্যক্তি ঝন্টু'। তিনি ঝন্টুর পরাজয়ের অনেকগুলো কারণ তুলে ধরেছেন।
ঝন্টু গত নির্বাচনে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখেননি, তিনি মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন, তার বাসায় লোকজন সহজে যেতে পারে না। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনেক অভিযোগ। ইত্যাদি ইত্যাদি। ধরে নিচ্ছি, সবগুলো অভিযোগই সত্যি। এইসব কারণেই জনগণ তাকে ভোট দেয়নি। বরং গত নির্বাচনে হারার পরও জনগণের পাশে থেকে তাদের হৃদয় জয় করেছেন মোস্তফা। যার প্রতিদান পেয়েছেন নির্বাচনে। তবে এত সব কিছু নয়, রংপুরে জাতীয় পার্টির বিপুল জয়ের আসল কারণ হলো, সরকারি দল এখানে জিততে চায়নি। চাইলেই সরকারি দল জিতে যেতো ব্যাপারটা এমন নয়। বরং এক লাখ ভোটের ব্যবধানে হারা প্রার্থীকে জেতাতে চাইলে বড় ধরনের কারচুপি করতে হতো, যা ডেকে আনতে পারতো বড় বিপর্যয়।
সেই ঝুঁকিটা নেয়নি সরকার। বরং প্রার্থী নির্বাচন থেকে শুরু করে নির্বাচন পর্যন্ত কখনোই মনে হয়নি আওয়ামী লীগ জিততে চায়। না জিতলেও চেষ্টা করলে ব্যবধান কমানো যেতো। সরকারি দল সেই চেষ্টাও করেনি। জেতার ব্যাপারে তাদের প্রথম অনীহা দেখা যায় প্রার্থী মনোনয়নে। ঝন্টুর বিরুদ্ধে মশিউর রহমান রাঙা যা যা অভিযোগ করেছেন, তা নতুন কিছু নয়, সরকারি দলের নেতারা জানতেন না, এমনও নয়। জেনেশুনেই তারা এমন একজন প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে, যার পরাজয় নিশ্চিত। তিনি যে জবাই হয়ে যাচ্ছেন, এটা সম্ভবত ঝন্টুও জানতেন। তাই জবাইয়ের আগে বা পরে কোনো গাইগুইও করেননি। স্বেচ্ছায় বলি হয়েছেন। মনোনয়ন থেকে নির্বাচন পর্যন্ত দেখে মনে হয়েছে সরকারি দল জাতীয় পার্টিকে ওয়াকওভার দিয়ে দিয়েছে।
কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় হেভিওয়েট নেতারা দিনের পর দিন কুমিল্লায় থেকে চেষ্টা করেছেন। পারেননি সেটা আলাদা কথা। কিন্তু কুমিল্লায় চেষ্টার কোনো ঘাটতি ছিল না। যেটা দেখা যায়নি রংপুরে। নাটকটা এত চমৎকার ছিল, ফাঁকা মাঠে জাতীয় পার্টি হেসে খেলে বিপুল জয় নিয়ে ঘরে ফিরেছে। নির্বাচনের রাতে আমি ফেসবুকে লিখেছিলাম, ‘আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এরশাদকে আওয়ামী লীগের ঘুষ রংপুর সিটি করপোরেশন।’ অনেকেই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, আমি নাকি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলছি। আমি মোটেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলিনি। নির্বাচন যতটা ভালো হওয়া দরকার, ততটাই ভালো হয়েছে। নির্বাচনের দিন কিছু হয়নি। যা হওয়ার আগেই হয়েছে।
এরশাদ কে এমন যে তাকে ঘুষ দিতে হবে? এরশাদ হলো বর্তমান রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের তুরুপের তাস। বিএনপির বর্জনের পরও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনী পুলসেরাত আওয়ামী লীগ পেরুতে পেরেছিল অনিচ্ছুক এরশাদের জাতীয় পার্টিতে ভর করেই। এরশাদের তখনকার নাটকের কথা নিশ্চয়ই আপনারা ভুলে যাননি? জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বিরোধী দল বানিয়ে, সেই বিরোধী দলের ৩ জনকে মন্ত্রী বানিয়ে, রওশন এরশাদকে বিরোধী দলীয় নেতা বানিয়ে, এরশাদকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত বানিয়ে আওয়ামী লীগ আরামসে দেশ শাসন করছে।
এরশাদ অনেক ফোসফাস করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এরশাদ একটু মাথাচাড়া দিলেই কোনো একটা মামলার তারিখ পড়ে। ব্যস তাতেই এরশাদ আবার পোষ মেনে যান। মামলার এমন মোক্ষম বেল্ট গলায় থাকতে এরশাদকে আবার ঘুষ দিতে হবে কেন? আওয়ামী লীগ যখন বুঝে গেছে, রংপুরে জেতা সম্ভব নয়, তখনই তারা সেটিকে উপহারের মত সাজিয়ে এরশাদের হাতে তুলে দিয়েছে। আগামী নির্বাচনে যখন আসন সমঝোতার প্রশ্ন আসবে, তখন আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে বলতে পারবে, আপনাকে তো আগেই রংপুর ছেড়ে দিয়েছি। রংপুর আসলে এরশাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আগাম দর কষাকষি।
আওয়ামী লীগ আসলে রংপুরে হেরেই জিততে চেয়েছে। সেটা তারা জিতেছে ষোল আনাই। এখানে তাদের হারানোর কিছু ছিল না, পাওয়ার ছিল অনেককিছু। সেটা তারা বুঝে নিয়েছে কড়ায় গন্ডায়। জাতীয় পার্টির সঙ্গে আগাম দর কষাকষিটা তো সেরে রাখা গেলই। সবাইকে জানানো গেল, ‘দেখো বর্তমান সরকার কত ভালো। তারা নির্বাচন কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপ করে না। এই সরকারের অধীনেও দারুণ নির্বাচন হয়। তাই সবাই দলে দলে এই সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে অংশ নিয়ে অশেষ নেকি হাসিল করুন।’
আমার ধারণা সরকার আরেকটা জিনিস দেখতে চেয়েছে, মাঠের সত্যিকারের অবস্থাটা কী। রংপুর নির্বাচনের ফলাফল দেখে এখন তারা আগামী নির্বাচনের জন্য হিসাব নিকাশটা ভালোভাবে করতে পারবে। সাংবাদিক হাসান শান্তনু ফেসবুকে লিখেছেন, ‘রংপুরে বৃহস্পতিবার মুক্তি পেয়েছে সামান্য দৈর্ঘ্যের সিনেমা ‘নৌকাডুবি’। এ সিনেমার কাহিনীর ভেতর ‘অশনিসংকেত’ নামে আরেকটা পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার গল্প আছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কি তা অনুধাবন, উপলব্ধি করতে পারছে?’ ওবায়দুল কাদেরকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতেই হবে।
ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রার্থী, তাও নৌকা প্রতীক নিয়ে, হারতেই পারেন; কিন্তু তাই বলে এক লাখ ভোটের ব্যবধানে! যে নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর ভোট আগের নির্বাচনের তুলনায় ৬৫ ভাগ বেড়েছে, সে নির্বাচনে সরকারি দলের ভোট ৪১ শতাংশ কমে গেল কেন? ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘রংপুর নির্বাচনের ফলাফল আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না এবং আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে জিতবে।’ আত্মবিশ্বাস ভালো। কিন্তু রংপুরের মত সারাদেশেই যদি তাদের ভোট এই হারে কমে যায়, তাহলে জিতবে কিভাবে? আওয়ামী লীগকে তাই পরাজয়ের কারণ নয়, বিশাল ব্যবধান এবং ভোট কমে যাওয়ার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।
একই সঙ্গে বিএনপি যদি ধরে নেয়, রংপুরের মত সারাদেশেও তাদের ভোট কোনো চেষ্টা ছাড়াই ৬৫ ভাগ বেড়ে যাবে; তাহলে তা হবে বোকার স্বর্গে বাস করার শামিল। ভোটারদের মনস্তত্ত্ব অত সোজা নয়। আর জাতীয় পার্টির কথা না হয় নাই বললাম। তারা যদি ভাবে, জাতীয় পার্টির জোয়ার ফিরে এসেছে। এই নির্বাচনের পথ ধরে আগামী নির্বাচনে এককভাবে অংশ নিয়ে ক্ষমতায় আসবে, নিদেনপক্ষে রংপুরের সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করবে; তাহলে করুক। এক লাখ ৬০ হাজার ভোট তাদের আত্মপ্রসাদের বেলুন যতটা ফাঁপিয়েছে, তা ফুটো হতেও সময় লাগবে না। আওয়ামী লীগ হোক, বিএনপি হোক বা জাতীয় পার্টি- ভোট পেতে হলে সবাইকে জনগণের কাছে যেতে হবে, তাদের মন জয় করতে হবে; রংপুরে যেটা পেরেছেন মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। রংপুরের আসল শিক্ষা এটাই।
২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭
এইচআর/পিআর