বিমান লন্ডনে, কী কারণে ম্যানচেস্টারে
বিমান ‘আকাশে শান্তির নীড়’ এ এক প্রাণ জুড়ানো শ্লোগান। বিশেষত যারা বাংলাদেশের বাইরে থাকে, তাদের জন্যে আবেগঘন এ কথাগুলো। এই আবেগেই হয়তো যাত্রীরা বিমানে চড়ে। শান্তির নীড়ে পরিভ্রমণ করতে চায়। বিমান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার অন্ত নেই। ক’টার বিমান ক’টায় ছাড়ে, এক নিত্য জিজ্ঞাসা বিমান যাত্রীদের। তবুও মানুষ বিমানই দেখে। লন্ডন মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ বিমানকেই বেছে নিতে চায় তাদের ভ্রমণে। কিন্তু বিমান যেন প্রতি দিন টিম টিম করে জ্বলে। লোকসানের পাহাড় নিয়ে একের পর এক লাখো-কোটি টাকা ভর্তুকি দেয় বছরের পর বছর। কোনই ফল আসে না। বরং লোকসান, অর্থ ভাগ-বাটোয়ারা, সিন্ডিকেট প্রভৃতি শব্দের মাঝেই বিমান স্বাধীনতার পর থেকেই অশান্তি সৃষ্টি করে চলেছে একের পর এক।
ম্যানচেস্টারে আমার আবাস হলেও একবার দেশে গিয়েছিলাম বিমানে, সেই ২০১০ সালে। আবেগে-বিশ্বাসে সরাসরি সিলেটে নামবে বিমান এই ভরসা থেকেই ম্যানচেস্টার-লন্ডন ট্রেন জার্নিসহ প্রায় ২০০ পাউন্ডের অতিরিক্ত খরচ কাঁধে নিয়েই যাত্রা করেছিলাম বিমানে লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্ট থেকে। নির্ধারিত সময়ের পরে বিমান উড্ডয়ন হলেও এতে খুব একটা খেদ ছিলো না। অনেকটা প্রস্তুতিই ছিলো। সেদিনের বিমানের অভ্যন্তরীণ সেবার কথা উচ্চারণ না করেই শুধু একটা কথা লিখি, দুবাই ল্যান্ড করার প্রায় ঘন্টাখানেক আগে হঠাৎ অনুভব করলাম বিমানের ভেতরে ভ্যাপসা গরম। যাত্রীরা বিশেষত বাচ্চারা গরমে কান্নাকাটি শুরু করেছে। একটা শিশুর চর্ম রোগ থাকায় চিৎকার করছে, অস্বস্তিতে দৌড়া-দৌড়ি করছে। কখনো তার মা ম্যাগাজিন জাতীয় কিছু দিয়ে বাতাস করছেন। প্রথম শ্রেণিতে গিয়ে দেখলাম, সব কিছু ঠিকই আছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মহিলা এলেন। তাঁকে অনুরোধ করলাম, এর কি কোন সমাধান করা যায় না। দুঃখ প্রকাশ করাতো দূরের কথা, তিনি বলে উঠেন, কই এটাতো এমন কিছু নয়। কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করেই বললেন, দেখি দুবাই গিয়ে কিছু করা যায় কি-না।
দুই.
দেশ থেকে ফিরে আসার অবস্থাটা আরও বেদনাদায়ক। হিথ্রো এয়ারপোর্টে অবতরণের পূর্বে ব্রিটেনের আকাশে আগ্নেয়গিরি’র ছাইজনিত কারণে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সকল উড়োজাহাজই ফিরে যাচ্ছিলো ভিন্ন ভিন্ন পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে। আমাদেরও ফিরিয়ে নেয়া হয় ব্রাসেলস এ। তারপর সে এক দীর্ঘ গল্প। প্রায় চারশত যাত্রীকে ব্রাসেলস এয়ারপোর্টে রেখে বিমানের সকল কর্মকর্তা চম্পট দেয়। বেলজিয়ামের গণমাধ্যমের (টিভি) কল্যাণে আন্তর্জাতিক সংস্থা রেডকোর্স ও অন্যান্য স্থানীয় চ্যারিটি সংগঠন এসে পানি-খাবার-ডাক্তারের ব্যবস্থা করে। বাসস্থানের জায়গা হয় এয়ারপোর্টের দু’তলায় রেডকোর্সের ব্যবস্থানায় নিয়ে আসা বিছানায়। সরকারের ডাকাডাকিতে পরের দিন বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রথম সচিব আসেন। কিন্তু আমরা দেখি নি আর কোন বিমানের কর্মকর্তাকে।
বিমানে এরকম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ত বিমানের প্রতিটি যাত্রীই হয়েছেন কোন না কোন সময়। কেউ কথা বলেন, কেউ বলেন না। কোন যাত্রী হয়তো পিছু ছাড়েন না। ক্ষতিপূরণ নিয়েই ছাড়েন। ২০১২ সালে বিমানের বিলম্ব-অব্যস্থাপনার বিরুদ্ধে এরকমই এক অভিযোগ এনে মামলা করেছিলেন এক ভোক্তভোগী লিবারপুল কাউন্টি কোর্টে। এর আগে ক্ষতিপূরণ দাবি করলেও বিমান কর্তৃপক্ষ পাত্তা দেয় নি, কিন্তু ব্রিটেন প্রবাসী শাহ সানোয়ার পিছু ছাড়েননি। পাঁচ বছর পর অবশেষে গত মাসে তিনি পাঁচ লক্ষ টাকার উপরে ক্ষতিপূরণ আদায় করেছেন বিমানের কাছ থেকে।
তিন.
সম্প্রতি আরেকটা ঘটনা ঘটেছে, লন্ডনে। ‘ব্যবসা গুটিয়েছে এয়ার এক্সপেস তথ্য দিতে নারাজ বিমান’ দিয়ে প্রধান শিরোনাম করেছে লন্ডনের স্থানীয় ‘সাপ্তাহিক পত্রিকা।’ পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী খবর নিয়ে জানা গেছে এয়ার এক্সপ্রেস এন্ড ট্যুরস নামের এই প্রতিষ্ঠান বিমানের টিকেট বিক্রির অন্যতম একটা প্রধান সেলস এজেন্ট। টিকেট বিক্রিতে শীর্ষ অবস্থানে থাকার কারণে এয়ার এক্সপ্রেসকে পুরস্কারও দিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ। এয়ার লাইন্স ব্যবসার রীতি অনুযায়ী এজেন্টগুলো এয়ারলাইন্স থেকে দু’সপ্তাহের ক্রেডিট সুবিধা পেয়ে থাকে। এ প্রতিষ্ঠানটি গত দু’বছর আগে দাবি করেছে যে, তাদের বার্ষিক টার্নওভার ৪০ থেকে ৪২ মিলিয়ন পাউন্ড।
এই হিসেবে বন্ধ হয়ে যাওয়া এয়ার এক্সপ্রেস এন্ড ট্যুরস এর কাছে বিমানের কি পরিমাণ অর্থ ক্রেডিটে আছে তা জানাচ্ছে না লন্ডনের বিমান কর্তৃপক্ষ। ধারণা করা হচ্ছে একটা বিরাট অংকের পাওনা বা ক্রেডিট থাকতেই পারে এ প্রতিষ্ঠানের কাছে। পত্রিকার পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে বিমানের ম্যানেজার শফিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে, তিনি কোন কথাই বলতে চাননি। অথচ বিমান বাংলাদেশ এবং বাঙালিদের একটা জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। বিমান কি পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে তা জানাতে কোন দ্বিধা থাকার কথা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কত হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে, তাও দেশের মানুষ জেনেছে। তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বিমান ম্যানেজারের এমন লুকোচুরিতে স্বাভাবিকভাবেই জবাবদিহিতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, এবং বিমান নিয়ে প্রচলিত ধারণা যেমন অর্থ লোপাট-ভাগ-বাটোয়ারা প্রভৃতি শব্দগুলো আবারও জনসমক্ষে ভেসে উঠছে।
চার.
বিমানের ম্যানচেস্টার অফিস আরেক অলাভজনক এবং বলতে গেলে লোকসানি কার্যালয়। শহরের ব্যয়বহুল পোর্টল্যান্ড স্ট্রিটে এ অফিসটির অবস্থান। একজন রিজিওনাল ম্যানেজারসহ এখানে কাজ করেন পাঁচজন কর্মকর্তা। বিমানের স্থানীয় অফিস সূত্রে জানা যায়, বিমান অফিসের প্রতি মাসের সরাসরি বিক্রয় মাত্র ১৫ থেকে ২০ হাজার পাউন্ডের মতো। যদিও এই অফিসের খরচই আছে মাসে ১২ হাজার পাউন্ডের অধিক। এখান থেকে কোন ফ্লাইট চলে না। কমিউনিটি মানুষের চাহিদা এবং ব্যবসায়িক হিসাব-নিকেষ করে এখান থেকে ২০০৬ সালে একবার ফ্লাইট চালু করে মাত্র কিছুদিন পরেই তা বন্ধ হয়ে যায়।
আবারও ২০১১ সালে ফ্লাইট চালু করে বিমান। নয় মাস চালায়, তারপর বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এ অফিসটি থেকে অর্থাৎ গত চল্লিশ বছরের ইতিহাসে অত্যন্ত অলাভজনক কিংবা লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে। অলাভজনক বিবেচনায়ই এই অফিসটি কর্তৃপক্ষ এ বছরের গোড়ার দিকে বন্ধের উদ্যোগ নেয়। বিমান বোর্ডস অব ডাইরেক্টরের এক আদেশে অফিসটি বন্ধের উদ্যোগ নিতে নির্দেশও দেয়া হয়। ব্যবসায়িক ক্ষতি বিবেচনায় এর আগেও দু’একটি শহরে বিমান অফিস বন্ধ করা হয়েছে। সুতরাং বিমান অফিসটি ম্যানচেষ্টারে বন্ধ করে দেয়া কোনো অযৌক্তিক কিংবা ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো না।
তাছাড়া ম্যানচেস্টারের অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই এলাকায় এরকম প্রতিষ্ঠান থাকার কোন যৌক্তিকতাও নেই। যেখানে ম্যানচেস্টারস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন ব্যয় কমাতে এবং কমিউনিটির স্বার্থে শহরের বাইরে নিয়েছে হাইকমিশনের কার্যালয়, সেখানে একটা লোকসানি প্রতিষ্ঠানের অফিস কোন কারণ ছাড়াই সেই একই জায়গায় অর্থাৎ ব্যয়বহুল এলাকায়ই রাখা হয়েছে। কর্মকর্তা অফিসে যাচ্ছেন আর আসছেন। অফিসের কর্মকর্তারাই বলছেন, তাদের যেটুকই ব্যবসা, তার প্রধান হলো টেলিফোন নির্ভর।
স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী, যিনি তার ম্যানচেস্টারের ট্রাভেলস ব্যবসায় বসে বিমানের একজন বড় সেলস এজেন্ট হিসেবেও ব্যবসা চালাচ্ছেন, তিনি তার আলোচনায় বলেছেন, বিমান ম্যানচেষ্টার থেকে চালু হলে ব্যবসায় কোন সফলতা আসবে না। অথচ ঐ ব্যবসায়ীই বিমানের ম্যানচেস্টারের কার্যালয়টি বন্ধ করার পক্ষে একমত হতে পারেন নি স্থানীয় ‘প্রবাস বাংলা অনলাইন টিভি’র সাথে এক সাক্ষাৎকারে। এতেই প্রতীয়মান হয়, বিমানের ব্যবসা কি আদৌ হচ্ছে কিংবা দিনে দিনে কত টাকা গচ্ছা যাচ্ছে, সেটা যেন কর্মকর্তাদের ভাবনার ব্যাপার নয়, বিমান নিয়ে কোন্ ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান কিভাবে ব্যবসায় অর্থ বানাচ্ছে, কোন অজানা কারণে সেটাই যেন দেখাশোনা করছে বিমানের কিছু অসাধু প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ এই ম্যানচেস্টারে। এবং সেজন্যেই হয়তো বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেয়ার পরও ম্যানচেস্টারের অফিসটি খোলাই আছে আগের মতো।
একটা লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ম্যানচেস্টার অফিসটি টিকে আছে। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক লাভালাভের কোনো তোয়াক্কা না করে, স্থানীয় কমিউনিটিকে কোন সেবা প্রদান না করে প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোর পেছনে প্রতি মাসে ১০-১৫ লাখ টাকা অপচয়ের কারণটাই কি? বছরের পর বছর থেকে চলমান রাখার পক্ষে যুক্তিটাই-বা কি- এ প্রশ্ন ম্যানচেষ্টারের গোটা বাঙালি কমিউনিটির।
পাঁচ.
বিমান যেন একটা তুঘলকি শাসন ব্যবস্থার সাক্ষী। কেউ কিছু করতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত বিভিন্ন সময় এ নিয়ে প্রচন্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বিমান কি এভাবেই চলতে থাকবে। বিমান নামক অসুস্থ হাতির হাত থেকে কবে মুক্ত হবে বাংলাদেশ?
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক, কলাম লেখক।
এইচআর/জেআইএম