ছাত্ররাজনীতি আসলে কোন রাজনীতি?
ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ স্কুল পর্যায়ে নিজেকে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়ায় একটা বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেকেই আশংকা প্রকাশ করছেন, এর মাধ্যমে স্কুল গুলোতে পরিবেশ বিঘ্নিত হবে। এই আশংকার নিশ্চয়ই ভিত্তি আছে। কিন্তু বলে রাখা ভাল, জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন, ইসলামী ছাত্র শিবির বহুদিন ধরে স্কুল পর্যায়ে সংগঠন পরিচালিত করছে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। বাম সংগঠনগুলোরও আছে। তাই ছাত্রলীগও চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু কেন ছাত্র রাজনীতি আজ অবাঞ্ছিত হয়ে উঠলো, সেই জিজ্ঞাসার সময় এসেছে। ছাত্র রাজনীতির একটা স্বর্ণালী সময় ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, থেকে শুরু করে বেঁচে আছেন এমন অনেক কিংবদন্তীতুল্য রাজনীতিক, এমনকি প্রশাসকও ছাত্র রাজনীতির থেকে এসেছেন। দেশে এই মুহূর্তে কোন ছাত্র আন্দোলন নেই, ফলে গঠনমূলক ছাত্র রাজনীতি নেই। হারিয়ে যাওয়া ছাত্র রাজনীতির হাতিয়ার ছিল লেখা পড়া, বই খাতা, কাগজ কলম, মেধা আর মানুষের জন্য প্রেম। এখনকার ছাত্র রাজনীতির হাতিয়ার হলো মাদক, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভাড়ায় শক্তি প্রদর্শনসহ নানা ধরনের অবৈধ বাণিজ্য। খুব সরলীকরণ মনে হলেও বাস্তবতা কিন্তু তা-ই।
দেশের বর্তমান সাংবিধানিক আইন অনুসারে আঠারো বছর বয়স হলেই যে-কোনও নাগরিক নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার অর্জন করেন। ভোট দেওয়ার অধিকারের পিছনে যে গণতান্ত্রিক যুক্তিটি রয়েছে, তা হল, নির্বাচনী গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিকের মতামতের মূল্য সমান। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আঠারো বা তার চেয়ে বেশি বয়সের শিক্ষার্থীরা রাজনীতি করবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কোন রাজনীতি করবে প্রশ্ন হলো সেটি। দলের লেজুড়বৃত্তি করে চাঁদাবাজ বা সন্ত্রাসী হবে, নাকি ভবিষ্যতের একজন সুরাজনীতিক হওয়ার জন্য ছাত্ররাজনীতি কররে?
অনেকেই পশ্চিমা দেশের প্রসঙ্গ আনবেন। সত্যি বলতে কি, সেখানকার ছাত্রছাত্রীরাও সক্রিয় রাজনীতি করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর সমাবেশ বা সংগঠন করার অধিকার সে-সব দেশে সবার আছে। শিক্ষা ও সামাজিক ইস্যুতে সেসব দেশে ছাত্র আন্দোলন হয়, সভা, সমাবেশ ও মিছিল হয়। কিন্তু আমাদের ছাত্র রাজনীতি আজ যে কারণে নিন্দিত, তার কারণ ছাত্র রাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনে ব্যাপক দলীয় অনুপ্রবেশ। ছাত্র সংগঠন সমূহের এখন আর কোন স্বাতন্ত্র্য নেই। বাইরের নেতাদের নির্দেশে বা অপ-নির্দেশে শিক্ষাঙ্গনের ছাত্রছাত্রীরা চালিত হচ্ছে।
বাইরের এই নির্দেশ বা অপ-নির্দেশের কারণে এখনকার ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে নানা দুর্নীতি এবং অর্থকরী কার্যক্রম। যেমন ভর্তি বা সিট বাণিজ্য, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি যার স্বাভাবিক পরিণাম দলাদলি, বিশৃঙ্খলা আর সহিংসতা।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সক্রিয় ছাত্ররাজনীতি আছে, কিন্তু ছাত্র সংসদ নেই। এর ফলে ছাত্র সংগঠন গুলোর স্বাতন্ত্র্য ও নিজস্বতা বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছেনা, রাজনৈতিক দল আর বহিরাগত নেতাদের অনুপ্রবেশও বন্ধ করা যাচ্ছেনা। স্বৈরাচারের আমলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা সম্ভব হলেও গণতন্ত্রের আমলে তা আর হলোনা।
ছাত্ররা গণতান্ত্রিক উপায় নিজেদের প্রতিনিধি চয়ন করবে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলি রাজনৈতিক দলের প্রশাখায় পরিণত হয়ে নিজস্বতা হারিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলির ক্রীড়নক হয়ে উঠেছে। তাই এ দেশে ছাত্র রাজনীতি এক বিকৃত রূপ ধারণ করেছে। ক্যাম্পাসগুলি রাজনৈতিক দলগুলির রঙ্গমঞ্চে পরিণত হয়েছে, ছাত্র সংগঠনের নেতা, বিশেষ করে বড় দুটি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা তারাই হয়েছেন, যারা ছাত্র-ছাত্রীদের চাহিদা জানেন না বা জানতে চান না, যারা শিক্ষার প্রসারের সাথে সংশ্লিষ্ট নন।
বরং এদের সাথে বহিরাগতদের যোগাযোগ বেশি, এরা ক্যাম্পাস ভিত্তিক একডেমিক পরিসরের কাজ করার চাইতে, অর্থ উপার্জনে পারদর্শি বেশি। তিনিই ‘ছাত্র নেতা’ বা ‘ছাত্রী নেতা’ যিনি ভাল ভর্তি বাণিজ্য বা সিট বাণিজ্য করেন। তিনিই বড় নেতা যিনি নিজ সংগঠনের কমিটি গঠন নিয়েও বাণিজ্য করার খ্যাতিলাভ করেছেন। তিনিই বড় নেতা যিনি শিক্ষকদের ভাল হেনস্থা করতে পারেন। এর নাম রাজনীতি নয়, রাজনীতির নামে পরিহাস।
ছাত্র সংগঠনগুলো এমনই পরাজিত যে, তারা যে যে দলের সমর্থনপুষ্ট সেই বড় রাজনৈতিক দলগুলির সমালোচনা করার সাহসও রাখেনা। বড় সামাজিক ইস্যুতে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা ক্যাম্পাসে আন্দোলন করলে তাতে যোগ দেয় না এরা। উল্টো কখনো কখনো পেটোয়াবাহিনী হিসেবে শিক্ষার্থীদের উপর হামলে পড়ে।
ছাত্ররাজনীতি থাকুক, তবে তা হোক দলীয় প্রভাবমুক্ত, এটি একটি সাধারণ প্রত্যাশা। কিন্তু এদেশে তা সম্ভব নয়। যে শিক্ষকেরা নিজেরাই দলীয় রাজনীতি করেন, তারা কি দলীয় রাজনীতির ছোঁয়া এড়িয়ে ছাত্র রাজনীতি হতে দেবেন? আমাদের ক্যাম্পাস রাজনীতিতে দলীয় রাজনীতির প্রভাব অনেক বেশি। কিন্তু একই সঙ্গে একথাও ভাবতে হবে যে, জঙ্গি ভাবাপন্ন সংগঠনের প্রাদুর্ভাব তার চেয়েও বেশি। তাই ক্যাম্পাস রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলের অনুপ্রবেশ কমানোর কথা ভাবলে ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলো যে বেড়ে উঠবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? এই আশংকা নিয়ে কিন্তু কেউ প্রশ্ন তুলছেনা।
বিতর্ক হচ্ছে, তা ভাল লক্ষণ। ছাত্র রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে দু’দিকেই যুক্তি উঠে আসছে। দলীয় প্রভাবমুক্ত ছাত্র রাজনীতি জরুরি। ছাত্র সংগঠনগুলিকে শুধু খাতায়-কলমে রাজনৈতিক দল হতে বিচ্ছিন্ন করলেই হবে না। সত্যই যেন কোনও সংযোগসূত্র না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সে শুধু একটি বা দুটি সংগঠনের জন্য যেন না হয়। যারা দীর্ঘ সময় ধরে ধর্মের নামে আমাদের শিক্ষার্থীদের মগজ ধোলাই করছে, জঙ্গি বানাচ্ছে সংগঠন পরিচালনার নামে, তাদের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে আরও গভীরে গিয়ে সমাধান খোঁজা প্রয়োজন।
লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস