ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

এবারের বিজয় ভাবনা

আবুল মোমেন | প্রকাশিত: ০৫:১৪ এএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭

১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর ভারত-বাংলাদেশ যৌথবাহিনী যখন হানাদার পাকিস্তানি সেনাদলকে পরাজিত করে দেশ দখলমুক্ত করেছিল তখন জাতি ঐক্যবদ্ধ, স্বপ্নে ও প্রত্যাশায় চঞ্চল। সেটা ছিল আদর্শবাদী চিন্তা ও মহৎ স্বপ্নের কাল। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শকে মূলনীতি করে সংবিধান রচিত হয়েছিল। ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সব নাগরিকের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করে গণতান্ত্রিক ধারায় দেশের অগ্রগতি ছিল লক্ষ্য।

৪৬ বছর পরে বিজয় দিবসে মনে হচ্ছে গত কয়েক বছরে দেশে এবং পৃথিবীতে যেসব পরিবর্তন ঘটেছে সেগুলো বাদ দিয়ে বাংলাদেশের বাস্তবতা বোঝা যায় না। অমর্ত্য সেন ও কৌশিক বসুর মত দু’জন কীর্তিমান বাঙালি অর্থনীতিবিদসহ পশ্চিমের অনেক বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকও উন্নয়নের বিচারে বাংলাদেশকে বিস্ময় হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এ বিস্ময়কর অর্জনগুলো এড়িয়ে সঠিক বাংলাদেশকে কি বোঝা যাবে? তার আগে বুঝে নিতে হবে স্বাধীনতার পর পর যে যে হোঁচটগুলো খেয়েছি আমরা সেগুলো।

প্রশ্ন হল আমাদের নেতৃবৃন্দ কি মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের মানুষ প্রস্তুত ছিলেন না। কেন ছিলেন না তা বোঝা যাবে ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথের সাবধান বাণী থেকে। তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা অন্তরের সামগ্রী’। এ কথায় বোঝাতে চেয়েছিলেন নিজের মধ্যেকার পরাধীনতার প্রবণতাগুলো রেখে স্বাধীনতার সুফল মেলে না। নিজে ব্যক্তিগত রিপুর বশীভূত, ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থের দাবির কাছে দুর্বল থাকলে স্বাধীনতা মাত্রা ছাড়িয়ে অর্থহীন হবে। নিজের ক্ষুদ্রস্বার্থকে দেশের ও মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের মাঝে বিলিয়ে দিতে না পারলে কীভাবে মানুষটা দেশের হয়ে কাজ করবে? দেশবাসী বুঝে-না-বুঝে, কিংবা অবস্থার গতিকে, একাত্তরের মুক্তযুদ্ধকালীন নয় মাস এই উচ্চ ভাবাদর্শ পালনের স্বাক্ষর রেখেছিল।

কিন্তু মানুষ তো স্বাভাবিক অবস্থায় সামাজিক জীব, সংসারের দায়কে অগ্রাধিকার দিতেই অভ্যস্ত। ষাটের দশক থেকে দেশের ছাত্র-শ্রমিক এবং সচেতন নাগরিক সমাজ রাজনৈতিক সংগ্রামে প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবেই লিপ্ত ছিলেন। আর তখন বঙ্গবন্ধুর নির্ভরযোগ্য আবার আকর্ষণীয় নেতৃত্ব পেয়ে দেশে এক অসাধারণ গণজাগরণ ঘটেছিল, আর তার ফলে সৃষ্ট হয় অভূতপূর্ব ঐক্য। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ বাদে বাঙালির রূপান্তর ঘটেছিল সে দিন বাঙালি বীরত্বের ডাকে সাড়া দিল, কলহ ও কোন্দল ভুলে এক হয়ে গেল, বাক্যবাগীশ কর্মবিমুখ না থেকে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এর ফল মুক্তিযুদ্ধ এবং ফসল বিজয়।

দুর্ভাগ্য, যুদ্ধকালের এই উদ্দীপনা, এই ব্রতী মনোভাব যুদ্ধপরবর্তী শান্তিকালে দেশগঠনের লড়াই অবধি ধরে রাখা গেল না। প্রায় বিজয়ের পর পরই যেন মানুষ ফিরে গেল তাদের সামাজিক, সাংসারিক সত্তায়। বরং এতদিনের ত্যাগ ও সংযমের পরে হঠাৎ যেন ক্ষুদ্র স্বার্থের বাঁধ ভেঙে গেল। একটা অস্থির বিশৃঙ্খল সময় দেশকে গ্রাস করেছিল তখন। এমন অস্থিতিশীল সময়ের সুযোগ নেওয়ার মানুষেরও অভাব ছিল না। একদল বিপ্লবী আদর্শের স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নামল তো আরেক দল পরাজিত আদর্শের বীজ সংরক্ষণ করে প্রত্যাঘাতের ষড়যন্ত্রে নেমে গেল। দেশের আদর্শ কি পরিকল্পনা সবই ওলটপালট হয়ে গেল। সামরিক স্বৈরশাসনে রাজনীতিক এবং শিক্ষিতসমাজ উভয়ের চরম অবক্ষয় ঘটায় সমাজের বড় ক্ষতি হল। রাজনীতি সম্পূর্ণ আদর্শচ্যুত হয়ে গেল। আদর্শের ভিৎ ছাড়া ছাত্র রাজনীতি তো চলতেই পারে না, হয়ত তাই এর আদর্শচ্যুতি ঘটেছে সবশেষে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরে। কিন্তু তারপরে অবক্ষয় এত ক্ষিপ্রগতিতে ঘটেছে যে কয়েক বছরেই চলে গেল অপশক্তির গ্রাসে। এখন এর নানান বিকার রাজনীতি ও সমাজ উভয়কেই বড্ড ভোগাচ্ছে।

মার্কিন সমাজ দার্শনিক ড্যানিয়েল বেল ১৯৬৫ সনে পরিবর্তমান মার্কিন সমাজের প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন বই ‘আদর্শবাদের সমাপ্তি- দ্য অ্যান্ড অব ইডিওলজি’। নব্বইয়ের দশকে এই লক্ষণ আমাদের সমাজেও দেখতে পেলাম। এই বাস্তবতায় সনাতন বা ধ্রুপদী ধারণা থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বা সুশাসনের মান বিচার করলে হতাশ হতে হবে। গণতান্ত্রিক বিকাশের সাথে মানবাধিকারের সুরক্ষা, আইনের শাসনের নিশ্চয়তা, সকল মত-পথের অন্তর্ভুক্তি, স্বাধীন স্থানীয় সরকার, মানুষের অংশগ্রহণ, নাগরিক অধিকারের সাম্য ও এর সুরক্ষা, সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ইত্যাদি মোটামুটি সহনীয় মাত্রায় ও মানে চর্চা হওয়ার কথা। এসব ক্ষেত্রে আমাদের বাস্তবতা প্রত্যাশীত মানের কাছাকাছি নেই এটা মানতেই হবে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্যে যেমন রাজনীতি চর্চা কঠিন করে রাখা হয়েছে তেমনি ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সম্পদের সুরক্ষাও নিশ্চিত করা যায় নি।

কিন্তু এ-ই শেষ কথা নয়। বাংলাদেশ থেমে থাকে নি। বহুকাল আগে মনীষী হুমায়ুন কবীর কবিতার প্রসঙ্গে এই খরস্রোতা নদী-খালের ভাঙাগড়ার দেশে মানুষের উদ্যমশীলতার কথা বলেছিলেন। প্রাণচঞ্চল, খামখেয়ালি দুর্বার প্রকৃতির সাথে বসবাস করে আসা এই জনপদের মানুষের রয়েছে ঘাড় গুঁজে বিপর্যয় সইবার ক্ষমতা আর দুর্যোগের পরেই নবোদ্যমে জীবনজয়ের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার অফুরন্ত উদ্যম।

এই মানুষ গণতন্ত্র বা সুশাসনের অপেক্ষায় বসে থাকে নি, নিজের মত করে প্রাপ্ত সকল সুযোগ কাজে লাগিয়ে রীতিমত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সরকারি কিছু কর্মীর আন্তরিক ভূমিকা, বেসরকারি সংস্থার দূরদর্শী সহায়তা, বেসরকারি উদ্যোক্তার বিনিয়োগ গ্রামবাংলার পল্লীবধূ আর ভীরু বালিকাদের দলে দলে কর্মীতে রূপান্তরিত করেছে, নিম্ববর্গের খেটে খাওয়া মানুষের বেকারত্ব ঘুচিয়ে বিদেশে রোজগারের পথ খুলে দিয়েছে, কৃষি উৎপাদনে চমকপ্রদ বিপ্লব ঘটতে সাহায্য করেছে। একাত্তরে যখন আমরা বিজয় অর্জন করেছি তখন সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার খাদ্য সংস্থান করতে পারতাম না, এখন ৪৬ বছর পরে তার দ্বিগুণ মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করছেন দেশের কৃষক। প্রত্যেক মানুষের দু’একটা শার্ট আছে, পায়ে আছে অন্তত রাবারের চপ্পল, গ্রামের হাটে মহার্ঘ ফলের সওদা মেলে, মেয়েরা দল বেঁধে স্কুলে যায়, গর্ভবতী নারী স্বাস্থ্য পরামর্শ পান ঘরের কাছেই। জনমানুষের এই অগ্রগতি মূলত তাদেরই খাটুনির ফসল। একটু খেয়াল করলে বুঝব বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিসর বড় হচ্ছে, তাতে অংশীদারিত্বের ব্যাপ্তিও ঘটছে। যে তিনটি ক্ষেত্রের অবদানে অর্থনীতির বিকাশ ঘটে তা হল মানসম্পন্ন শিক্ষা, পুঁজি সঞ্চারের ক্ষমতা এবং অবকাঠামোর উন্নয়ন ইত্যাদিতে সরকার অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। ফলে যে কোনো পরিস্থিতিতে প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রকট রাজনৈতিক সংকট কিংবা বিশ্বব্যাংকের মত সংস্থার উপেক্ষা সবই বাংলাদেশ নিজেই উপেক্ষা করে এগুতে পারে আজ। দেশের এই সামর্থ্যকে উপেক্ষা করা অন্যায় হবে। বাংলাদেশ এগুচ্ছে, বাংলাদেশের অগ্রগতি কেউ থামাতে পারবে না।

লেখক : কবি, সাংবাদিক ও চিন্তাবিদ

এআরএস/এমএস

আরও পড়ুন