সুখশ্রমের মানুষ শ্রান্ত অতিশয়
আনিসুল হকের সাথে আমার পরিচয় ৯০ সালের দিকে মতিঝিলে তাঁর অফিসে। ‘অনুভব’ নামে একটি গ্রাম উন্নয়ন অনুসন্ধানী গবেষণা প্রকল্পে কাজ করতাম। সে কাজের অন্যতম উপদেশক ছিলেন সাংবাদিক আবেদ খান। যখনই প্রয়োজন হতো আবেদ ভাই আমাকে মতিঝিলে ‘মোহাম্মদী গ্রুপ’-এর অফিসে দেখা করতে সময় দিতেন। সেখানেই একজন সিরিয়াস ব্যবসায়ী আনিসুল হকের সাথে পরিচয়। মাঝে-মধ্যে এখানে ওখানে দেখা হলে একটা অমলিন হাসি দিতেন। তেমন একটা কথা-বার্তা হতো না। কোন কাজেও কখনও তাঁর কাছে যাওয়া হয়নি। ২০০৯ সালের ১৩ অক্টোবরে জেনেভা থেকে প্যারিসে এক সাথে ফ্লাই করেছিলাম। ডিজিটাল বাংলাদেশ-সহ নানা বিষয়ে আলাপ হয়েছিল। আমার কাজ নিয়ে তাঁর জানার আগ্রহ সেদিন আমাকে খুবই মুগ্ধ করেছিল।
গত বছর একাত্তর টিভি-র শাকিল ও রূপা আমার দূর-নির্ণয়ী ক্যান্সার প্রকল্পের জন্যে ২০ ভাগ স্থানীয় তহবিল সংগ্রহের দুর্দশা দেখে আমাকে বলল- আপনি আনিস ভাইয়ের সাথে দেখা করে তাঁর পরামর্শ নেন। গত বছরের (২০১৬) অক্টোবরের এক সন্ধ্যায় তাঁর বনানীর বাসায় গেলাম ওদের সাথে নিয়ে। আমাদের সকল উদ্যোগের কথা খুব মনোযোগের সাথে শুনে প্রথমেই জানতে চাইলেন, বাবা-মা কেমন আছেন। বললাম, বাবা নেই, মা কুমিল্লায় আছেন, মোটামুটি ভালো। রুবানা আপা রসিকতা করে বললেন, ‘আপনি কুমিল্লার মানুষ, রামপালে ক্যান্সার নিয়ে কাজ করছেন?’ – সাথে সাথে আনিস ভাই ছোঁ মেরে কথাটা নিয়ে বললেন, ‘আমি তো নোয়াখালীর মানুষ, এখন ঢাকা শহরের ক্যান্সার সারাচ্ছি’! বুঝলাম আমার কথা তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। নানারকম পরামর্শ দিলেন। বললেন, ‘বিদেশী অনুদান যা পাবেন সেটাই কাজে লাগাতে হবে, এখানে কিছু পাবেন না! কারণ আমাদের চেহারাটা ভিন্ন, তবে হ্যাঁ, আমি ও আমার পরিবার আপনার সাথে থাকবো’! জানতে চাইলাম, ‘প্রকল্পের কোন দিকটা শুনে আপনার মন চাইছে আমাদের সাথে থাকতে’? এক নিঃশ্বাসে বললেন, ‘আমার ছেলে ক্যান্সারে মারা গেছে, আমি জানি এর বেদনা কি! আমার ভাই যুক্ত্ররাস্ট্রে ক্যান্সারের বড়ো ডাক্তার, আমি জানি আমাদের দুর্বলতা কোথায়, এই দেশে এই মুহূর্তে অন্তত কুড়িটা ক্যান্সার সেন্টার দরকার। আপনার সাথে একটায় থাকি না, আর যখন এটা গ্রামে হচ্ছে সেটাই তো বেশি দরকার!’
আমার অন্তরের হতাশা প্রথম দিনেই হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। নানা জায়গায় আমাদের জন্যে সুপারিশ করলেন। তাঁর ভাই সেনাপ্রধান থেকে নামিদামী ব্যবসায়ী, তাঁর বন্ধু-বান্ধব অনেকের কাছে পাঠালেন, ‘আপনি যাবেন, কেউ এগিয়ে আসুক বা না আসুক, তাঁরাও এ দেশের নাগরিক, তাঁরাও জানুক দেশে এমন কিছু উদ্ভাবনী কাজ হচ্ছে’।
আজ আমি তাঁর বিদায়ের দিনে কৃতজ্ঞতার সাথে জানাই, আমাদের গ্রাম ক্যান্সার কেন্দ্রের জন্যে প্রথম স্থানীয় অনুদান দিয়েছেন আনিসুল হক ও তাঁর স্ত্রী রুবানা হক। ধন্যবাদ জানাতে ফোন করেছিলাম। বললেন, ‘রেজা সেলিম ভাই, এটা খুব সামান্য, আমরা আছি আপনার পাশে, এটা ছেড়ে দেয়া যাবে না’।
‘আমি বয়সে আপনার ছোট আমাকে ভাই ডাকছেন কেন? শুধু নাম ধরে ডাকবেন। বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, পরেরবার থেকে...”।
একদিন সন্ধ্যায় দেখি ফোন মেসেজ, ‘ওয়াচ মি অন এটিএন নিউজ অন মশা!’ অনুষ্ঠান শেষে আমি ফোন দিলাম রাতে। ‘বললেন, দেখেছো, মুন্নী সাহা আমাকে আটাকাতে পেরেছে?’
আমি বললাম, ‘আপনিও তো শেখ হাসিনা-কে আটকাতে পারেননি’! হো হো করে হেসে উঠলেন, ‘রেজা সেলিম আজ কিন্তু আপনি করে বলিনি’!
সে আলাপেই বলেছিলাম- রুবানা আপা চান আমরা তাঁদের ফ্যাক্টরিতে মেয়ে কর্মীদের ক্যান্সার নিরীক্ষার কাজ করি। আমরা তা করতেও যাচ্ছি। শুনে আনিস ভাই খুব খুশি হলেন; হাসতে হাসতে বললেন, ‘রুবানা এদিক থেকে আমার চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে আছে! খুব ভালো, শুরু করে দেন’।
আমার সহকর্মী ডা. তাহমিনা ও ডা. সীমা যখন গাজীপুরে তাঁদের ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করলো। আমি তা জানিয়ে টেক্সট মেসেজ পাঠালাম, সাথে সাথে উত্তর, ‘কংগ্রাচুলেশনস’!
আমাদের সমাজে এখন এমন মানুষের সংখ্যা খুব-ই কম। আমি পত্রিকায় যা পড়ছি ও আগে থেকে যা জানি- আনিসুল হক একজন স্বনির্মিত মানুষ। হৃদয়বান, দায়িত্বশীল ও অনুপ্রেরক। একদিন রুবানা আপা তাঁর অফিসে আমাকে বলছিলেন কেমন করে আনিস ভাই তাঁর মেয়রের কাজের প্রয়োজনে বাসা থেকে অনেক ফার্নিচার নিয়ে গেছেন। মাঝে মাঝে আপার রাগ হলেও ভেবেছেন বাধা পেলে মেয়র মন খারাপ করবেন। সেদিন এটাও শুনেছিলাম মেয়রের জন্যে বরাদ্দ সম্মানীর টাকা তিনি অফিসে অন্যদের বেতনের সাথে যুক্ত করে বিলিয়ে দেন। কারণ কর্পোরেশনের কর্মীদের বেতন কম!
এই প্রাণবন্ত উৎসাহদাতা মানুষটি হারিয়ে আমি আর সকলের মতোই হতবিহ্বল। মৃত্যু সংবাদ পেয়ে লন্ডনে রুবানা আপার কাছে শোক জানালাম। উত্তর তিনি লিখলেন, ‘মরণরে তুহুঁ মম শ্যাম সমান’! আমি জানি কতোটা বেদনামাখা এই বাক্য তিনি লিখেছেন, তাঁর কাছে তাঁর স্বামী-বন্ধু-প্রেমিক-সহযাত্রী আর মৃত্যু সবকিছু এক হয়ে গেছে!
কথা ছিল শীতের দিকে একবার রামপাল আমাদের কাজ দেখতে যাবেন। খুলনায় তাঁর অনেক বন্ধু আছেন যাদের সাথে আড্ডা দেবেন।
ছেলেমেয়েদের ষাট গম্বুজ মসজিদ আর সুন্দরবন দেখাতে নেবেন। হয়তো পরিশ্রান্ত মানুষটি শান্তিও খুঁজছিলেন। জানিনা! বিধির নিয়ম রীতি বুঝা খুব কঠিন!
লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম প্রকল্প
[email protected]
এইচআর/এমএস