কেন অসফলতা?
মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ জেসিয়া ইসলামের দেশে ফিরে আসার পর প্রকাশিত সাক্ষাৎকার পড়লাম। কষ্ট পেলাম। শুরু থেকেই সে প্রতারিত ছিল। আয়োজকেরা নেহায়েত তোপের মুখে পড়ে তাকে মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন- এ বেশ পুরোনো গল্প। কিন্তু তার সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ অনেকবার উচ্চারিত।
আমাদের দেশের যেসব প্রতিযোগী বিশ্বমানের বা দেশের গন্ডির বাইরে কোনো প্রতিযোগিতায় যায় তাদের প্রায় সবাই এই আক্ষেপগুলো করেন। সেটাই পৌনঃপুনিক উচ্চারিত অংশ হচ্ছে, দেশ থেকে তাদের প্রস্তুতির ব্যাপক ঘাটতি, অব্যবস্থাপনা, অসহযোগিতা। মানছি বিশ্বমানের প্রতিযোগিতায় গেলেই এসব ভুলত্রুটি অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। কিন্তু শুধু অভিজ্ঞতা লাভ করতে করতে তো ৪৬ বছরের এই দেশ বুড়িয়ে গেল! অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানে ভুলত্রুটি উৎরানো, ব্যর্থতার কারণ জেনে উত্তরণের সাফল্য কবে আসবে? ব্যর্থতা সাফল্যের পিলার। তো সেই পিলার আর কত গাঁথবো? বিল্ডিং কি কোনোদিনই উঠবে না?
ফুটবল বা অন্যান্য খেলার মত ক্রিকেটেও একসময়ে আমাদের লক্ষ্য ছিল, “ভালো খেলে হেরে আসা।” আজ আমাদের ছেলেরা জিততেই যায়। তেমন অন্য ক্ষেত্রগুলোতেও ওঠে আসুক। জেসিয়াকে ২ মিনিটে দেশকে তুলে ধরার যে ভিডিওটি সময়েরও অনেক পরে এবং কোন ব্রিফ না করে পাঠানো হয়েছে তা সবচেয়ে ডেলিকেট একটা পর্বে তাকে উপস্থাপন করতে হয়েছে। উপস্থাপনে তার প্রস্তুতির অভাব, হতাশা ছিল স্পষ্টতই দৃশ্যমান। কিন্তু কেন? অন্যদেশীদের এই অভাব না হলে আমাদেরটায় কেন? জেসিয়ার ক্ষোভের সূত্র ধরে বলি, তাকে অযোগ্য প্রমাণ করতে? উপরের দিকে চেয়ে থুতু ফেললে নিজের মুখেই আসে, আয়োজকদের তো আরো বেশি, এই তথ্য আয়োজকদের অজানা?
মানুষ সব সময়েই অসাধারণদের উদাহরণ দেয়। তারা অনুপ্রেরণা হতে পারেন, কিন্তু তারা উদাহরণ হতে পারেন না। কারণ, তাদের মত সবাই হলে তো তারা অসাধারণ হিসেবে উল্লেখিতই হতেন না। পাকিস্তানে উষর মাটিতে যেখানে বল স্পিন করাতে, দৌড়াতে জান চলে যায়, সেখানে খেলেই ওরা ক্রিকেট শেখে। কাজেই তারা যখন আসল ক্রিকেট বল হাতে ক্রিকেট পিচে খেলে তখন স্বাভাবিক ভাবেই বলে ঝড়ের গতি তোলে। বছর বছর সেরা ফাস্ট বলার এভাবেই হয়। কিন্তু নদীমাতৃক দেশে পুকুর নদীতে সাঁতার কেটে বেড়ে উঠলেও ইংলিশ চ্যনেল বিজয়ী ব্রজেন দাস ছাড়া আমাদের বিশ্বমানে উল্লেখযোগ্য আর তেমন কোন সাঁতারু নাই। আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে সাঁতারে কখনোই আমরা সেরা না।
কোচরা বলেন বিশ্বমানের সুইমিং পুল নাই, তাই সেসব পুলে সাঁতার কাটার এই প্রস্তুতিও নাই। সেই একই প্রস্তুতির অভাব। আমার মতে বিচারকদের বিচারে সেরা জেসিয়া ইসলাম আসলেই সুযোগ্য ছিলেন। নাহলে এই বয়সে এমন সিলেকশন বিতর্ক নিয়ে, নিজের দেশের লোকেদের অনুপ্রেরণা, উৎসাহের বদলে তার চেহারা , ইংরেজি জ্ঞানের বিশ্রী ট্রল মাথায় নিয়ে, উপরন্তু আয়োজকদের এমন বৈরিতা, অসহযোগিতা নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় সেরা ৪০ এ উঠতে পারা সম্ভব নয়। কিন্তু দুঃখ আরো বেশি হবে যখন এ থেকেও কোন শিক্ষালাভ হবে না।
যে কোনো কাজে প্রস্তুতি কেমন হয় এ বিষয়ে জাপানের সামান্য অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। জাপানে একজন বুড়ো মানুষও কোনো কাজের সময় ঠিক করতে চাইলে ব্যাগ থেকে ছোট ডায়েরি বের করেন। ডায়েরিতে বছরের ৩৬৫ দিনের তারিখ লেখা ঘরে কবে, কখন কি করবে তার হিসাব লেখা। ঘর কেটে দিন ঘন্টা লেখা। তো সেই ঘরের ভেতরেই ফাঁকা কোনো ঘরে আমার শিডিউল বসে যাবে। এবং নিম্নলিখিত যে কাজগুলো কখনোই হবে না- ১। দিনক্ষণ ফোন করে আবার রিমাইন্ডার দেবার কিছু নেই। নির্দিষ্ট দিনে, সময়ে সে সেখানে পৌঁছে যাবে। ২। মিটিং হলে অবশ্যই সময়ের ১০ মিনিট আগে পৌঁছবে। কারণ, সে পথের সময়ের হিসেব করেও সময়ের ১০ মিনিট আগেই বের হবে, দেরিতে পৌঁছানোর ঝুঁকি এড়াতে।
এছাড়াও মিটিং এ পৌঁছে ধাতস্থ হবার সময় পেতে। ৩। দাওয়াতের নিমন্ত্রণ পত্রে অবশ্যই সবাইকে স্বাক্ষর করে, ইমেইলে দাওয়াতে নির্দিষ্ট সময়ের ভেতরে রিপ্লাই দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে সে যাচ্ছে কিনা। এই নিশ্চয়তা সে না দিলে তার জন্য খাবারের কোন বরাদ্দ থাকবে না। আর নিশ্চিত করেও না গেলে তাকে তার খাবারের অংশের খরচ পরিশোধ করতে হবে। কাজেই দাওয়াত পেলাম, যাবো কিনা সময়মতো জানানোর গরজ নাই, না গেলেও কোন গ্রাহ্য নাই যে তার জন্য বরাদ্দ খাবারটা নষ্ট হবে, এর খরচ কে বহন করবে- এসব অসভ্যতার বালাই নাই। ৪। যে কোন কাজের ডেডলাইন থাকবে, সেটা নিজের কাছেই হোক, কোম্পানির কাছেই হোক।
টার্গেট ছাড়া কোন কাজ নাই। “ আচ্ছা মেইল পেয়েছি, দেখেছি, উত্তর দেবো, করবো” - এসব সরকারি কথাবার্তার সুযোগ নাই। এছাড়াও নিজের এক বা একাধিক কাজ নিয়ে অস্থিরতা, আত্মবিশ্বাসে টান আর ব্যর্থতার আশঙ্কায় সবদিকে সমন্বয় সাধনে যে কেউ যা করতে পারে- ১। জাপানীদের মত ডায়েরির দিবস, ঘন্টা হিসেবে কাজ বরাদ্দটা নিজের মত করে পেশাগত, সামাজিক, সাংসারিক, আত্মার খোড়াক যোগানো, বিনোদনের সব কাজের হিসাবই লিখে রাখা। ৩। দিন শেষে একবার চোখ বুলাই কোন ডেডলাইন মিস করেছি এবং কেন? কত ঘন্টা প্রডাক্টিভ গেছে, কত ঘন্টা অপচয় হয়েছে। ৪। এভাবে অপচয় কমিয়ে আনতে পারি এবং এও বুঝতে পারি জীবিকার বা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে আমার সময়ের কতটা ব্যয় হচ্ছে; কতটা সামাজিকতা (দরকারি/ অদরকারি ), আলস্য আর বিনোদনে। এর মানে এই না যে বিনোদনের প্রয়োজন নাই। বিনোদন অতি আবশ্যিক। দরকার সমন্বয় সাধন । কারণ আমাদের কর্মক্ষম বয়স এটাই।
অবসরকালীন বয়সে আলস্য বিনোদনে বেশি বরাদ্দ থাকতেই পারে। এখন একজন অভিতাভ বচ্চনের ৭৫ বছর বয়সেও শিডিউল ২০২০ পর্যন্ত বুকড থাকতেই পারে। কিন্তু আবারো বলা, এক্সেপশন উদ্দীপনা হতে পারে, উদাহরণ না। আমাদের দেশের যে কোনো ইভেন্টে অব্যবস্থাপনা এমনই যে পাশের দেশ থেকে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট আনতে হয়, বার বার! বিবিএ, এমবিএ করে না এমন করপোরেট পার্সোনেল খুঁজে পাওয়া মুশকিল, কিন্তু কোর্সগুলির আউটপুট কি অন্য কোর্সের মতই গ্রন্থগত বিদ্যা? আরো একটি দিক, “স্কিল বেইজড শিক্ষা” এর প্রয়োজনীয়তা এবং মূল্যায়ন চাহিদা আমাদের দেশে প্রকটতর হচ্ছে। গালভরা ডিগ্রিতে পয়সা বেশুমার জলে যাচ্ছে, কারণ এই ডিগ্রি না হলে সিভিই নিবেনা। কিন্তু উপযুক্ত স্কিলের অভাবে কাজও হচ্ছে না।
এছাড়াও যেই ঘাটতিটা কেউ ঘরে বসেও ঠিক করতে পারি তা হলো নিজের সামনে দাঁড়িয়ে বলি- ১। আমার দক্ষতা কি? কি ভালো লাগে? ( কাজে ভালো লাগা না থাকলে তো কাজই হবে না, সফলতা কিভাবে?) ২। আজ থেকে ৫/১০ /২০ বছর পর আমি কি হতে চাই?( ইন্টারভিউ বোর্ডের চটকদার উত্তর না, সৎ উত্তর) ৩। সেই গন্তব্যে পৌঁছতে আমার কি কি করণীয় ? ( মামা ধরা, বসের ছেলে/ জামাই হওয়া যাদের নসিবে নাই, মানে অন্যের পায়ে দাঁড়ানোর উপায় নাই) ৮। ডায়েরি মেইনটেন করা, শিডিউল করা । ৫। এবং সব সময় ব্যাক আপ প্ল্যান রাখা। কারণ কেউই বা কিছুই বিশ্বে অবিনশ্বর না। তাই কারো / কোনকিছুর উপর পুরোপুরি নির্ভর করে বসলে সেই মানুষটা হঠাৎ নাই হয়ে গেলেও যেন কিছু না থেমে যায়।
নিজের যোগ্যতার ওপর দাঁড়ান। কেউই কোন কারণ ছাড়া, কোন যোগ্যতা ছাড়া এই দুনিয়ায় আসে নাই। কাজেই সেটাই গুছিয়ে নিয়ে লক্ষ্য নির্ধারণ করে প্রস্তুতি নিন। ব্যর্থতা অনেক কিছুর ওপরেই নির্ভর করে, আমার মত অদৃষ্টবাদীরা নিয়তিকেও দোষ দেই। কিন্তু নিজের নিষ্ঠার যেন কোনো ত্রুটি না থাকে। মনে রাখবেন,“ আমি ঠিকমত পড়লে আইনস্টাইন হতাম/ আমার তো রাজপুত্র, রাজকন্যা পাবার কথা” , এসব বলে সবাই ঠাট্টার পাত্রই হয়। আপনার দাম সেটাই, যে দামে আপনি বিক্রি হয়েছেন। অর্থাৎ যা আপনার বাজারদর, যা আপনার অর্জন, তা পেশাগতই হোক ব্যক্তিগতই হোক, সেটাই আপনি।
লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।
এইচআর/জেআইএম