ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বাঙালি মুসলমানের নতুন পরিচয়!!

মাসুদা ভাট্টি | প্রকাশিত: ০৬:৫৯ এএম, ১২ ডিসেম্বর ২০১৭

বেশ অনেক দিন ধরেই এ বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে যে, বাঙালি কি একটি নতুন পরিচয়ে পরিচিত হতে চলেছে? বিশেষ করে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং তারপর এদেশ থেকে জিহাদে যোগ দিতে সেই আশির দশক থেকেই প্যালেস্টাইন বা আফগানিস্তানে যাওয়া বাঙালি যে শেষ পর্যন্ত সিরিয়াতে গিয়ে আইসিস-এও যোগ দেবে তা হয়তো অনেকেই ধারণা করতে পারেননি। কিন্তু তাই-ই হয়েছে। এবং এতোটাই ভয়াবহ ভাবে বাঙালির জাতীয় চরিত্রের এই দিকটি উন্মোচিত হয়ে পড়ছে যে, সারা বিশ্বই বাঙালিকে নতুন ভাবে চিনতে শুরু করেছে।

দীর্ঘদিন ইউরোপে বসবাসের সুবাদে একথা প্রতিটি আলোচনা-আয়োজনেই বলা হতো যে, সংশ্লিষ্ট দেশগুলির অভিবাসী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বাঙালি সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় এবং আইন মান্যকারী কমিউনিটি। বিভিন্ন সংস্থার প্রকাশিত জরিপেও তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের পর থেকেই এই আলোচনা অন্য দিকে মোড় নিতে শুরু করে। বিশেষ করে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর থেকে বাঙালি অভিবাসী সম্প্রদায়কে নিয়ে গবেষণায় নতুন তথ্য উঠে আসতে শুরু করে। অভিবাসী বাঙালি নিজেদের মুসলিম পরিচয়টি তার জাতি পরিচয়ের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে শুরু করেছে এবং সে কারণে একটি বৃহৎ ধর্মসম্প্রদায়ের পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইছে এমন ধারণা থেকে গোটা বাঙালি কমিউনিটিকে দেখা শুরু হলো মূলধারার গণমাধ্যমে। কিন্তু তাদেরকেও দোষ দেওয়া যাবে না কারণ তারা তখন প্রমাণ হিসেবে হাজির করতে শুরু করবে যে, এই দেখুন এতো সংখ্যক বাঙালি তরুণ-তরুণী-যুবক-প্রাপ্ত বয়স্ক জেনে-শুনে-বুঝে সিরিয়ায় গিয়ে যোগ দিয়েছে আইসিস-এর সঙ্গে।

এমনকি এতোদিন বাঙালি নারী সম্পর্কে প্রচলিত ধারণায় আমরা উদ্বেলিত থেকেছি যে, বাঙালি নারীর মন নরোম ও কোমল, সে ধারণাকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে একাধিক বাঙালি তরুণী আইসিস-এর জিহাদি বধু হওয়ার জন্য সিরিয়ায় যাওয়ার পর নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়তে হলো বাঙালি অভিবাসী সম্প্রদায়কে। কারণ বাঙালির অর্জন বিশেষ করে বাঙালি তিন নারীর ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে সদস্য হওয়া এবং আরেক নারীর হাউস অব লর্ডসে সদস্য হওয়ায় প্রশংসার সঙ্গে সঙ্গে যে সব বাঙালি নারী গিয়ে আইসিস-এর জিহাদি বধু হয়েছে তাদের প্রসঙ্গও উঠতে শুরু হলো, যা আসলে কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

এখানেও যদি ঘটনা থেমে যেতো তাহলেও আমরা নিজেদের আত্মপক্ষ সমর্থনে যুক্তি দিতে পারতাম যে, যখন কোনো সম্প্রদায়কে তাদের ধর্ম পরিচয়ের কারণে কোনঠাসা করে ফেলা হয় তখন তারা আসলে প্রতিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করে। কিন্তু সেটাতো হয়নি, বাঙালি মুসলমান বেছে নিয়েছে এমন একটি পথ যা দেশে-বিদেশে বাঙালি মুসলমানকে অত্যন্ত নিন্দনীয় একটি পরিচয়ে পরিচিত করে তুলছে। দেশের ভেতর হোলি আর্টিজান বা শোলাকিয়ার মতো ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটানোর পর বিদেশেও যখন বাঙালি মুসলিম ধর্মসন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়ে কখনও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’কে হত্যার পরিকল্পনা কিংবা নিউ ইয়র্কের রাস্তায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে তখন কি কোনো ভাবেই বাঙালি মুসলমানের পক্ষে দেওয়ার মতো কোনো যুক্তি আর অবশিষ্ট থাকে?

নিশ্চয়ই এই প্রশ্ন অনেকেই তুলবেন যে, কতিপয় বাঙালি দুষ্কৃতিকারীর জন্য গোটা বাঙালি মুসলমানকে কেন দায় নিতে হবে? এই প্রশ্ন যৌক্তিক এবং আমাদের সেকথা জোর দিয়েই বলতে হবে। কিন্তু একথাও সত্য যে, আমরাও যখন কোনো জাতিকে নেতিবাচক ভাবে বিচার করি তখন সেই জাতির কতিপয় দুষ্কর্ম দিয়েই গোটা জাতিকেই তার জন্য দায়ী করি, তাই নয় কি? বাঙালি মুসলমানও কেন এই বিবেচনার বাইরে থাকবে, সেটা একবার ভেবে দেখার জন্য সকলকে অনুরোধ জানাই।

আমরা ধর্মপ্রাণ, আমরা উগ্রবাদী নই, এমনকি ইসলাম শান্তির ধর্ম এখানে উগ্রবাদের কোনো স্থান নেই এমন আপ্তবাক্যে আর কতোটা আস্থা রাখা যায় বলুনতো? বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাঙালি মুসলমানের অপকর্মের কথা বাদ দিয়ে আসুন নিজের দেশের দিকে তাকাই। এই দেশে আমরা একটি সংখ্যালঘু ধর্মসম্প্রদায়কে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছি, তাদের জমি-সম্পত্তি দখল করেছি, তাদের কন্যা-জায়া-জননীকে গণধর্ষণের মাধ্যমে লাখে লাখে হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে এদেশ ত্যাগে বাধ্য করেছি। আমি নিশ্চিত আমার একথাতেও অনেকেই বলবেন, তাহলে এখনও এদেশে হিন্দুরা টিকে আছে কী করে? তাহলে তাকাই এদেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের দিকে। যদিও আমরা এখন সরকারি ভাবে তাদেরকে আর আদিবাসী নামে ডাকতে পারি না। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে তাদেরকে আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী করে রেখেই শান্ত হচ্ছি না, তাদেরকে এখন উচ্ছেদের প্রচেষ্টায় আছি সর্বোতভাবে নিপীড়নের মধ্য দিয়ে।

দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিয়ে পাহাড়ে বসিয়েছি আমরা, জমির মালিকানার অংশীদার করেছি, আর এখন নতুন উপসর্গ হিসেবে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদেরকেও স্থায়ী আবাস করে দেওয়ার জন্য চোখ তুলেছি ওই আদিবাসী চাকমা-মগ-মুরং-মারমা-কুকীদের আবাসভূমির দিকে। এর একমাত্র কারণ তারা মুসলমান নয়, তারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী নয়। প্রশ্ন হলো, এরপরও বাঙালি মুসলমান হিসেবে কী করে আমরা নিজেদেরকে অসাম্প্রদায়িক, শান্তিপ্রিয় ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ হিসেবে দাবি করতে পারি বলতে পারেন?

এমনকি যদি আমরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের দিকেও যদি তাকাই তাহলেও কী দেখতে পাই? গণজাগরণ মঞ্চের পরে দেশের উদারপন্থী মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া তরুণদের যারা ধর্মকে একটি অনালোচিত ট্যাবু থেকে মুক্ত করে সমালোচনাযোগ্য বিষয় হিসেবে ব্লগে/লেখায় উল্লেখ করতে শুরু করেছিল, কিন্তু তাতে একদল মানুষের আঁতে ঘা লাগতে শুরু করে এবং বিষয়টিকে সেই মুক্তিযুদ্ধের মতোই ধর্মের ওপর আঘাত হিসেবে বর্ণনা করে নাস্তিকের বিরুদ্ধে ধর্মবাদীদের লেলিয়ে দেয়া হয়।

পরিণতিতে আমরা হারাই একাধিক বিজ্ঞানমনস্ক তরুণকে যারা আর কিছুই নয় একটু হলেও উদার ও আধুনিক চিন্তা দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন অন্ততঃ দেখতেন বা দেখাতে পারতেন। কিন্তু বাঙালি মুসলমান সেটুকুও সহ্য করেনি, যাদেরকে হত্যা করা যায়নি তাদেরকে এদেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে নিরাপত্তাহীনতার কারণে। কিন্তু গালভরা বক্তব্য হিসেবে বাঙালির বহু পরিচয়ের অন্যতম হলো শান্তিপ্রিয় অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট, যা দীর্ঘকাল যাবত আমরা শুনে আসছি। যদিও এর লিখিত ও গবেষণালব্ধ কোনো প্রমাণ এখনও কেউ হাজির করেছেন বলে চোখে পড়েনি। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, বাঙালির হাজার বছরের যে অর্জন একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন তা অর্জিত হয়েছে একটি অসাম্প্রদায়িক মুক্তিচেতনার ভেতর দিয়ে, যেখানে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের আধিপত্য ছিল না। আর সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধকে মূলতঃ ইসলামপন্থীরা তাদের পরাজয় হিসেবেই দেখে থাকে।

আজকে বাংলাদেশে এমন এক অবস্থায় আমরা এসে পৌঁছেছি যে, কোনো আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ বা প্ল্যাটফরম আর অবশিষ্ট নেই যাকে আমরা মুক্তচিন্তা বা আধুনিকতা বলে দাবি করতে পারি। এ বিষয়ে অবশ্য আমার আরো বিস্তারিত বলার কথা রয়েছে বিশেষ করে সরকারের সমালোচনায় যে, রাজনৈতিক ভাবেও আমাদের সে সুযোগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যা কোনো ভাবেই স্বাস্থ্যকর নয়, তবে সে বিষয়ে ভিন্ন কোনো লেখায় আলোচনা করতে চাই। কিন্তু আজকে একথা বলেই আলোচনাটি শেষ করতে চাই যে, এই যে দেশে বিদেশে বাঙালি মুসলমানের একটি নতুন ও উগ্র ধর্মবাদী পরিচয় তৈরি হচ্ছে তা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যতো বটেই, বর্তমানে যারা জীবিত আছেন তাদের জন্যও সুখকর হবে না।

মালয়েশিয়ায় শ্রমিক হিসেবে গিয়েও যদি সেখানে বসে জঙ্গী তৎপরতা চালানোর অভিযোগ ওঠে বাঙালি বিরুদ্ধে তাহলে বাঙালিকে শ্রমবাজারে গ্রহণের পক্ষে আর কোনো দেশই কি সত্যিকার অর্থে কোনো যুক্তি খুঁজে পাবে? ব্রিটেন বা আমেরিকায় বাঙালি তরুণের এই যে আত্মঘাতী আক্রমণের প্রচেষ্টা তাতে এসব দেশে বাঙালি কমিউনিটির ওপর নেমে আসবে মূলধারার সমাজ থেকে ঘৃণা ও আঘাত। এমনিতেই পশ্চিমে ইসলাম-বিদ্বেষ যেভাবে বেড়ে চলছে সে আগুনে বাঙালি মুসলমান তরুণদের এই আত্মঘাতী প্রচেষ্টা যে নতুন ঘৃণাবাদের জন্ম দেবে তাতেতো কোনোই সন্দেহ নেই।

এখন থেকে সিরীয়, পাকিস্তানি বা আফগান পাসপোর্টের মতো বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্টধারী বাঙালিও যে তাদের মতো সন্দেহের তালিকায় যুক্ত হবেন সেটা নিশ্চিত। আমরা যতোই নিজেদের শান্তিপ্রিয়, অসাম্প্রদায়িক, উগ্রবাদ-বিরোধী হিসেবে প্রচার করি না কেন, কাজে সেটা প্রমাণ না দিতে পারলে এসব আত্মপ্রশংসা কোনো কাজেই আসবে না। বাঙালি মুসলমানের এই নতুন পরিচয় বিশ্বময় যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে বাঙালি মুসলমান সম্পর্কে তা থেকে খুব দ্রুত আমরা বেরিয়ে আসতে পারবো সে সম্ভাবনাও আমি দেখছিনে, কারণ দেশের ভেতরকার পরিস্থিতি আমাদের সেরকম কোনো সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয় না।

ঢাকা ১২ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার ২০১৭
[email protected]

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন