ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বিজয়ের পথ বেয়ে

আরিফা রহমান রুমা | প্রকাশিত: ০৪:২৪ এএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭

কিছু কিছু যন্ত্রণা থাকে যার তীব্রতা কখনোই কমেনা আবার কিছু কিছু ভালো লাগার আবেদনও কোনদিন পুরোনো হবার নয়। একাত্তরের পুরোটা সময় আমাদের তেমনি এক বছর। সে বছরের ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালির সবচেয়ে গৌরবের দিন। বিনিময়ে দিতে হয়েছে অনেক। ত্রিশ লক্ষ প্রাণ এবং দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম হারানোকে কেবল সংখ্যা দিয়ে নয় বিচার করতে হবে হৃদয় খুঁড়ে।

আমাদের মায়েরা মাছের মা ছিলেন না তাই পুত্র শোকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছেন এমন মায়ের সংখ্যা ও খুব কম নয়। সংসারের কর্মক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে অনেক পরিবারকেই নিঃস্ব ভিখারী হতে হয়েছে। বুদ্ধিজীবী হত্যার নির্মম ষড়যন্ত্রের কথাও ততোক্ষণে জেনে গেছে সবাই। ভয়াবহ সে ঘটনাগুলো বলাবলি করে শিউরে উঠছে সবাই। দেশকে মেধাশূন্য করতে এ দেশেরই আলো হাওয়ায় বেড়ে ওঠা অমানুষদের কী পৈশাচিক ষড়যন্ত্র !! এই সেদিনও ওই পিশাচদের গাড়িতে আমরাই তুলে দিয়েছিলাম আমাদের সবুজের ভেতর বুকের রক্ত শোভিত টকটকে লাল রঙের জাতীয় পতাকা।

ফিরে যাই আবার সেই দিনে, চারদিক জুড়ে কেবল হারানোর সংবাদ আর খুঁজে পাবার প্রত্যাশায় এদিক সেদিক ছোটাছুটি। সম্ভ্রম হারানোর লজ্জা আর যন্ত্রণা নারী মাত্রই উপলব্ধি করতে পারেন। মৃত্যু যন্ত্রণাও কারো কারো কাছে এর থেকে শ্রেয় তাই সম্ভ্রম হারিয়ে মৃত্যুকেই বরণ করেছিলেন অনেকেই। কোন কোন নারী তার অনাহুত সন্তানের আগমনের অপেক্ষায় আড়ষ্ট, প্রতিবেশির তাচ্ছিল্য আর ভ্রুকুটির সামনে মৃত্যুর প্রত্যাশায়।

এদিকে মহানায়ক তখনো পাকিস্তানের কারাগারে, তাঁর ভাগ্যে কী ঘটেছে নিশ্চিত বলতে পারছেনা কেউ। চোখের আলোয় দেখার সৌভাগ্য না হলেও মনের আলোয় ঠিকই দেখতে পাই সেই দিন, পুরো নয়টি মাস। বিকেল ঠিক ০৪ টা ৩১ মিনিটে নিয়াজী আত্মসমর্পণের দলিলে সই করে। এক দানবীয় শক্তির করুন পরিণতি ঘটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের আকাশে উড়তে থাকে বিজয়ের লাল সবুজ পতাকা, আকাশ বাতাশ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে “জয় বাংলা” স্লোগানে। যে জয়ের জন্য এতো ত্যাগ তা কেবল পাকিস্তানের অপশাসন থেকে মুক্তির জন্যই ছিলোনা, বাঙালি মনে প্রাণে মুক্তি চেয়েছিল সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের যাঁতাকল থেকে, বাঙালি মুক্তি পেতে চেয়েছিল পাকিস্তানি জান্তা সরকারের অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ থেকে, সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার আর বৈষম্যেকে চিরতরে বিলুপ্ত করতে জন্ম নেয় বাংলাদেশ।

বিজয় লাভের আজ ৪৬ বছর, লাভ ক্ষতির হিসেবে লাভের পাল্লা এতোটাই ভারী যে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করাই এখন সময়ের চূড়ান্ত অপচয়। হিসেব তাই নিজেদের স্বপ্নের বিপরীতে বাস্তবায়নের যোগ বিয়োগ। চলার প্রতিটা পদক্ষেপেই ছিল বাঁধা। আমাদের দেশে জন্ম নেয়া পাকঅন্তঃপ্রান অমানুষ গুলো একদিনের জন্যেও হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি, রক্তের বিনিময়ে কেনা এই দেশের উপর আঘাত থেমে থাকেনি। বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বাঙালি জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে, জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে বিজয়কে নস্যাৎ করবার চেষ্টা হয়েছে। পাকিস্তানের প্রেতাত্নাকে এ জাতির উপর চাপিয়ে দিয়ে দেশকে পাকিস্তান অভিমুখে হাঁটতে বাধ্য করা হয়েছে, প্রজন্মকে ভুল ইতিহাস শিখিয়ে জাতিকে দ্বিধা বিভক্ত করা হয়েছে, ধর্মান্ধ জঙ্গি গোষ্ঠীকে লালন পালন করে হৃষ্টপুষ্ট করা হয়েছে।

প্রায় দুই যুগের এ অপচেষ্টার ফল আমরা এখনো ভোগ করছি। ধর্মান্ধ সেই জঙ্গি গোষ্ঠী দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বিদেশের মাটিতেও। এদেশে এখনো যে তারা ঘাঁপটি মেরে আমার আপনার ভেতরেই বসে নেই ব্যাপারটা এতো সরল নয়। মাঝে মাঝে কিছু আলামত দেখে আলসেমি ভেঙে যেন জেগে উঠি সবাই। এতোসব ষড়যন্ত্রের পরেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শক্তি ফের ক্ষমতায় এসে দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন করছে। একদা মঙ্গার দেশ আজ নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ ছাড়িয়ে মধ্যম আয়ের দেশের দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। উন্নয়নের সব গুলো সূচক দেশের সমৃদ্ধির কথা বলে।

আজ সত্যি এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, একদা যে দেশে জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার সে মোটেও আর মাথা নোয়াবার নয়। তবে এই তৃপ্তিতে শুয়ে বসে থাকার সুযোগ আমাদের হাতে একেবারেই নেই, পাক প্রেতাত্নারা অগ্নি নিঃশ্বাস নিয়ে আমাদের চারপাশেই ঘুরছে। ধর্মের মিথ্যা ধুঁয়া তুলে বাঙালি সংস্কৃতির যেমন অপব্যাখ্যা করে মাঝেমাঝেই সমাজকে বিষিয়ে দিচ্ছে তেমনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে নানা রকম কৌশল খাটিয়ে সব ধরনের অপকর্ম করে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই তাদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, মাত্র দুই বছর আগেই চাঁদের ছবিতে এক যুদ্ধাপরাধীর ছবি ফটোশপ করে লাগিয়ে নিরক্ষর মানুষ গুলোকে মিথ্যা বুঝিয়ে দেশে কী এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হলো।

মিথ্যাই তাদের একমাত্র শক্তি, একমাত্র অস্ত্র। আর তাই বছরের পর বছর সেই মিথ্যাকে পুঁজি করেই তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে চলেছে। “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মসজিদে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে, শান্তিচুক্তি হলে চট্টগ্রাম যেতে ভিসা লাগবে”, ক্ষমতায় আসতে এই ধরনের কুৎসিত মিথ্যাচার ও তারা করেছেন। কিছুদিন আগে বিএনপি নেত্রী চট্টগ্রাম আর কক্সবাজার গেলেন, খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো, ভিসাটা তিনি কোথা থেকে করলেন। এইসব মিথ্যাচার প্রমাণিত হবার পরেও তারা কী নির্লজ্জভাবে জনগণের সমর্থন চায়। আসলে বিজয়ীরা বিজয়ের আনন্দে শত্রুর গতিপথ মনে রাখেনা আর পরাজিতরা পরাজয়ের গ্লানি আর যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হতে প্রতি মুহূর্তে জয়ের সুযোগ খোঁজে। একাত্তরে যে সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্নবীজ বোনা হয়েছিলো শত ঝড়েও আজ সে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। পূর্ব পুরুষের রক্ত ঘামে কেনা এ স্বপ্ন বাস্তবায়নই হবে আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন