শুধু দৌড়, শুধু অন্তহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা
দ্রব্যমূল্যের চাপ, আইনশৃংখলা পরিস্থিতির চাপে অভিভাবকরা চাপে থাকবেন, আর তাদের সন্তানরা থাকবে না, তা কি হয়? তাই পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী (পিইসি) এবং অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার যৌক্তিকতা নিয়ে শিক্ষাবিদরা যাই বলেন না কেন, সরকার শিশুদের এই দুটি পরীক্ষার চাপে রাখা ছাড়া কোন বিকল্প দেখছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে জ্ঞানভিত্তিক প্রজন্ম গড়ে তোলার বদলে পরীক্ষা নির্ভর অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বড় হওয়া একটি আগামী প্রজন্মই কাংখিত।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার জানিয়ে দিয়েছেন, ‘সরকার যতোদিন চাইবে ততোদিন প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা হবে। পুরোটাই নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। তিনি দায়িত্বে, কিন্তু বলছেন সরকারের কথা। যদিও ২০১৬ সালের ২১ জুন গণশিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছিলেন, প্রাথমিক শিক্ষার স্তর অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত হওয়ায় ওই বছর থেকে আর পঞ্চমের সমাপনী পরীক্ষা নেবে না সরকার।
এই পরীক্ষা দুটি শিক্ষার্থীদের কতটা কাজে আসছে তার কোন গুণগত বিশ্লেষণ নেই। তবে কোচিং এবং গাইড নির্ভরতা বাড়ায় সরকার হয়তো এর বাণিজ্যিক দিকটার গুরুত্ব অনুধাবন করছে। মেধার স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়ে শিশুদের মাঝে অনাকাঙ্ক্ষিত পরীক্ষাভীতি তৈরি হচ্ছে, অভিভাবকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বাড়ছে।
প্রারম্ভিক শিক্ষায় কাউকে জোর করে আটকে রাখাটা অযৌক্তিক। সব পড়ুয়াই সব বিষয়ে সমান দক্ষ হতে পারে না। শিক্ষাকে যদি অধিকার হিসেবে মানি, তবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কোনও পড়ুয়াকে আসলে ফেল করানো ঠিক না। কিন্তু পরীক্ষার নামে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে তা নীতি নির্ধারকদের কোন ভাবনাতেই নেই বলেই এই ছোট ছোট শিশুদের পরীক্ষা ব্যবস্থাতেও দুর্নীতি বিকশিত হচ্ছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে, শিক্ষকরা, অভিভাবকরা এই বাণিজ্যে মনোনিবেশ করছেন।
ভাল ফল করতেই হবে- বাড়িতে অভিভাবকের অন্তহীন প্রত্যাশা, স্কুলেরও আকাংখা সেই স্কুলের নাম ছড়াবে, এমন চাপে অপরিণত মস্তিষ্ককে একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে রেখে দিচ্ছে। জীবনের কোনও ক্ষেত্রে, কোনও মূল্যেই ব্যর্থ হওয়া যাবে না, সর্বত্র সফল হতে হবে, অন্য সকলের সাফল্যকে টপকে যেতে হবে- এমন এক অবান্তর উচ্চাকাঙ্খার জালে আগামী প্রজন্মকে রেখে দেওযার এই নীতি সরকারের কাছে খুবই বিজ্ঞানভিত্তিক কেন মনে হলো সেই প্রশ্নও হয়তো করা যাবেনা। বিন্দুমাত্র ব্যর্থতাও অসম্মানজনক- জীবনের এমন এক অদ্ভুত ধারণায় বড় হচ্ছে শিশুরা। আর এতে করে ধ্বংস হচ্ছে বাল্য, নষ্ট হচ্ছে শৈশব, শেষ হয়ে যাচ্ছে কৈশোর, মুছে যাচ্ছে তারুণ্যের দিন- থাকছে শুধু দৌড়, শুধু অন্তহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা। শিক্ষাব্যবস্থার শিরদাঁড়া ভাঙার এর চেয়ে উন্নততর ব্যবস্থা আর কি হতে পারে?
প্রতিযোগিতায় আচ্ছন্ন শুধু কোনও শিশু বা তার পরিবার শুধু নয়, আচ্ছন্ন গোটা সমাজই। সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন, অতিরিক্ত চাপে শিক্ষার সাথে শিক্ষার্থীদের সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে। শিশুদের ভাবনার মূল্য দেয়া হয় না সমাজে, ফলে বড় হয়ে সেই শিশুই, একইভাবে অন্যের ওপর নিজের মতামত চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে।
শিশুবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা না থাকায় পড়াশোনা শিশুদের কাছে শাস্তিমূলক হয়ে উপস্থাপিত হচ্ছে। এই প্রবণতায় এখনই যদি রাশ টানা না যায়, জানিনা কি বিপর্যয় অপেক্ষা করেছে আমাদের জন্য। জানা গেল প্রথম দিনেই প্রাথমিক সমাপনীতে প্রায় দেড়লাখ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত। এতেই বোঝা যায় এমন পরীক্ষা ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কতটা ভীতির সঞ্চার করেছে। ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মনে ভয় সৃষ্টি এবং অভিভাবকদের মধ্যে অকারণ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করা ছাড়া এ পরীক্ষা আসলে কোন কাজে আসছে না।
প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভুলে ভরা প্রশ্নপত্র, পাঠ্যসূচিকে সাম্প্রদায়িকীকরণের বিস্তর সমস্যার কোন সুরাহা না করে সরকার গো ধরে বসে আছে পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষার পক্ষে। অশিক্ষা যে কত গুরুতর হতে পারে, তার প্রমাণ শিক্ষকদের করা প্রশ্নপত্রে ভুলে আর ভুল। সেই আলোচনায় নাইবা গেলাম। আমাদের শুধু জানার ইচ্ছা, ছোট ছোট বাচ্চারা সত্যিকারের কী শিক্ষা অর্জন করছে সে বিষয়ে সরকার কি যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে পারছে? বাল্যকালের ভিত্তি নড়বড়ে থাকছে বলেই, আমাদের উচ্চ শিক্ষাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের কোন বিশ্ববিদ্যালয় এখন আঞ্চলিক বা বিশ্ব পরিসরে কোন র্যাংকিং-এ নেই। রিপোর্ট বের হয় যে, কর্পোরেট ইনোভেশন ইনডক্স-এ বাংলাদেশ নেপাল ও পাকিস্তানেরও পেছনে।
প্রাথমিক স্তরে এক ধরনের শিক্ষা ব্যবস্তা গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ নেই। বাংলা মাধ্যম- তার আবার উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত ধরন, ইংরেজী মাধ্যম– তারও শ্রেণিভেদ, মাদ্রাসা ব্যবস্থা– এরও নানা মতবাদ। অল্পসংখ্যক ভাল প্রাথমিক স্কুল আছে দেশজুড়ে। এখানে সরকারের নিজস্ব উদ্যোগে স্কুল, কলেজ খুব কমই গড়ে উঠেছে। মানুষের নিজস্ব উদ্যোগে গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক দায়িত্ব নেওয়াই সরকারি রেওয়াজ। ফলে প্রাথমিক ও উচ্চ-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় সংকট চিরকালের।
২০১৫ সালে গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য দেশের ৮৬ দশমিক ৩ শতাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে হয়েছে। আর ৭৮ শতাংশ সরকারি বিদ্যালয়ে কোচিং ছিল বাধ্যতামূলক। পাসের হার বাড়াতে খাতায় নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অনিয়ম হচ্ছে। পরীক্ষার হলে দেখাদেখি করে লেখা এবং উত্তরপত্র মেলানোর জন্য শেষের ৪০ থেকে ৬০ মিনিট অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই পরীক্ষার জন্য প্রাইভেট পড়ার নির্ভরশীলতা বাড়ছে, পাঠ্যবইকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে গাইডবই। শিশুরা শেখার আনন্দ পেতে এবং সৃজনশীল হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
শিক্ষার প্রসারে রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাবের এক ঐতিহ্য রয়েছে আমাদের। আমাদের শাসকরা মৌলিক শিক্ষাকে সর্বজনীন করার লক্ষ্যে এমন কোনও ধারাবাহিক উদ্যোগ নেয়নি, যা আমাদেরকে শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা গ্রহণযোগ্য মানে পৌঁছে দিবে। ইচ্ছাশক্তির অভাবের এই ধারাবাহিকতার প্রতিফলন হলো প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষকদের নৈতিকতা ও যোগ্যতার মান নেমে যাওয়া, কোচিং ও গাইডবই বাণিজ্যের সমৃদ্ধি লাভ করা।
রাজনৈতিক রং-নির্বিশেষে শাসককূলের প্রিয়তম গিনিপিগের নাম শিক্ষা। শাসকের রং বদলায়, কিন্তু অভ্যাস অপরিবর্তিত থাকে। শিক্ষা-গিনিপিগের উপর স্বেচ্ছাচারের ঐতিহ্যটি বজায় থাকে সবসময়ই। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের শ্রেষ্ঠ পন্থা পরীক্ষা নয়। বিশ্বের বহু দেশেই প্রাথমিক স্তরে এমন পাবিলিক পরীক্ষার বালাই নেই। সেকথা মানবেন কি করে আমাদের নীতি নির্ধারকরা, যারা শিক্ষা নিয়ে শুধু পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে ব্যস্ত? শিক্ষাব্যবস্থার উপর যে পরিমাণ অত্যাচার হচ্ছে, তাতে একদিন হয়তো দেখা যাবে শুধু খোলসটি পড়ে আছে, কোনও কাঠামো অবশিষ্ট নেই।
লেখক : পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস